বুয়েটে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনে শিক্ষার্থীদের উসকানির নেপথ্যে কারা? 

বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ফেসবুক পেজের স্ক্রিন শট

বুয়েটে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনে শিক্ষার্থীদের উসকানির নেপথ্যে কারা? 

অনলাইন ডেস্ক

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছাত্র রাজনীতির ফের চালুর পক্ষে গত ১ এপ্রিল এক আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে রাজনীতি থাকবে কি না- এ বিষয়ে আদালতে আইনি লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অথচ আদালত ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিষয়টির সমাধানের প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছেন শিক্ষার্থীরা। বুয়েট শিক্ষক সমিতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দ্রুততম সময়ে ক্লাস ও পরীক্ষাসহ একাডেমিক কার্যক্রম চালুর দাবি করলেও তা সম্ভব হচ্ছে না।

এমতাবস্থায় ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনে শিক্ষার্থীদের পেছন থেকে কেউ উসকানি দিচ্ছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে অনেকের মাঝে।  

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বিষয়ে আদালতের পর্যবেক্ষণের কপি পেতে অপেক্ষা করছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। হাতে পেলেই পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা হবে বলে জানিয়েছে প্রশাসন। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়া শুরুর আগে থেকেই বুয়েটে পরীক্ষা ও ক্লাস বর্জন করেছেন কিছু শিক্ষার্থী।

আদালতের সিদ্ধান্তকে নিজেদের পক্ষে নিতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছে তারা। বিষয়টিকে নিশ্চিতভাবেই আদালত অবমাননা ও আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন হিসেবে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। প্রশ্ন উঠছে, শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও ক্লাস বর্জনের জন্য উৎসাহিত করছেন কারা? তাদের উদ্দেশ্য কী?

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রে বাধা না থাকার পর্যবেক্ষণ আদালত থেকে দেওয়ার পরও এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কমিটি দেয়টি কোনো ছাত্র সংগঠন। এ বিষয়ে একাধিক ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা আইনি প্রক্রিয়ার পূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু আইনি প্রক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে নারাজ বুয়েটের কিছু শিক্ষার্থী।  

বুয়েটের ২০তম ব্যাচের পক্ষ থেকে বলা হয়, যতদিন পর্যন্ত প্রশাসনের সহায়তায় সুষ্ঠু আইনি প্রক্রিয়ার প্রয়োগে বুয়েট ক্যাম্পাসে সকল প্রকার লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের বিজ্ঞপ্তি পুনর্বহাল হচ্ছে না, ততদিন বুয়েটের ২০তম ব্যাচ কোনো ধরনের একাডেমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে চায় না। এটি ২-৩ মাস থেকে আরও বেশি সময় লাগতে পারে। তাদের এই সিদ্ধন্তে একটি প্রশ্ন ওঠে, এই দীর্ঘ সময় ধরে কী তাহলে বুয়েটে ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ থাকবে?

এদিকে, ২১তম ব্যাচ তাদের দাবিতে জানায়, যেকোনো জঙ্গি সংগঠনের/নিষিদ্ধ সংগঠনের নামে মেইল/ চিঠি বা অন্য কোনোভাবে ছাত্র ও শিক্ষকদের ফাঁসানোর চেষ্টা ঠেকাতে সচেষ্ট হতে হবে। প্রয়োজনে সাপোর্ট সেল খুলতে হবে। অর্থাৎ স্পষ্টভাবে বুয়েটে হিযবুত তাহরী ও শিবিরের কার্যক্রমকে সরাসরি অস্বীকার করছেন তারা। এমনকি একজন শিবির নেতা নিজেই বুয়েটে শিবিরের কার্যক্রম চলছে জানানোর পরও বিষয়টি আমলে নিতে চাচ্ছেন না কতিপয় শিক্ষার্থী। প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি মৌলবাদী এই গোষ্ঠী যেন অবাধে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করতে পারে, তার স্বপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে বুয়েটের ২১তম ব্যাচ?

