পরিবারে নামে-বেনামে যৌতুকের সর্বনাশা প্রথা

পরিবারে নামে-বেনামে যৌতুকের সর্বনাশা প্রথা

 মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

বিয়ে মানুষের নীতি-নৈতিকতা উন্নত করে। এর মাধ্যমে সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। ভবিষ্যৎ বংশধারা সুরক্ষা পায়। যদি এর সূচনা হয় লোভ, অশুচি, অনৈতিকতা ও অন্যায় উপার্জনের মাধ্যমে, তাহলে বিয়ের পবিত্রতা, পারস্পরিক বিশ্বাস, সহানুভূতি ও ভালোবাসা থাকে না।

পবিত্রতা, পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসাহীন বিবাহের মাধ্যমে মিলন আর ব্যভিচারের মধ্যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। বিবাহ ও বিবাহবহির্ভূত মিলনের মধ্যে তখন তফাত শুধু সামাজিক বন্ধন ও পবিত্রতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এ জন্যই ইসলাম বিবাহবহির্ভূত মিলন হারাম করে দিয়েছে। যৌতুকের বিবাহে পবিত্রতা ও বিশ্বস্ততা থাকে না।

সুতরাং ব্যভিচার যদি নিষিদ্ধ হয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়, সমাজে ঘৃণিত হয়, তাহলে যৌতুক কেন নিষিদ্ধ হবে না? সামাজিকভাবে ঘৃণিত হবে না? ব্যভিচারের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ যদি অপবিত্র হয়, ভালো কাজে ব্যয় করা নিষিদ্ধ হয়, তাহলে যৌতুকের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ কেন অপবিত্র হবে না, ভালো কাজে নিষিদ্ধ হবে না? মিশকাতুল মাসাবিহের একটি হাদিসের মর্মানুযায়ী—‘ফেরত না দেওয়ার নিয়তে কোনো অর্থপ্রাপ্তির লোভে যে ব্যক্তি কোনো নারীকে বিয়ে করে সে একজন ব্যভিচারী। ’

যৌতুকলোভীদের জন্য এর চেয়ে আর খারাপ কী উদাহরণ হতে পারে?

মানববংশ রক্ষায় স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই সমান অবদান আছে। বরং সন্তান লালন-পালনে মায়ের অবদান বেশি। সন্তান জন্মের ক্ষেত্র তৈরি হয় বিয়ে নামক একটি পবিত্র বন্ধনের মাধ্যমে। আর এই বন্ধনেরই যদি গোড়াপত্তন হয় একটি অন্যায্য অমানবিক শর্ত আরোপের মধ্য দিয়ে, তাহলে এ বন্ধন থেকে জন্ম নেওয়া সন্তান-সন্ততির ওপর যে এর খারাপ প্রভাব পড়বে তা অনস্বীকার্য। অথচ এটি কোনো আর্থিক বা বৈষয়িক জিনিস নয়। এটি বেহেশতি নিয়ামত। এই বন্ধন প্রথম অনুষ্ঠিত হয় বেহেশতে প্রথম মানব-মানবী আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-এর মধ্যে। আর এ বন্ধন ঘটিয়েছেন স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিন।

পরিবার ও সমাজে বছরের বিভিন্ন সময়ে নামে-বেনামে চলে যৌতুকের সর্বনাশা প্রথা। কখনো তা রোজার বাজার, ঈদের উপহার, ঈদের বাধ্যতামূলক দাওয়াত, মৌসুমি ফল, আকিকা অনুষ্ঠান ও চিকিৎসার নামে যৌতুক উত্তোলন করা হয়।

যৌতুক চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের চেয়েও খারাপ। চোর, ডাকাত ও ছিনতাইকারী যেমন অন্যের মাল জোর করে ছিনিয়ে আনে, যৌতুক গ্রহণকারীও তাই করে। স্বেচ্ছায় কেউ যৌতুক দেয় না। দায়ে পড়েই যৌতুক দেয়। সুতরাং চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো যৌতুক গ্রহণও হারাম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করবে না। ’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৮৮)

