রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে রাশিয়া

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পঁচিশে বৈশাখ , রবীন্দ্রজয়ন্তী

রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে রাশিয়া

ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য্য

কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও? এই লেখা যাঁর কলম থেকে নিঃসৃত হয়েছিল সেই কালজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজতান্ত্রিক ছিলেন কিনা সে বিষয়ে বিভিন্ন মহলে বিভ্রান্তি আছে। তাঁর লেখার মধ্যে অনেক সময় বলশেভিক কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আপত্তি থাকায় অনেকেই তাঁকে সাম্যবাদ বিরোধী বলে অভিহিত করেছেন । এটা ঠিক যে প্রথাগত ধারনায় তিনি হয়তো সমাজতন্ত্রী ছিলেন না, কিন্তু সমাজতন্ত্রের পথ ধরেই যে ইতিহাসের রথচক্র আগামী দিনে ধাবিত হবে সে কথা তিনি জীবনের শেষ লগ্নে এসে উপলব্ধি করেছিলেন এবং তা রাশিয়ার চিঠি  বইয়ে পরিষ্কার ভাবে বলেও গেছেন। মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন ধরে সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখের কথা, তাঁদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণ বঞ্চনার কথা বলে গেছেন তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে।

ধীরে ধীরে বিশ্বের এবং স্বদেশের আর্থ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সেটাকেই সুসংহত করে গড়ে তুলেছিল গণ সংগ্রাম এবং অর্থনৈতিক সাম্যের ভিত্তিতে সামাজিক পুনর্গঠন । রাশিয়ার চিঠি এবং তারও আগে রক্ত করবী তে সেটাই অভিব্যক্ত হয়েছে । ফলত যথার্থ অর্থে সমাজতন্ত্রী না হয়েও তিনি তার দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। মনে রাখতে হবে আশি বছরের দীর্ঘ জীবনে রবীন্দ্রনাথের সমাজ ভাবনার নানা বিবর্তন ঘটেছে।
জমিদার সন্তান হওয়ার সুবাদে জমিদারীর কাজ দেখাশোনার কাজে তিনি বহু মানুষের সান্নিধ্যে এসেছেন। শিলাইদহ সাজাদপুরে চাষী , জমিদার, মহাজন এককথায় গ্রাম বাংলার আর্থ সামাজিক মঞ্চের সবধরনের কুশীলবদেরই তিনি চিনেছেন। এভাবেই তাঁর মধ্যে সমাজ চেতনার উন্মেষ ঘটেছে। শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ কোনো যোগাযোগ হয়নি ঠিকই কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু জমিদারতন্ত্র এবং সঞ্জায়মান কলকারখানাতন্ত্রের অবিরাম সংঘাতের সূত্র ধরেই যে শ্রমজীবী মানুষের শ্রেনী অবস্থান নিশ্চিত হয় সেটা তিনি আক্ষরিক অর্থে সমাজতান্ত্রিক না হয়েও বুঝতে পেরেছিলেন । ‘গল্প গুচ্ছের’, ‘হালদার গোষ্ঠী’ ,‘মেঘ ও রৌদ্র ’, দান প্রতিদান প্রভৃতি গল্পে যেভাবে জমিদারি অবস্থার অন্ধকার দিক গুলি চিহ্নিত হয়েছে তা একান্তভাবে স্মরণযোগ্য। জমিদারি প্রথার যেটা মূল চরিত্র প্রজা শোষণ তা রবীন্দ্রনাথ ব্যঙ্গাত্মক ভাবে রূপায়িত করেছেন দুই বিঘা জমি থেকে শেষ আমলের ‘মাধো’ কবিতায়। সাধারণ কৃষক সন্তান মাধো জমিদারের পীড়নের প্রতিবাদ করে গ্রাম থেকে উৎখাত হয়ে শহরে গিয়ে শ্রমিকে পরিণত হয়েছে , শ্রমিক আন্দোলনের শরিক হয়েছে। ‘পথে বাহির হল ওরা ভরসা বুকে আঁটি সেটাই তো এক সংগ্রামী মজদুরের আসল পরিচয়।  
কবি সে কথা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন । আসলে এই কবিতা যখন তিনি লিখেছিলেন তখন তাঁর মননের একটি সামগ্রিক পালাবদল ঘটে গেছে, তখন তিনি গণদেবতার পূজারী । ওরা কাজ করে কবিতায় শ্রমজীবী মানুষের অস্তিত্বের মশাল কে তিনি অনির্বাণ রেখেছেন। সেই উপলব্ধিই ‘মুক্ত ধারা’তে মৃদু এবং রক্ত করবী ‘তে প্রবল ভাবে ব্যক্ত হয়েছে। লেলিন যে কথা বলেছিলেন সাম্রাজ্যবাদ হল ধনতন্ত্রের চূড়ান্ত পর্ব সেবিষয়ে কবির অবদান কতটা ছিল জানি না কিন্তু যেভাবে তিনি ‘মুক্ত ধারা’ ও রক্তকরবী র ক্রমবিন্যাস করেছেন তাতে কিন্তু এই সমাজতান্ত্রিক সত্যটি সুষ্ঠু ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । দুটি নাটকেই তিনি তুলে ধরেছেন শোষক বনাম শোষিতের সংঘাত । কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো রবীন্দ্রনাথ হয়তো পড়েছিলেন বা পড়েননি । কিন্তু মাক্সীয় সমাজবীক্ষণের বিশ্লেষণে শোষণভিত্তিক ধনতন্ত্রী আর্থ সামাজিক কাঠামো যে কি চেহারা নিয়ে দেখা দেয় ,কবি সেটা খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন নানা চরিত্রের সংলাপে। শেষ পর্বে এসে রবীন্দ্রনাথ বলশেভিক বিপ্লবের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হওয়া একটি তরুণ দম্পতির কথা সস্নেহে রূপায়িত করেছেন শ্যামলী কাব্য গ্রন্থের ‘অমৃত’কবিতায়। ১৮৩৫ সালে রাশিয়া থেকে জার্মানি গিয়ে হলস্টেইনের তরুণ কমিউনিস্ট কর্মীদের ক্যাম্পে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাদের চোখে যে ভবিষ্যতের আলোকদ্যুতি দেখে এসেছিলেন সেটাই হয়তো শ্যামলীর ওই কবিতার মহীভূষণের চশমার আড়ালে তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন । প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের কাছে তিনি শেষ শয্যায় শুয়েও জানতে চেয়েছিলেন রুশ জার্মান যুদ্ধের অবস্থার কথা । রুশ সেনারা জার্মান বাহিনীকে রুখে দিতে পেরেছিলেন শুনে তিনি আনন্দে বিহ্বল হয়ে উঠেছিলেন সমাজতন্ত্রর সৈনিক দের চূড়ান্ত বিজয়ের আকাঙ্খায়। কাজেই কবি যে মনে প্রাণে সমাজতন্ত্র কেই সমর্থন করেছেন সেকথা বলার অবকাশ রাখে না।
news24bd.tv/ডিডি