দাদি ও আমার 'সাপুড়ে' বর

অলংকরণ” কামরুল ইসলাম

কিস্তি-১৯

দাদি ও আমার 'সাপুড়ে' বর

অনলাইন ডেস্ক

আমগাছতলায় একলা একটা কলের পাশে শাড়ি দিয়ে ঘেরা একটা কাঠের চৌকি চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। চৌকির ওপর রাখা হলো দাদিকে। পাশেই রান্নাঘর। তার পাশে চালার নিচে মাটির দুটো বিশাল চুলা।

দুটোর একটিতে ৩ কেজি ভাত রান্না করা যায় এমন মাপের একটা আস্ত পাতিল চড়ে বসে আছে। তার পাছার নিচে দাও দাও করে আগুন জ্বলছে। পাশের চুলায় গরুর ভুসির পাতিল, সেটাও যেন চড়ে বসে আছে একই মুড নিয়ে। এক চুলোয় ভুসি আর অন্য চুলায় গরম পানি বসিয়ে গাছের শুকনো পাতা আর একটা করে চেলাকাঠ চুলোর মুখে গুঁজছে কেউ একজন।
সেজো চাচি?  নাকি আমার ভাবি? ঠিক বুঝতে পারছি না ধোঁয়াটা কি চুলার উপরে নাকি স্মৃতির গতরে? হবে কিছু একটা। এক পর্যায়ে দাদির লাশ গোসলের জন্য গরম পানি হয়ে গেলো।  
এখন দাদিকে গোসল করানোর পালা।  
আয়না ফুফু গোসল করাবেন। সঙ্গে আরও কে কে যেন ছিলো। আমি ছিলাম, দেখছিলাম আমার দাদিকে-- কীভাবে একজন মানুষ মুখ থাকা সত্ত্বেও আর কথা বলেন না, ছ্যাঁচনায় পেষা পান মুখে পুরে নিয়ে কেউ আর চোয়ালে নৃত্য তোলেন না,  কীভাবে নাক থাকলেও আর থেকে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন না, কীভাবে চোখ বুজে থাকতে থাকতে বলিরেখায় ডুবে যাওয়া ধূসর চোখ আর মেলে দেখেন না কিছু। সেই চোখ, নাক, কান, দাঁতবিহীন গালটাকে আয়না ফুফু এমনভাবে পরিষ্কার করছেন যেন মনে হচ্ছিলো তিনদিনের সদ্যজাতকে নাওয়াচ্ছেন তিনি।
আমার গৌরবর্ণ দাদির গায়ের রঙ বেশি পোড়া মাটির মতো কালচে-খয়েরি হয়ে গেছে। ঝুলে যাওয়া চামড়ায় যেন দাদির দেমাগ ঝুলে আছে। আমার দাদি কালো মানুষ, অসুন্দর মানুষ খুব একটা পছন্দ করতেন না। আমার বিয়ের পর আমার বরকে দেখে 'সাপুড়ে' মন্তব্য করেছিলেন, বরের গায়ের রঙ আর লম্বা চুল দেখে। আমি কী করে এমন 'কালা বিটারে'(কালো বেটা) পছন্দ করতে পারলাম! যে দাদি আমাকে নাদান শিশু বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন সেই দাদির এমন নাত-জামাই পছন্দ না হওয়াই স্বাভাবিক। দাদির সঙ্গে সারাজীবনের যতো মহব্বতের সম্পর্ক তার যেন ইতি ঘটে গেলো এই বিয়ের মধ্যে দিয়ে।
আমার দাদি ছিলেন মারাত্মক ফর্সা-পাগল নারী। এখনকার দিনে যাকে বলে 'রেসিস্ট'। দাদির এই ব্যাপারটা ভীষণ বিরক্ত লাগতো আমার। নিজের রূপের দেমাগে তার মাটিতে পা পড়তো না,কিন্তু স্যান্ডেলও যে খুব একটা পরেছেন তা নয়। দেমাগি সুন্দর নারী আবার ভীষণ মিশুক।
খালি পায়ে মাটির পথ আর দাঁত-খালি গালে চূর্ণ পান নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়তেন অজানার উদ্দেশ্যে। আব্বু বলতেন,দাদি নাকি কোনোদিন এক জায়গায় বসে রান্না শেষ করেননি। চুলায় ভাত বসিয়ে একটা চ্যালাকাঠ ধরিয়ে দিয়ে কোথায় কোথায় পাড়া বেড়াতে চলে যেতেন। আবার ভাত হয়ে গেলে এসে ঠিকই উপস্থিত হতেন। তবে আমার বুদ্ধি হবার পর থেকে দাদিকে দেখতাম সবসময় সব জায়গায় নিজের ঠাট বজায় রেখে চলতেন। কথাবার্তা এবং কাজবাজ দেখে মনে হতো বিরাট এক উড়নচণ্ডী শিশু। বিষয়-হিসেবে লবডঙ্কা, কিন্তু চাকচিক্যের জীবনের প্রতি মারাত্মক অবসেস্ট।
তবে এতো উড়নচণ্ডী হলে কি এতোগুলো ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে পারতেন? কিন্তু তাকে দেখে মনে হতো আর কি!