‘আদালতের সিদ্ধান্ত ও আইন প্রক্রিয় না মেনে পরীক্ষা ও ক্লাস বর্জনের ঘোষণা কেন’- এ বিষয়ে জানতে বুয়েটের ২০তম ব্যাচ থেকে এ কার্যক্রমের পক্ষে থাকা একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতেই রাজি হননি তারা। ফোন করা হয়, ২০তম ব্যাচের মিশেল ইসলাম শেলি, মাহমুদ আকন, তানভীরুল ইসলাম, ইলিয়াস কায়কোবাদ ভূঁইয়া, আব্দুর রহমান, গাজিব আঞ্জুম তালুকদার, জামশেদুল ইসলাম রাহাত আতাহার শিহাব এবং আল ফারাবিকে। ম্যাটেরিয়াল ও ম্যাটালারজিক্যাল বিভাগের ২০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মিশেল ইসলাম শেলি বলেন, ‘বুয়েটের আন্দোলন নিয়ে যা আপডেট আছে, সবই সাংবাদিক সমিতির পেজ থেকে জানানো হয়। এর বাইরে আর কোনো আপডেট নেই। আপনাদের যা জানার ওখান থেকে জেনে নিন। ’

উল্লেখ্য, এই সাংবাদিক সমিতিতে শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে টাঙ্গুয়ার হাওরে আটক হওয়া ৩৪ জনের মধ্যে ৫ জন রয়েছেন। যাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা জোরদার করার কোনো দাবি এই দুই ব্যাচের দাবিগুলোর মধ্যে ছিল না। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও কোনো কথা বলা হয়নি। উল্টো বলা হয়েছে, তাদের বিচার কার্যক্রম আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে হবে। বিষয়টিকে স্পষ্টরূপে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনকারীদের পক্ষে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের দ্বিচারিতা প্রকাশ পেয়েছে। কেননা ছাত্র রাজনীতি বন্ধের জন্য আদালত ও প্রশাসনকে চাপে ফেলতে পরীক্ষা বর্জনের কথা বলা হলেও মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক কার্যক্রম বন্ধের বিষয়ে চাপ দেওয়াতে আগ্রহী নন এই শিক্ষার্থীরা।

অন্যদিকে বুয়েটের বিভিন্ন গ্রুপে সাবেক কিছু শিক্ষার্থী উসকানিনিমূলক, বিভ্রান্তিকর ও গুজব ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনমত গঠনের চেষ্টা করছেন। সেখানে পরীক্ষার হল থেকে এক শিক্ষার্থীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করা হলেও এ বিষয়ে কোনো তথ্য-প্রমাণ, প্রকাশিত সংবাদ বা তার ক্লাসের সহপাঠীদের বক্তব্যও উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন অভিযোগকারী। উল্টো জানা যায়, এনামুল নামের সেই অভিযোগকারী নিজে শিবিরের সক্রিয় রাজনীতি করতেন বলে অনেকে তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু তার সেই বক্তব্যটি বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার করা হচ্ছে বিশেষ কিছু ব্যক্তির মাধ্যমে। বিশেষত বুয়েটের আড়িপাতা গ্রুপে এমন একাধিক পোস্ট পাওয়া গেছে, যেখানে মৌলবাদীদের হামলায় নিহত আরিফ রায়হান দীপকে নিয়েও মিথ্যা ও গুজব ছড়িয়ে তার চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়। এ বিষয়টিকে ছাত্র শিবিরের ‘নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন সাবেক অনেক বুয়েট শিক্ষার্থী।  

বুয়েটের ২০তম ও ২১তম ব্যাচের কিছু শিক্ষার্থী যখন পরীক্ষা বর্জনের পক্ষে নিজেদের অবস্থান জানায়, একইদিনে বিশ্ববিদ্যালয়টির দুই জন শিক্ষকের কলাম ও সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। যেখানে সব বক্তব্য ছিল বেশ কাছাকাছি। একটি কলামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আশিকুর রহমান ছাত্র রাজনীতি থাকাকালীন সময়কে বুয়েটের ‘অন্ধকার অধ্যায়’ বলে অভিহীত করেন। তার লেখায় শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ও ক্লাস বর্জনকে আরও উৎসাহিত করা হচ্ছে। আদালতের বিরুদ্ধে গিয়ে একজন শিক্ষক কীভাবে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা-ক্লাস বর্জন করতে উৎসাহিত করতে পারে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। সেই সঙ্গে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের কার্যক্রমকে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ- এই শিক্ষকের ম্যাকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের। এদিকে কলামের বিষয়ে জানতে অধ্যাপক আশিকুর রহমানকে ফোন দেওয়া হলে তিনি কোনো প্রশ্ন শুনতে রাজি নন বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানান। তিনি বলেন, ‘যা আছে কলামে আছে। আমি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত নই। ’

এ বিষয়ে কথা হয় বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদের সঙ্গে। তারা মনে করেন, আইনি প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব না দিয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের দিকে গেলে শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কতদিন ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করে তারা চলবেন? সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেকে বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশার মধ্যে আছেন। এ বিষয়ে আরও চিন্তা করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন তারা।

news24bd.tv/আইএএম