হঠাৎ এত গরম কেন

রিফাক আহমেদ

হঠাৎ এত গরম কেন

রিফাক আহমেদ

গরম বেশি পড়লে দেশের সবখানে গরম নিয়ে আলাপ শুরু হয়। যেমন—এ বছর বৈশাখ আসতে না আসতেই শুরু হয়ে গেল ‘হিট ওয়েভ’ বা তাপপ্রবাহ, যা সারা বাংলাদেশে বয়ে গেছে। ফ্যান ছাড়লে গরম বাতাস টের পাওয়া যায়।

নাসা পৃথিবীর ভূমি, বায়ুমণ্ডল, মহাসাগর ও বরফ সম্পর্কে অনেক ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে স্যাটেলাইট এবং অন্যান্য যন্ত্র ব্যবহার করে।

নাসার দেওয়া তথ্য মতে, পৃথিবীর জলবায়ু উষ্ণ হয়ে উঠছে। কখনো আবহাওয়া, কখনো জলবায়ু বললে গোলমাল লেগে যেতে পারে। সহজ করে বললে, ৩০ বা তার বেশি বছরের কোনো স্থানের গড় আবহাওয়া হলো জলবায়ু। আবহাওয়া বিভিন্ন মাত্রায় দেখা যায়।

কখনো খুব ঝড়, কখনো অতিবৃষ্টি, আবার অস্বাভাবিক গরমকে চরম আবহাওয়া বলা যেতে পারে। আর জলবায়ুর চট করে বড় পরিবর্তন হয় না। আবহাওয়ার হয়। দিনে গরম, রাতে ঠাণ্ডা।

জলবায়ুর পরিবর্তন হয় ধীরে ধীরে। সাধারণত এক দিকে ঝুঁকতে থাকে। যেমন—বর্তমানে পৃথিবীর জলবায়ু ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়ে উঠছে।

হঠাৎ এত গরম কেন বায়ুমণ্ডলের অতিরিক্ত গ্রিনহাউস গ্যাস পৃথিবীর জলবায়ুকে উষ্ণ করে তুলছে। গ্রিনহাউস গ্যাস, যেমন—কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং মিথেন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সূর্যের তাপ আটকে রাখে।

বায়ুমণ্ডলে কিছু গ্রিনহাউস গ্যাস থাকা স্বাভাবিক। পৃথিবীতে প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য উষ্ণতা প্রয়োজন আছে। কিন্তু অত্যধিক গ্রিনহাউস গ্যাস অতিরিক্ত উষ্ণতা সৃষ্টি করে। কয়লা ও তেলের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়।

পানি অনেক বেশি তাপ শোষণ করে। দেখা যায়, পানি গরম করতে প্রচুর শক্তি খরচ করতে হয়। মহাসাগরগুলো তাপ শোষণ করে উষ্ণ হয়। এই উষ্ণতার কারণে আর্কটিকে সমুদ্রের বরফ গলে যায়। নাসার আর্থ-স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য থেকে দেখা যায়, প্রতি গ্রীষ্মে কিছু আর্কটিক এলাকার বরফ গলে এবং বরফের আকার ছোট হয়। সেপ্টেম্বর মাসে সবচেয়ে ছোট হয়ে যায়। এরপর যখন শীত আসে, বরফ আবার বাড়ে। কিন্তু ১৯৭৯ সাল থেকে সেপ্টেম্বরে বরফ ছোট থেকে ছোট এবং পাতলা থেকে পাতলা হচ্ছে। তাই অল্প পরিমাণ উষ্ণায়নও কয়েক বছর ধরে বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে।

কোনো জায়গার তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার্থক্য হলে পুরো আবহাওয়া অনেকটা পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন—৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও মানুষের গরম লাগে, ৩৮ ডিগ্রিতেও গরম লাগে। কিন্তু প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যে আছে বড় রকমের পার্থক্য। প্রতি ডিগ্রিতেই পার্থক্য বোঝার দৃশ্যমান উদাহরণ আছে।

এবার কেন এত গরম পড়ল? প্রশ্ন করলে চিন্তা করেই উত্তর বের করা যায়। আবহাওয়া উত্তপ্ত হওয়ার যে কারণগুলো এখন বলা হচ্ছে, যেমন—মৌসুমি বায়ু বা তরঙ্গস্রোতের প্রভাব, এগুলো তখনো ছিল। অন্য কোনো ফ্যাক্টর যুক্ত হওয়ায় সেই সময় আবহাওয়া চরম অবস্থায় গিয়েছিল। ১৫ এপ্রিল ঢাকায় তাপমাত্রা উঠেছে ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এখানে সাধারণত এপ্রিল মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। কখনো ৩৭ থেকে ৩৮ ডিগ্রিতেও ওঠে। এর কারণ জেট স্ট্রিম নামে বড় আকারের বায়ুমণ্ডলীয় তরঙ্গস্রোত ভারতীয় উপমহাদেশে বয়ে চলা। জেট স্ট্রিম বায়ুপ্রবাহের একটি সরু ব্যান্ড। পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যায়। এই ব্যান্ডটি বাংলাদেশের ওপরে থাকায় এত গরম।