আরও পড়ুন:জ্বিনের বাদশাহ

দাদির সঙ্গে আমার ছেলেবেলা অনেক সুন্দর কিছু সময় কেটেছে। সাধারণত ছেলের বা মেয়ের মেয়ে সন্তানদের প্রতি মায়েরা একটু জেলাস থাকেন ভেতরে ভেতরে। বাবারা জেলাস থাকেন ছেলে বা মেয়ের ছেলে সন্তানদের প্রতি। আমার দাদিও ভীষণ জেলাস ছিলেন আমার ব্যাপারে৷ কারণ আমার বাবা আমার দাদির পাক্কা বিশ বছরের ছোট এবং প্রথম সন্তান। অনেক আরাধনার পরে আমার দাদির পেটে আমার অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান বাবা তসরিফ রাখলেন। এতো আদরের সন্তান, একে তো বৌয়ের কবলে পড়লো, তার উপর আবার নাতনিও হয়ে গেলো! এমন রূপবতী, দেমাগবাহী নারীর এসব  সহ্য হয় ? হবার কথাও নয়। তবু কীভাবে যেন আমি আমার দাদির খুব প্রিয় মানুষ হয়ে উঠি একসময়! দাদির শ্লোক, দাদির দেমাগ সত্ত্বেও পাড়াবেড়ানোর অভ্যাস, দাদির হাতে পুঁটিমাছ আর বেগুনের গা-মাখা ঝোলের স্বাদ আমাকে সবসময় আবিষ্ট করে রাখতো। ঝগড়াও হতো বিস্তর। সেটা শুধু ভালো খাওয়া নিয়ে। দাদির মধ্যে দেমাগও ছিলো দারিদ্র্যের স্মৃতিও ছিলো। আব্বুর হাতের লাগানো আমগাছ থেকে দাদিকে দেয়া সব থেকে ভালো আমগুলো দাদি বুকশেলফের সাজানো বইয়ের পেছনে রেখে দিতেন। আমি সেটা দেখে ফেলে চুরি করে দাদির লুকানো ভালো আমগুলো সাবাড় করে দিতাম। দাদি এটা টের পেয়ে আমাকে ইচ্ছামতো ঝাড়তেন।
আমাদের খুনসুটি দেখে আব্বুর মুখে জোয়ারের পানি ভরা নদীর মতো হাসির ফোয়ারা ছুটতো।
ভার্সিটিতে পড়ার সময় যখনই বাড়ি যেতাম আমার দাদি এক ছুটে গ্রামের বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত হতেন। আসলে আব্বু-আম্মু চাকরি ও সংসার নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকতেন। গ্রামে সেজো চাচা-চাচিও ব্যস্ত থাকতেন বারোমাসি ফসল আর সংসারের কাজে। বৃদ্ধ, আড্ডাবাজ, দেমাগি বুড়িকে তখন আর কে পাত্তা দেবে? ফলে আমার সঙ্গ ছিলো দাদির কাছে পরম আরাধ্য। একবার, সম্ভবত ক্লাস এসএসসি দেব এমন সময়, দাদি হিসু সামলাতে না পেরে দাঁড়িয়ে হিসু করে দিয়েছিলেন। কাজের বুয়া দেখে এমন ঝাড়ি দিলো দাদিকে। আমি উলটো বুয়াকে ঝাড়ি দিয়ে দাদিকে পরিষ্কার করে দিলাম। একদম শিশুর মতো আচরণ করেছিলো দাদি। তারপর থেকে দাদির সঙ্গে আমার একদিনের জন্যও ঝগড়া হয়নি।
দাদি আমাকে তার হাতের লাঠি ভাবতেন।
দাদির সঙ্গে থাকতে থাকতে কয়েকটি বাক্য মুখস্থ হয়ে গেছিলো তখন।
যেমন:১. 'আমার পেটের ছাও, তুমি আমারেই ধইরে খাবার চাও?'
২. 'কব্বোরে ক্যাম্বাইয়ে এলহাল্লা থাকপোরে! 
৩. 'মল্লি আমার এই ঝুলা চামড়া পঁচতি টাইম লাগবিনে। চর্ফি শুহোয় গেছে। '
৪. 'আমার বিয়ের ১১ বচ্ছর পর তোর বাপ হইছে।  হওয়ার সুমা এতো বড্ডা হইছিলো!'

