শ্রমজীবী মানুষ যেভাবে আল্লাহর বন্ধুত্ব অর্জন করবে

শ্রমজীবী মানুষ যেভাবে আল্লাহর বন্ধুত্ব অর্জন করবে

 কাসেম শরীফ

শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ যাবৎ যত মত ও মতাদর্শের আবির্ভাব হয়েছে, তার মধ্যে ইসলামী শ্রমনীতিই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। এ দাবির ভিত্তি ইসলামের চিরায়ত ভারসাম্যপূর্ণ নীতি ও মধ্যপন্থা। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম মধ্যপন্থী ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অবলম্বন করেছে। শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা, মালিকের হিস্যা এবং উভয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম ভারসাম্যপূর্ণ এক নীতির অনুসরণ করেছে।

আধুনিক যুগের অন্য কোনো অর্থব্যবস্থায় যা খুঁজে পাওয়া যায় না।

ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদের সার্বভৌমত্ব ও মালিকানা আল্লাহর, আর মানুষ তার তত্ত্বাবধায়ক মাত্র। সুতরাং এখানে মালিক-শ্রমিক সবাই ভাই ভাই। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা-স্নেহ, সৌহার্দ্য ও বিশ্বস্ততায় ভরপুর।

শ্রমিক ও মালিক উভয়ের অধিকার রয়েছে নিজ নিজ প্রাপ্য বুঝে পাওয়ার। উভয়কে বলা হয়েছে নিজ নিজ কর্তব্য পালনে দায়িত্বশীল হতে। শুধু মালিক বা শুধু শ্রমিক নয়, বরং উভয়কে সুসংহত আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে।
ইসলাম শ্রমের শ্রেণিবিন্যাসকে স্বীকার করলেও মানবিক মূল্যবোধ ও মৌলিক মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সবাই সমান।

রাসুলুল্লাহ (সা.) ব্যবসা, কৃষি ও দ্বিনচর্চাকে উৎসাহিত করেছেন। আবার মর্যাদার ক্ষেত্রে সব শ্রমিককে সাধারণভাবে সমান ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘শ্রমজীবী আল্লাহর বন্ধু। ’

ইসলাম শ্রমিককে বলেছে, দক্ষ, বিশ্বস্ত ও দায়িত্ববান হতে। কোরআনে আদর্শ শ্রমিক হিসেবে হজরত মুসা (আ.)-এর বৈশিষ্ট্য এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘হে পিতা! আপনি তাকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিন। নিশ্চয়ই আপনার শ্রমিক হিসেবে সেই উত্তম, যে সামর্থ্যবান ও বিশ্বস্ত। ’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ২৬)

পরবর্তী আয়াতে নিয়োগদাতা শোয়াইব (আ.)-এর সঙ্গে নিয়োগপ্রাপ্ত মুসা (আ.)-এর মজুরি নির্ধারণের বিবরণ এসেছে। পরে বিরোধ এড়াতে উভয়ের সম্মতিতে প্রথমেই মজুরি নির্ধারণের নির্দেশ দিয়েছেন।

ইসলামী শ্রমনীতির শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বাতন্ত্র্য এখানেই যে ইসলাম মালিক ও শ্রমিকের জন্য অভিন্ন খাবার ও বস্ত্রের নির্দেশ দিয়েছে। এই নির্দেশনার আলোকে বোঝা যায়, ইসলাম একটি উচ্চ মানসিকতাসম্পন্ন শ্রমনীতির কথা বলেছে, যেখানে শ্রমিকের মানসম্মত জীবন-জীবিকা নিশ্চিত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীন করেছেন। সুতরাং যার ভাইকে তার অধীন করেছেন, সে যেন তাকে তা-ই খাওয়ায় যা সে খায়, সে কাপড় পরিধান করায় যা সে পরিধান করে। তাকে সামর্থ্যের অধিক কোনো কাজের দায়িত্ব দেবে না। যদি এমনটা করতেই হয়, তাহলে সে যেন তাকে সাহায্য করে। (বুখারি, হাদিস : ৫৬১৭)

শ্রমিকের অধিকার ও মানবিক মর্যাদা এবং মালিকের প্রাপ্য সেবা লাভের এমন ভারসাম্যপূর্ণ শ্রমনীতি একমাত্র ইসলামই দিয়েছে। এই হাদিসে শ্রমিক ও মালিক পরস্পরকে ভাই সম্বোধন করে মূলত ইসলাম শ্রেণিবৈষম্যের বিলোপ করেছে। তবে শ্রেণিবৈষম্য বিলোপের নামে মালিক ও উদ্যোক্তার মেধা, শ্রম ও সামাজিক মর্যাদাকে অস্বীকার করেনি ইসলাম। চাপিয়ে দেয়নি নিপীড়নমূলক কোনো ব্যবস্থা, বরং তার ভেতর মানবিক মূল্যবোধ ও শ্রমিকের প্রতি মমতা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তাআলা জীবনোপকরণে তোমাদের কাউকে কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। যাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে তারা তাদের অধীন দাস-দাসীদের নিজেদের জীবনোপকরণ থেকে এমন কিছু দেয় না, যাতে তারা তাদের সমান হয়ে যায়। তবে কি তারা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করে?’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৭১)

উল্লিখিত আয়াতে যেমন মালিকের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করা হয়েছে, তেমনি তার অহংবোধ ও শ্রেণিবৈষম্যের ধারণার নিন্দা করা হয়েছে। পাশাপাশি সম্পদের প্রকৃত মালিকানা এবং তা অর্জন করতে পারা যে একান্তই আল্লাহর অনুগ্রহ—সেটাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেন সে মানবিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে শ্রমিকের মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণে মনোযোগী হয়। মূলকথা হলো, শ্রম ও সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনে ভারসাম্যপূর্ণ ও সহনশীল এই পদ্ধতিই ইসলামী শ্রমনীতির শ্রেষ্ঠত্ব।