আবহাওয়ার দিক দিয়ে ভাবলে গরমকালে কোনো কোনো শহর তাপদ্বীপের মতো হয়ে যেতে পারে। তাপদ্বীপ হলো এমন এক দ্বীপ, যেখানে তাপ আটকে আছে। এই দ্বীপের কাছাকাছি গ্রামীণ এলাকার তুলনায় এখানে অনেক বেশি উষ্ণতা অনুভব করতে হয়। শহর এবং স্বল্প উন্নত গ্রামীণ এলাকার মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য তৈরি হওয়ার কারণ ভূপৃষ্ঠ কত ভালোভাবে তাপ শোষণ করে এবং ধরে রাখতে পারে, তার ওপর। শহর ঘিরে একটি বুদবুদের ছবি দিয়ে শহুরে তাপদ্বীপের অনুমান করা যায়। সূর্যের তাপ ও আলো একইভাবে শহরে ও গ্রামে পৌঁছায়। গ্রামে গেলে দেখা যায় বেশির ভাগ এলাকা গাছপালা দিয়ে ভরা। যত দূর চোখ যায় ঘাস, গাছ আর ফসলে ঢাকা কৃষিজমি। গাছপালা তাদের শিকড় দিয়ে মাটি থেকে পানি টানে। এরপর ডালপালা ও পাতায় পানি জমা করে। শেষে পাতার নিচের দিকে ছোট গর্তে পরিচালিত হয়। সেখানে তরল পানি জলীয় বাষ্পে পরিণত হয় এবং বাতাসে চলে যায়। এই প্রক্রিয়াকে ট্রান্সপিরেশন বলে। এটি প্রকৃতির এয়ার কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে।

গাছপালা কেটে ফেলা একটি বড় সমস্যা। গাছ না থাকলে ছায়া এবং বাষ্পের পরিমাণ কমে উচ্চ তাপমাত্রা নিয়ে আসতে পারে। প্রতিটি শহরেই এমন কিছু রাস্তা আছে। যে রাস্তার পাশে বা আইল্যান্ডে গাছ আছে আর যে রাস্তায় গাছ নেই, এমন রাস্তা দিয়ে এক দিন হাঁটলে স্পষ্ট পার্থক্য বোঝা যাবে। স্কুলে গরমের ছুটি বলতে একটি বিষয় ছিল। যদি পাওয়া যায়, তবে ছুটি শহরের বাইরে গাছপালাযুক্ত জায়গায় কাটানো যেতে পারে। কারণ গরমে শহুরে ফুটপাতের তুলনায় একটি ঘাসভরা মেঠো পথে হাঁটা সহজ। শ্বাস নেওয়া স্বস্তির। মানুষ গরম অনুভব করে ত্বক দিয়ে। গাছপালাযুক্ত এলাকায় থাকলে ত্বকে শীতল বোধ হবে। আর শ্বাস-প্রশ্বাসও গরম অনুভবের কারণ! গরম বায়ুতে শ্বাস নিলে বোঝা যায়।

শহরে অনেক কম গাছপালা দেখা যায়। ফুটপাত, রাস্তা আর উঁচু ভবন শহরের স্বাভাবিক দৃশ্য। এগুলো ইট, সিমেন্ট, কাচ, ইস্পাতের মতো উপকরণ দিয়ে তৈরি। সাধারণত খুব গাঢ় রঙের হয়। কালো, বাদামি আর ধূসর রং দেখা যায়। কালো বস্তু আলোকশক্তির সব তরঙ্গদৈর্ঘ্য শোষণ করে তাপে রূপান্তর করে। বিপরীতে সাদা বস্তু আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রতিফলিত করে। আলো তাপে রূপান্তরিত হয় না এবং সাদা বস্তুর তাপমাত্রা তেমন বাড়ে না। শহরের রাস্তা কালো পিচের তৈরি। ছাদগুলো ধূসর আবরণ দেওয়া। উত্তাপের বড় অংশ আসে এসব স্থাপনা থেকে। বিল্ডিংয়ের উপকরণ শহর এলাকায় তাপ আটকানোর আরেকটি কারণ। অনেক আধুনিক বিল্ডিং উপকরণের কারণে পৃষ্ঠতল থেকে পানি ইট বা সিমেন্টের প্যাঁচে পড়ে ওপর থেকেই বাষ্প হয়ে যায়। ভূপৃষ্ঠে প্রবাহিত হতে পারে না। গ্রামে উদ্ভিদের মাধ্যমে যেমন এলাকা ঠাণ্ডা হয়, শহরে বড় জলাধার তৈরি আর মাটি দিয়ে পানি প্রবাহিত হলে তাপমাত্রা কমতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সচেতনতা, জলাশয়, জলাভূমি, বনভূমির কাছাকাছি বাস করলে উত্তাপ থেকে বাঁচা যাবে। সম্ভব না হলে বেশি করে গাছ লাগানো, গাছ না কাটা আর জলাভূমি ভরাট না করাই তপ্ত পৃথিবীতে বাঁচার উপায় বলে বিবেচিত হবে।

 লেখক : প্রকৌশলী 

news24bd.tv/আইএএম