আরও পড়ুন::নকিয়া-১১১০

দাদির কাছ থেকে আমি শিখেছিলাম কতো কম মসলায় সুস্বাদু রান্না করা যায়। হাতে মাখিয়ে রান্না কীভাবে সুস্বাদু হয়। আমার মাও দাদির রান্না ফলো করে রান্না করতেন সবসময়। শিখেছিলাম মৃত্যুকে নিয়ে নিত্য নতুনভাবে ভাবতে। না না, মৃত্যুকে নিয়ে ভাবতে শিখেছিলাম নাকি এটা ইনহেরিট করেছি ঠিক জানি না। আর পাড়া-বেড়ানোর অভ্যাসটাও।  

দাদিকে আমি মাত্র ২৪ বছর পেয়েছিলাম।
দাদির মৃত্যুর পরে আব্বুকে পেয়েছিলাম মাত্র ৩ বছর। দাদি একটু অসুস্থ হলেই আব্বুকে দেখতাম খুব বিচলিত হয়ে পড়তেন। আমাদেরকে বলতেন, ' আমার মা যদি মরে যায়, আমিও মরে যাবো। ' আব্বু ঠিকই দাদির মৃত্যুর মাত্র ৩ বছরের মাথায় মারা যান। দাদির মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগেই আব্বুর চোখে ছানি অপারেশন হয়। এই অপারেশন করা চোখেই আব্বুকে দেখেছি দাদির জন্য অঝোরে কাঁদছেন। আব্বুর শারীরিক গঠন ছিলো একেবারেই দাদির মতোন। খাবারের রুচিও ছিলো তার মতো।
আমি নিজেও যে এই রুচি ইনহেরিট করেছি বুঝতে পারি। আমার বিয়ের পর আমার বর আমাদের এই মিল দেখে একবার মন্তব্য করেছিলেন, 'তোমার বাবার এতো ভালো ভালো গুণ থাকতে তুমি পেয়েছো তোমার বাবার জিহ্বাটা!'
এই উক্তিটা তখন ব্যাপক হিট করেছিলো আমাদের বাড়িতে। আব্বু-আম্মু দু'জনেই খুব নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন এই ব্যাপারে যে তাঁদের কন্যাকে তাঁদের জামাতা খুব ভালোভাবেই রিড করতে পারেন।
কিন্তু, আমার দাদি আমার বরকে একদমই পছন্দ করতেন না। আমাকে দেখলেই শুধু বলতেন, 'আমার এতো সুন্দর পুতুলির মতো নাতনিডারে তুরা একটা সাপুড়ের হাতে তুলে দিলি ক্যা?'
দাদি বেঁচে থাকলে তাকে আমি ভালো করে বুঝিয়ে দিতাম যে তার নাত-জামাই শুধু সাপুড়েই নন, বিরাট বড়ো কবিরাজও। তাঁর কথার জাদুতে নারীবৃন্দের মনস্তত্ত্ব সাপের মতো প্যাঁচাতে থাকে, পুরুষকুলের প্যাঁচাতে থাকে বুদ্ধি। তিনি তাবিজও করতে পারেন, আবার তাবিজের আছরও ছোটাতে পারেন।

