চঞ্চল চৌধুরীর ‘মনোগামী’তে কী আছে 

চঞ্চল চৌধুরীর ‘মনোগামী’তে কী আছে 

অনলাইন ডেস্ক

ঈদ বা যেকোনো বিশেষ দিবস আসলেই বিনোদন মাধ্যমগুলোতে মুক্তি দেয়া হয় সিনেমা, সিরিজ সহ নানা ধরনের কনটেন্ট। এবারের ঈদুল ফিতরের উৎসবকে কেন্দ্র করে ঈদে যে পরিমাণ সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, তেমনটা নিকট অতীতে দেখা যায়নি। এই ঈদে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে ১১টি সিনেমা। অন্যদিকে চাঁদরাতে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকিতে  মুক্তি পেয়েছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত 'লাস্ট ডিফেন্ডারস অব মনোগামী' বা 'মনোগামী'।

এই সিনেমায় চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে অভিনয় করেছেন সঙ্গীতশিল্পী জেফার। এটি চরকির ‘মিনিস্ট্রি অব লাভ’ প্রজেক্টের তৃতীয় সিনেমা।

চাঁদরাতে মুক্তি পাওয়া 'মনোগামী' ওয়েব ফিল্ম নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা তুঙ্গে। সিনেমাটি দেখে অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে রিভিউ দিচ্ছেন।

দর্শদের অনেকেই বলছেন, অনেক দিন পর একটা অসাধারণ ওয়েব ফিল্ম তারা দেখেছেন। অন্য রকম আনন্দ দিয়েছে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর 'মনোগামী'।

'মনোগামী' দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ''আমাদের পিতা-মাতারা ছিলেন মনোগামী, একদম ক্লাসিক্যাল অর্থে মনোগামী। আম্মার জীবনে অন্য কোন পুরুষ ছিল না, না বিয়ের আগে, না আব্বা  ৬৭ বছরে মারা যাওয়ার পরে। আম্মার আর বিয়ে করার বয়স ছিল না। থাকলে কি করতেন? মনে হয় না। আমার এক সেকেন্ড কাজিন ছিলেন। আনসারী নাম, আগুনের মতো সুন্দরী, অনেকটা সবচেয়ে সুন্দরকালের শ্রীদেবীর মতো। উনি ২০/২১ বয়েসে তিন বাচ্চা নিয়ে বিধবা হন, বহু বছর পরে আমি যখন আম্মার সাথে স্বচ্ছন্দে সব আলাপ করতে পারি, জিজ্ঞেস করলাম, আম্মা, আনসারী আপা আর বিয়ে করলেন না কেন? আম্মা ভ্রু কুঁচকে গেল, তিনি বিরক্ত হয়ে বলেন, তওবা তওবা, তুমি এটা কি বললা!

এটাও প্রায় তিরিশ বছর আগের ঘটনা। এতোদিনে তুমুল বিশ্বায়ন হয়েছে, আকাশ সংস্কৃতিতে প্রভাবিত হয়েছি আমরা, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক স্থাপনে ধর্মীয়, সামাজিক এবং অভ্যাসগত ভীতি বহু কমেছে। মনোগামী শব্দটি বাংলাদেশে এখন ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে প্রধানত বৈবাহিক সম্পর্কে থাকা অবস্থায় মনোগামীতার অর্থে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি আরো সংকীর্ণ অর্থে অর্থাৎ একসময়ে একজনের সাথে (বিয়ে কিংবা বিয়ে ছাড়াই) দৈহিক সম্পর্ক রাখা অর্থে বোঝানো হয়। '' 

