লখনউয়ের বেগমের বদনা

আনোয়ার হোসেন মঞ্জু

লখনউয়ের বেগমের বদনা

আনোয়ার হোসেন মঞ্জু

‘পিপিং টম’পরিভাষাটি ইংলিশদের সৃষ্টি। অকারণে সৃষ্টি হয়নি এই শব্দ দুটি, এর শানে নজুলও আছে। সোজা বাংলায় ‘পিপিং টম’ বলতে ‘উঁকি মারা’ বোঝালেও ইংরেজিতে ‘পিপিং টম’ এমন কোনো ব্যক্তিকে বোঝায়, যিনি গোপনে অন্যের একান্ত বা অন্তরঙ্গ ধরনের কোনো দৃশ্য উপভোগ করেন, যা জনৈক ‘টম’ করেছিলেন। কাহিনির এই ‘টম’ কে ছিলেন এবং সকলে কেন মনে করেন যে, উক্ত ‘টম’ আড়াল থেকে নগ্ন লোকজনকে দেখা উপভোগ করতেন।

কাহিনিটি দ্বাদশ শতাব্দীর। ইংলিশ সিটি কোভেন্ট্রি’র বিপুল বিত্তবান অভিজাত আর্ল অফ মার্সিয়া, লিওফ্রিকের স্ত্রী লেডি ‘গডিভা’ (Ladz Godiva)কে ঘিরে, যিনি সিটিবাসীর ওপর তার স্বামী কর্তৃক অযৌক্তিক কর আরোপের প্রতিবাদে সম্পূর্ণ নগ্নাবস্থায় ঘোড়ার পিঠে উঠে নগরী প্রদক্ষিণ করেন।  
কাহিনীতে প্রকৃত ঘটনা হিসেবে রয়েছে যে, লেডি গডিভা নগরবাসীর পক্ষে তার স্বামীকে বলেন তাদের ওপর আরোপিত কর হ্রাস করতে। স্ত্রীর শালীনতা ও মার্জিত বৈশিষ্ট সম্পর্কে যেহেতু স্বামী লিওফ্রিক জানতেন, সেজন্য তিনি কৌতুকের সঙ্গে বলেন যে, তিনি যদি নগ্নাবস্থায় নগরীর রাস্তাগুলো প্রদক্ষিণ করতে সম্মত হন, তাহলে তিন কর হ্রাস করবেন।
স্বামীকে হতবাক করে লেডি গডিভা সম্মত হন এবং নগরবাসীর প্রতি আবেদন জানান, তিনি যখন নগরী প্রদক্ষিণ করবেন, তখন তারা যাতে তার ওপর দৃষ্টি না ফেলেন। লেডি যেহেতু নগরবাসীর সম্মানিতা ও জনপ্রিয় ছিলেন, অতএব তারা নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেদের বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ রাখে। লেডি গর্বিত ভঙ্গিতে একটি সাদা ঘোড়ার পিঠে রাস্তায় বের হন, তার ঘন দীর্ঘ চুল তার শরীরের অধিকাংশ স্পর্শকাতর অংশ আবৃত রেখেছিল। তার স্বামী নগরবাসীর কর হ্রাস করেন। পরে জানা যায় ‘টম’ নামে এক ব্যক্তি লেডি গডিভার নগ্ন দেহ দর্শনের কৌতুহল নিবারণ করতে পারেননি। তিনি তার বাড়ির কোনো ছিদ্রপথে লেডিকে দেখেন। পরিণতিতে তাকে অন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু ‘টম’ নামটি কারও দ্বারা গোপনে অন্যের একান্ত কর্মকাণ্ড দেখার সমার্থক হয়ে গেছে।  
লখনউয়ের বেগমের বদনা ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত উর্দু সাহিত্যিক এবং ১৪ খণ্ডের ‘উর্দু টু উর্দু’ অভিধানের সংকলক মুহাজ্জাব লখনউয়ি (১৯০৬-১৯৮৫) তার শহরের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্যের ওপর গভীর অধ্যয়নের জন্যও খ্যাত। একবার তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে পুরোনো লখনউয়ের বেগমদের সূক্ষ্মতা, বিনয় এবং চারিত্রিক বৈশিষ্টের একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। মুহাজ্জাব লখনউয়ি’র বর্ণনা অনুযায়ী, ‘একদিন সকালে বেগম সাহিবা দেখলেন যে, তিনি তার পায়খানায় যে বদনাটি ব্যবহার করেন, সেটি নেই। বদনা না পেয়ে তিনি অসহায়ের মতো কান্নাকাটি শুরু করেন। তার চাকরাণীরা ঘটনাটি নওয়াব সাহিবকে জানায়। নওয়াব তার প্রিয় বেগমের দুর্দশা দেখে তাকে আশ্বস্ত করেন যে, তিনি হারিয়ে যাওয়া সস্তা অ্যালুমিনিয়ামের বদনার স্থলে প্রতিস্থাপন করবেন সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা একটি রৌপ্য বদনা। কিন্তু বেগমের শঙ্কা ছিল অন্যত্র। তিনি নওয়াব সাহিবের কাছে তার উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা ব্যক্ত করেন, ‘আসলে আমি এই সামান্য ক্ষতির জন্য আমার কোনো কষ্ট নেই। আমার মধ্যে একটি ভয় কাজ করছে এবং, তা হচ্ছে, পুরোনো বদনাটি  শৈশব থেকে আমাকে নগ্ন অবস্থায় দেখে এসেছে, এখন অন্য একটি বদনা আমাকে উঁকি দিয়ে দেখবে। ’

( বানানরীতি লেখকের নিজস্ব) 

news24bd.tv/ডিডি