'স্বামী' কেমন হয় সে বিষয়ে ছোটবেলায় দাদির কাছ থেকে বহু মিথিক আলাপ শুনতাম। 'স্বামীর সোহাগ' বলে এক ব্যাপার যে আছে, তার চালচিত্র কেমন সেটা আমার মধ্যে দাদি আর তার এক বোন ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। দাদি অতোটা 'অশ্লীলভাবে' বলতেন না,  যতোটা তার বোন বলতেন। আসলে দাদিদের আমলে এইসব আলাপ ছিলো খুব স্বাভাবিক। গল্পে যেসব শব্দচয়ন ও বিষয়বস্তু থাকতো সেগুলোকে এখনকার জেন্ডার সচেতন ও তথাকথিত 'সভ্য' প্রজন্ম কানেই তুলতে পারবে না। দাদিদের বর্ণনা মতে যাকে 'স্বামীর সোহাগ' বলা হয় সেটা আমার প্রজন্ম কিছুতেই মেনে নেবে না। আসলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সব কিছুর রেওয়াজ বদলায়। আমার দাদু দাদিকে যেভাবে ভালোবাসতেন, আমার বরের ভালোবাসার ধরন সেরকম হবে না। দাম্পত্য সম্পর্কও সেরকম হবে না। তবু কোথায় যেন কী সব মিল খুঁজে পাই!
সকল দাম্পত্য সম্পর্কেরই একটি অবিচ্ছেদ্য মিল থাকে -- ঘৃণা করতে করতে ভালোবাসতে পারার মিল। তাই মাঝে মাঝে দাদির বর্ণনাগুলো আমার বরকে শুনাই আর স্মৃতিচারণার ভেতর দিয়ে দুইজনেই একটা ভিন্ন সময়ে গিয়ে ঘুরে আসি। আমার বর তাঁর দাদিকে দেখেননি কোনোদিন। তিনি নাকি ১৯৭০ সালের বন্যায় মারা যান। ফলে দাদির আদর, মহব্বতের সঙ্গে আমার বর মোটেও পরিচিত নন। এই ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট দুর্ভাগা। একজন প্রজ্ঞাবান তুখোড় বক্তার বক্তৃতা শুনে দূর থেকে ভক্ত বা সমঝদারদের ভক্তি ও শ্রদ্ধা কুড়ানো এক জিনিস, আর নিজের আপন দাদির রক্তের টান সম্বলিত আদর ভিন্ন জিনিস।
তাই আমি যখন আমার দাদির গল্প করি, খুব আগ্রহ নিয়ে শোনেন আমার বর। ভেতরে ভেতরে হয়তো বন্যায় তলিয়ে যাওয়া নিজের অদেখা দাদিকে খুব করে দেখতে চান!  কে জানে! 
এটা অবশ্য আমার মনে তৈরি হওয়া কল্পনা। তিনি স্বীকার করবেন না হয়তো।  
আমার এই দাদির মৃত্যুর খবর শুনে আমার বর আমাদের বাড়িতে যেতে রাজি হননি। ব্যাপারটা এটা নয় যে, দাদি তাঁকে পছন্দ করতেন না। তিনি তখন আমাকে যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন সেটা হলো, তিনি প্রায় কোনো মৃত্যুতেই অ্যাটেন্ড করেন না।
'প্রায় কোনো মৃত্যু' আর আমার দাদি, বাবা, ভাইয়ের মৃত্যু যে এক নয় এই যুক্তি মানবার লোক আমার বর নন। তিনি তখন জরুরি পড়াশোনা, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গ লাভে মত্ত-উদ্ধত।
দাদির মৃত্যুর খবর পেয়ে আমি আমার বরকে বললাম আমার সঙ্গে যেতে। কারণ আমার বিয়ের পর এটাই প্রথম--পরিবারে কারো মৃত্যু হলো। নববিবাহিত কোনো মেয়ে তার স্বামী ছাড়া একা এ ধরনের একটা অনুষ্ঠানে যাওয়ার রেওয়াজ যে আমাদের এই মুসলমানের বাংলায় নাই, সেটা তিনি মানেননি। ফলে আমি একাই বাড়ি গেলাম। যাওয়ার আগে শাশুড়িকে হাতে পায়ে ধরে খুব অনুরোধ করলাম তার ছেলেকে যেন যেতে বলেন, না হলে ব্যাপারটা খুব খারাপ দেখাবে। মায়ের অনুরোধ রাখলেন তিনি। সুবোধ বালকের মতো পরদিন গিয়ে উপস্থিত হলেন আমাদের বাড়িতে। দাদি তখন কবরের বিছানায় লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়েছেন।
আমি দারুণ বিস্মিত হলাম।
আমি আবারও বিস্মিত হলাম, যখন দেখলাম দাদির মৃত্যুর কিছুদিন পরেই আমার এক ননদের শাশুড়ি মারা গেলে আমার শাশুড়ি ও আমার বর দ্রুত চলে যান ননদের শ্বশুরালয়ে।