তিনি লেখেন, ''ফারুকীর সিনেমা লাষ্ট ডিফেন্ডার্স অব মানোগামী নিয়ে আমার কৌতুহল ছিল বিষয় বৈচিত্রের কারণে, ফারুকীরও কারণে। তার সিনেমার বিস্তার আর গভীরতা সিনেমার মতো হয়ে উঠে না মাঝে মাঝে। কিন্তু তার যে কোন কিছু দেখতে দেখার সময়টা ভাল লাগে। পরিচালনা, দৃশ্যায়ন, শব্দ আর আলোর ব্যবহার, অভিনয় এগুলো হয় খুব উন্নত মানের। এরকম একটা মাইন্ডসেট নিয়ে সিনেমাটা দেখলাম আমি আর শীলা মিলে। দেখার কৌতুহলটা শেষ পর্যন্ত ছিল, অনেক জায়গা অনেক এনজয়ও করেছি। তবে ছবিটা দেখে মাইন্ডসেট-এ ঝাঁকি দেয়ার মতো তেমন কিছু পাইনি। '' 

তিনি আরও লেখেন, ''ফারুকীর মনোগামীতে সিনেমাটেগ্রাফী,সাউন্ড, অভিনয় (এবং সংলাপ) এগুলো বরাবরের মতো ছিল উন্নত মানের (বিশেষ করে চঞ্চলের, আমি তার অভিনয়ের বিশাল ভক্ত)। কিন্তু আমার মনে হয় না ছবিটার কথা বেশীদিন মনে থাকবে আমার। এটা আমার মধ্যে নতুন কোন বোধের জন্ম দেয়নি, জানি না এমন কোন ম্যাসেজ দেয়নি, বা দেখার পরে অল্পসময়ের জন্য হলেও ঘোরগ্রস্থ করে রাখেনি। ''   

তিনি লেখেন, ''মনোগামীর একটা দুবর্লতার কথা নির্দিষ্টভাবে বলতে হবে।  বাংলাদেশের অধিকাংশ নাটক আর সিনেমায় এটি থাকে, এটি হচ্ছে কাহিনীর দুর্বলতা। ফারুকীর সিনেমার প্লট এতো সম্ভাবনাময় যে এখানে এটি একটুও থাকবে তা ভাবিনি। যেমন: ক) চঞ্চল হঠাৎ করে জেফারকে জড়িয়ে ধরলো, একরকম হতে পারে, তবে তা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য আগের দৃশ্যগুলোতে কোন ইংগিত ছিলনা। খ) চঞ্চল বিছানার মধ্যে হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলো, এই অনুশোচনা বা আত্নজিজ্ঞাসা তো বিনোদিত হওয়ার পরে হওয়ার কথা, বিনোদিত হতে হতে না। গ) সে সাংবাদিক সম্মেলন করার যে ইচ্ছে প্র্রকাশ করলো (তাও আবার জেফারের নাম বলে) এটা বেশ ফানি। অনুতপ্ত হলে সে অফিসের সবার কাছে কনফেশন করবে, সাংবাদিক সম্মেলন কেন?''

পরিশেষে তিনি লেখেন, "নাটকের শেষটাও একটু অবিশ্বাস্য। আর সিনেমার নামটার মানে বুঝলাম না। কারা লাষ্ট ডিফেন্ডারর্স এখানে, চঞ্চল, জেফার? কিভাবে? এদের তো আসলে ডিফেন্ড করার নিয়ত ছিল দোদূল্যমান। বিমান দুঘর্টনা না ঘটলে কি করতো এরা? যাই হোক, ফারুকী আছে বলে আমরা মুগ্ধ হওয়ার পাশাপাশি সমালোচনাও করতে পারি, নানা প্রশ্ন তুলতে পারি (এর অনেক কিছু অযৌক্তিকও হতে পারে)। সিংহভাগের নাটক সিনেমায় এটা করার আগ্রহও কেউ অনুভব করেনা। অভিনন্দন ফারুকী। কেন যেন মনে হয়, আপনার সেরা সিনেমাটা এখনও বানান নি আপনি। "