জন্মগতভাবে শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকে নারী ও পুরুষের গঠন-প্রকৃতি ভিন্ন। তাদের যেমন উৎপাদন ক্ষমতা বেশি, তেমনি নিজের ও স্ত্রীর নিরাপত্তা বিধানের ক্ষমতাও বেশি। তাই ইসলাম নারী অর্থাৎ স্ত্রী ও সন্তানের ভরণ-পোষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব নর তথা স্বামীর ওপর অর্পণ করেছে। আর এই কারণে মিরাস তথা উত্তরাধিকার বণ্টনের ক্ষেত্রেও মেয়ের তুলনায় ছেলের ভাগ দ্বিগুণ করা হয়েছে। এই একই কারণে স্ত্রী ও সন্তানের ভরণ-পোষণের আর্থিক সামর্থ্য অর্জন না করা পর্যন্ত বিয়ে বিলম্বিত করতে ইসলাম পুরুষকে পরামর্শ দিয়েছে। এরূপ বলা হয়নি যে আর্থিক সংগতি না থাকলে স্ত্রী বা স্ত্রীর অভিভাবক থেকে অর্থ নিয়ে বিয়ে করতে হবে। শারীরিক শক্তি অধিক উপার্জন ক্ষমতার কারণে যেখানে আল্লাহ নারীর ওপর নরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, সেখানে বিয়ের সময় নারীর কাছ থেকে নরের যৌতুক নামক অর্থ আদায় আল্লাহ প্রদত্ত নরের শ্রেষ্ঠত্বেরই অবমাননা। কোরআনের বাণী—‘পুরুষ স্ত্রীলোকের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পেয়েছে এই জন্য যে পুরুষরাই পারে নারীকে বাইরের আক্রমণ থেকে সুরক্ষা করতে। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩৪)

এই আক্রমণ শারীরিক হোক, নৈতিক হোক কিংবা আর্থিক। আর্থিক অসহায়ত্ব থেকে নারীকে রক্ষার জন্য যেখানে পুরুষকে নারীর নেতা বানানো হয়েছে, সেখানে পুরুষ কর্তৃক নারীর কাছ থেকে বিয়ের সময় যৌতুক আদায় পুরুষের জন্য সত্যি অবমাননাকর ও লজ্জাজনক কাজ।

বিয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বীয় চরিত্রকে পরিচ্ছন্ন ও কলুষমুক্ত রাখা এবং মনের প্রশান্তি লাভ। যৌতুক নামক টাকা-পয়সার বাধ্যতামূলক লেনদেন বিয়ের পবিত্র উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করে দেয়। বিয়ের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা, মায়া-মমতা, সহানুভূতি, দরদ ও সহযোগিতা সৃষ্টি হয়। আর বিয়েটাই যদি সম্পন্ন হয় যৌতুক নামক তিক্ততার মধ্য দিয়ে, তাহলে এই বিয়ে থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সহানুভূতি সৃষ্টি হতে পারে না। অথচ মহান রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ‘আল্লাহর নির্দেশনাবলির মধ্যে রয়েছে যে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গিনী, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। ’ (সুরা : রুম, আয়াত : ২১)

উক্ত আয়াতে বিয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণিত রয়েছে। আর তা হচ্ছে বিয়ের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী পরম পরিতৃপ্তি ও গভীর প্রশান্তি লাভ করে। বিয়ে যদি আর্থিক লাভ-লোকসানের বস্তুতে পরিণত হয়, তখন এ ধরনের বিয়ে থেকে অর্থ পাওয়া গেলেও এ থেকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-প্রণয়, মায়া-মমতা, দরদ-সহানুভূতির সৃষ্টি হয় না। স্বামীর মধ্যে সব সময় একটি অপরাধবোধ কাজ করে। আর স্ত্রীর মধ্যে স্বামীর প্রতি একটি ঘৃণাবোধ কাজ করে।

যৌতুক একটি গর্হিত কাজ। এর দ্বারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, যেভাবেই বিচার করা হোক না কেন, যৌতুক কারো জন্যই সুখকর নয়। এটি ধর্মীয়, অসামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দিক থেকেও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যৌতুক গ্রহণকারী সমাজ ও পরিবারের কাছে ঘৃণিত, স্ত্রীর কাছে নিন্দনীয় ও অপমানের, নীতি ও নৈতিকতাবিরোধী কাজ ও শৃঙ্খলা বিনষ্টকারী। নারী নির্যাতন, শ্রম শোষণ পৌরুষের দিক থেকে দুর্বল মনের পরিচায়ক, ব্যক্তিত্বের দিক থেকে লজ্জাজনক।

যৌতুক প্রতিরোধে সবাই যথাযথভাবে এগিয়ে আসবেন—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।


 

এই রকম আরও টপিক