আমার তখন বয়স মাত্র ২৪। সংসারে রাজনৈতিক মার-প্যাঁচ প্রায় কিছুই শিখিনি। যা দেখতাম তার সঙ্গে নিজের চব্বিশ বছরের সামাজিক শিক্ষার প্রায় কোনো মিলই পেতাম না। শুধু কাঁদতাম আর এর-ওর-তার কাছে অভিযোগ করে বেড়াতাম।
মৃত্যু নিয়েও যে মানুষের রাজনৈতিক মন নানা কূট-খেলা খেলতে পারে, সেটা নাটক, সিনেমায় দেখেছি কিন্তু বাস্তবে অনুভব করতে পারিনি।  আমি তা মর্মে মর্মে নানাদিকের নানা ঘাত সহ্য করে টের পেয়েছি। আমার মৃত দাদি, আব্বু আর ভাইয়ার সঙ্গে আমার এখন প্রায়ই কথা হয়,জায়নামাজে বসে। বলতে বলতে কখন যে চোখটা মহাসাগরে পরিণত হয় টের পাই না। ছেলে টের পায়। আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়, চুপচাপ পাশে বসে থাকে। আমাদের কোনো কথা হয় না। ওর নীরব সহাবস্থানে ডুকরে কেঁদে উঠি।
দাদি যে মারা যাবেন তা মোটামুটিভাবে বোঝা গিয়েছিলো। স্ট্রোক করেছিলেন। তার আনারের দানার প্রতি, বড়ো মাছের পেটির প্রতি মহব্বত তখন চুকে যায়।
খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন।  
স্ট্রোক করার পর একবার দেখতে গিয়েছিলাম। দাদিকে দেখতে নির্বাক নজরুলের মতো দেখাচ্ছিলো। বয়স ৮০/৮৫ হবে। তখন অবশ্য আমার 'সাপুড়ে' বর আমার সঙ্গে যাননি। দাদি যে তাঁকে পছন্দ করেননি সেটা তাঁকে সরাসরি কেউ কোনোদিন বলেনি। আজ এই লেখাতেই বলা হলো। তিনি বুদ্ধিমান, দাদির কথায় হয়তো টের পেয়েছিলেন। যদি ধরে নিই এই দুঃখেই তিনি দাদির মৃত্যুতে আমার সঙ্গে বাড়িতে যাননি, তাহলে সেটা মোটামুটিভাবে একটা খোঁড়া যুক্তি হিসেবেই প্রমাণিত হবে। কেননা নিজের সন্তানকে নিয়ে আর একটা খোঁড়া যুক্তি দিয়ে তিনি আমার ভাইয়ার মৃত্যুতেও আমাদের বাড়িতে যাননি। আর ওই বছরগুলোতে -- দাদির মৃত্যু(২০০৯), আব্বুর মৃত্যু(২০১২), ভাইয়ার মৃত্যু(২০১৭), আমার সঙ্গে কী কী ঘটেছে সেগুলোকে কোনো বাংলা হরফে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এর জন্য ওল্ড টেস্টামেন্টের হিব্রু হরফ লাগবে।
আমার শ্বশুর বাড়ির নিভৃত রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলো তখন আমার ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ির আদি-মুখোরিত রাজনীতি।  
ওই সময়গুলোতে মনে হতো দুটো পরিবারের চারজন নারী যেন কায়মনোবাক্যে আমার মৃত্যু চাইছে!
একটি দরিদ্র পরিবারে যখন সাচ্ছন্দ্যের ছন্দ-যোজন ঘটলো তখন সে সাচ্ছন্দ্যের মধ্যে আমার মতো উটকো এক ভাগিদার কার সহ্য হবে বলুন? আপনি যতোই নিজেকে বিলান, ভালোবাসুন, এ সাচ্ছন্দ্যের ভাগ অনেকেই শেয়ার করবে না। কেউ কেউ করে হয়তো। তারা বড়োই বিরল আজকের এই সমাজের পার্সপেক্টিভে।
আর অন্যদিকে একবাপের একছেলের সমস্ত কিছু কব্জা করার মধ্যেও আমি এক উটকো আপদ হিসেবে বেঁচে রইলাম! যতোই মিলতে চাইতাম, মাইনাস ভেবে রাখা আমি কিছুতেই প্লাস হতে পারিনি কোনোদিন।
ফলে প্রাপ্ত-সম্পর্কের দুটো নতুন পরিবারে আমাকে মাইনাস করে দেবার যাবতীয় ষড়যন্ত্র কায়েম হতে লাগলো!
সংসার বিষয়টি যতোটা না সামাজিক তার থেকে অনেক অনেক বেশি স্বার্থবাদী রাজনৈতিক। মানুষ এই রাজনীতিতে জেতার জন্য ধর্ম আর সামাজিক ভাষাকে যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছে। এ লড়াইয়ে আমি সামিল হতে চাইনি কোনোদিন। ভবিষ্যতে হবো কিনা জানি না।  