‘মনোগামী’ ওয়েব ফিল্ম দেখে নাটক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা তপু খানে তাঁর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ''সরয়ার ভাইয়ার কাজ যখন প্রথম থেকেই দেখা শুরু করি, তখন থেকেই একটা জিনিস লক্ষ করি আমি, সাধারণ একটি গল্পের মধ্যে সুন্দরভাবে অসাধারণ কিছু বার্তা তিনি দিতে পারেন। আমাদের সবার মধ্যেই দুই রকম রিপু বাস করে—সুরিপু ও কুরিপু। ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়েছিলাম এই ব্যাপারে। সুরিপুকে আমরা প্রকাশ করি। কিছু ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিতভাবে প্রকাশ করি, যেন সাধারণ মানুষ আমার সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করে। আর কুরিপু যতই বেশি থাকুক না কেন আমাদের মধ্যে, সেটাকে আমরা নিবারণ করি বা লুকিয়ে রাখি। তারপরও দিন শেষে বিবেকের কাছে বাধা থাকে মানুষ। তাই একা হলেও মানুষ নিজের সাথে কথা বলে, নিজেকে জানতে চায়, নিজেকে শোধরাতে চায়। আবার নিজের ভেতরে থাকা সুপ্ত অবৈধ ইচ্ছাগুলোকে বাস্তবে রূপান্তর করতে চায় স্বল্প সময়ের সুখের আশায়। মানুষের মধ্যে থাকা এই অন্তর্দ্বন্দ্বকে এত সুন্দর করে তুলে ধরা হয়েছে “মনোগামী”তে, যা আসলে সবার দেখা উচিত। ''

‘মনোগামী’ দেখে বেসরকারি টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগের প্রযোজক ইফতেখার মুনিম লিখেছেন এভাবে, ''মনে হলো অনেক দিন পর একটা খুব অসাধারণ ওয়েব ফিল্ম দেখলাম! নিকট অতীতে এমন পরিপূর্ণ ওয়েব ফিল্ম দেখিনি। ''

তিনি লেখেন, ''মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর অনবদ্য নির্মাণে ‘লাস্ট ডিফেন্ডারস অব মনোগামী’তে চঞ্চল চৌধুরী ও জেফার রহমানের অভিনয় আরও যেন প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। উল্লেখ করার মতো ছিল, শিশু অভিনয়শিল্পী শুদ্ধ আর রাইয়ের অভিনয় প্রতিভা। ঈদে এমন উপভোগ্য একটি ওয়েব ফিল্ম উপহার দেওয়ার জন্য প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান চরকিকে ধন্যবাদ। ''

‘মনোগামী’ দেখে ফেসবুকে তাইমুন পিয়া নামের একজন জানান, ‘মনোগামী’ মুভিতে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন, চাইছেন, তা এখনো ভাবছেন এই অনুরাগী।

আরও এক দর্শক ‘মনোগামী’ দেখে সামাজিক মাধ্যমে  লিখেছেন, ''পরিচালকের ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও কল্পনার সামাজিক বয়ান এটি। জীবনে চলার পথে আবেগ ও বিবেকের সংঘর্ষ অনিবার্য। এ সংঘর্ষের ফলাফল হলো মানুষের চরিত্র। এখানে আবেগ বা বিবেক কেউ জেতে না। জয়-পরাজয়ের চেয়ে মাঠে থাকাটাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ এদের কাছে। ''

পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর কাজের গুণমুগ্ধ ভক্ত উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ''মনোগামী’র চিত্রনাট্য যে কাউকে মুগ্ধ করবে। গল্প বলার ধরনে পরিচালক নিজস্ব ঢঙে এগিয়েছেন। চঞ্চল চৌধুরীর সঙ্গে জেফার খারাপ করেননি। ''  

কোন ভাবনা থেকে সিনেমাটি নির্মাণ করছেন, এমন প্রশ্নে পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছিলেন, ''আমার প্রিয় একটা কাজ হচ্ছে মানুষের মনের ভেতর ছিপ ফেলে দেখা, কী কী ধরা পড়ে সেখানে। ছোট-বড়, তুচ্ছ-গুরুত্বপূর্ণ—সবই আমাকে নাড়া দেয়। “মনোগামী”তে অনেক দিন পর নারী-পুরুষ সম্পর্কের কিছু দিক নিয়ে এই রকম ছিপ ফেলার সুযোগ পেয়েছি। ''

news24bd.tv/TR