গোল্ডেন ভিসা এখন মরণফাঁদ, নেপথ্যে কী

গোল্ডেন ভিসা এখন মরণফাঁদ, নেপথ্যে কী

গোল্ডেন ভিসা এখন মরণফাঁদ, নেপথ্যে কী

অনলাইন ডেস্ক

বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগের বিনিময়ে যেকোন দেশের ধনী মানুষকে অল্প সময়ের ব্যবধানে নাগরিকত্ব দেয়াকে গোল্ডেন ভিসা সুবিধা বলা হয়ে থাকে। ইনভেস্টমেন্ট মাইগ্রেশন কাউন্সিলের তথ্য অনুসারে, বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশ দ্রুততার সঙ্গে এমন দীর্ঘমেয়াদি ভিসা ও নাগরিকত্ব দিয়ে থাকে।

ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ২০১২ সালে যখন চরম ঋণসংকটে পড়ে, তখন সেখানকার ৬টি দেশ জাতীয় স্বার্থে এমন ভিসা চালু করে। বিশেষ করে স্পেন, পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড ও গ্রিসের অবস্থা এমন ছিল যে দেনার দায় সামাল দিতে তাদের আন্তর্জাতিক ঋণসহায়তা বা বেইল আউটের অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল।

জাতীয় ঋণের অর্থ ফেরত দিতে এসব দেশের নগদ অর্থের প্রয়োজন ছিল। এমন পরিস্থিতিতে দেশগুলো সরকারপ্রধান মুমূর্ষু আবাসন খাত চাঙা করতে ভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীদের সেসব দেশে বসবাস ও বিনিয়োগের সুযোগ দেয়।

এই কর্মসূচির কল্যাণে এক দশকে স্পেনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এসেছে। কিন্তু এই কর্মসূচি সে দেশের মানুষের জন্য বুমেরাং হয়েছে।

বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্টের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় নাগরিকরা বিপাকে পড়ে।

পেশায় চিকিৎসক স্প্যানিশ তরুণী আনা জিমেনা বারবা গত বছর মাদ্রিদ শহরের এক হাসপাতালে কাজ শুরু করেন। তখন তিনি মা–বাবার সঙ্গে শহর থেকে ৩০ মিনিটের দূরত্বে থাকতেন। তার আশা ছিল, এতে বাড়িভাড়ার যে খরচ বাঁচবে, তা দিয়ে একসময় নিজের বাড়ি কিনবেন। কিন্তু এরপর নিজের গ্রামে যখন বাড়ি কেনার জন্য খোঁজখবর নেয়া শুরু করেন, তখন দেখলেন, বাড়ির দাম পাঁচ লাখ ইউরোর ওপরে উঠে গেছে। এই অর্থ এতো বিশাল অঙ্ক যে স্পেনের গড়পড়তা বার্ষিক বেতনের প্রায় ২০ গুণ। অথ্যাৎ এ পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করতে তার কয়েক দশক লেগে যাবে।  

প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটিতে বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্টের এই উচ্চ মূল্যের পেছনে সরাসরি দায়ী দেশটির গোল্ডেন ভিসা কর্মসূচি। এই কর্মসূচির আওতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনীদের স্পেনে নাগরিকত্ব নিয়ে বসবাস ও পছন্দসই বাড়ি কেনার অধিকার দেয়া হয়।  

এ প্রসঙ্গে অ্যালার্জিবিষয়ক চিকিৎসক আনা জিমেনা বারবা বলেন, ‘এমন কোনো বাড়ি নেই যা আমি কিনতে পারি। ’ প্রতি মাসে ১০০ ঘণ্টা ওভার-টাইম বা অতিরিক্ত কাজ করেও তিনি কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। তিনি আরও বলেন, ‘বিদেশি ধনকুবেরদের জন্যে আমাদের এখানে বাড়ির দাম বেড়ে গেছে যা আমাদের মতো নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের বিমাতাসূলভ আচরণ। ’

দেশে এমন আবাসন–সংকট ও অসন্তোষের মুখোমুখি হয়ে স্পেন সরকার চলতি মাসে বলেছে, তারা গোল্ডেন ভিসা কর্মসূচি বাতিল করবে। শুধু স্পেন নয়, ইউরোপের অন্য যেসব দেশ গোল্ডেন ভিসা কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল, তারাও এই ভিসা প্রত্যাহার শুরু করেছে।

এ দশক আগে, এই ভিসা দিয়ে স্পেন সরকার লাভবান হয়েছে। আবাসন খাতে পাঁচ লাখ ইউরোর বেশি অর্থ বিনিয়োগ করার সুযোগ দিয়ে স্পেন ১৪ হাজার ৫৭৬টি গোল্ডেন ভিসা দিয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে সে দেশের মানুষের বাড়ি কেনার সামর্থ্য কমে গেছে।

স্প্যানিশ প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেছেন, আবাসন মানুষের অধিকার। চলতি মাসে এই গোল্ডেন ভিসা কর্মসূচি বাতিলের ঘোষণা দেয়ার সময় এ কথা বলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, স্পেনের বড় বড় শহরে আবাসন বাজার ব্যাপক চাপের মুখে পড়েছে। এখন যারা বসবাস ও কাজ করছেন, তাদের পক্ষে শোভন আবাসন খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ তারা রাষ্ট্রকে কর দিচ্ছেন।

এই গোল্ডেন ভিসার কল্যাণে ইউরোপীয় ইউনিয়নবহির্ভূত দেশের মানুষের এসব দেশে সাময়িক বসবাসের অধিকার কিনে নেওয়া সহজ হয়েছে, এমনকি সে জন্য তাদের সে দেশে বসবাসেরও প্রয়োজনীয়তা নেই। রাশিয়া, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগকারীরা এখন সেখানে বিনিয়োগ করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছেদ বা ব্রেক্সিটের পর ব্রিটিশ নাগরিকেরাও এই সুযোগ নিয়েছেন—গ্রিস, পর্তুগাল ও স্পেনের মতো দেশে তারা বাড়ি কিনেছেন। এমনকি মার্কিন নাগরিকেরাও এখন সেই সুযোগ নিচ্ছেন; নিজ দেশের বড় বড় শহরে কাঙ্ক্ষিত মানের জীবন যাপন করতে পারছেন না বলে তারা এখন ইউরোপের দেশগুলোতে চলে যাচ্ছেন।

২০১৮ সালে চীনের বিনিয়োগকারীরা গ্রিসে এক জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেটা হলো গ্রিসের ডেভেলপাররা বাজারমূল্যে সম্পদ কিনে চীনের সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের কাছে অনেক বেশি দামে বিক্রি করেছিলেন। এরপর ডেভেলপাররা সেই অর্থের কিছুটা বিনিয়োগকারীদের ফেরত দিয়েছিলেন।

২০২৩ সালে গ্রিস বিনিয়োগের সীমা দ্বিগুণ করেছে। দেশটির বেশ কিছু জনপ্রিয় স্থানে বিনিয়োগের বিনিময়ে বসবাসের অধিকার দেয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম বিনিয়োগসীমা পাঁচ লাখ ইউরোতে উন্নীত করা হয়েছে। এরপরও গ্রিসের বিরোধী দলগুলো মনে করে, এই স্কিম বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্কিমগুলোর অন্যতম। তারা এ সুযোগ একেবারে বন্ধ করে দেয়ার পক্ষে।  
news24bd.tv/aa