আমার এইসব মনে হওয়াকে হাওয়ায় মিলিয়ে দিতেই আমি বেছে নিয়েছি লেখাপড়ার এক নিজস্ব জগত। এ জগত একান্তই আমার। আমি যতোদিন বেঁচে থাকবো, যা যা পারি লিখে যাবো।
আশা করি আমার পাঠকেরা আমার পাশে থাকবেন ।

আরও পড়ুন: "আড়ি, আড়ি, আড়ি, তার সাথে আড়ি কাল যাবো ঘর, পরশু যাবো বাড়ি"
ছোটবেলায় দাদির একটা কালো রঙের দাঁত দেখতাম যেখানে তিনি তর্জনির মাথায় রাখা চুনের একটা অংশ মাখিয়ে নিয়ে পান খেতেন। ভাবতাম পৃথিবীর সমস্ত দাদিরই বোধ হয় এরকম একটা পান-খাওয়া দাঁত থাকে। পরে কবে যেন সেটাও পড়ে যায়। পরে অবশ্য আমার এই চিন্তাটিও মাথা থেকে পড়ে যায়।
দাদির দন্ত্যবিহীন পান-খাওয়া পাতলা ঠোঁট, রূপের ঠাট, পাড়া-বেড়ানি উড়নচণ্ডী লুক আজ বড্ডো মনে পড়ে। আর সব থেকে বেশি মনে পড়ে দাদির দেয়া 'সাপুড়ে' আখ্যাটা।

news24bd.tv/ডিডি