নিরিবিলি 

অলংকরণ: গিয়াস

নিরিবিলি 

জয়দীপ চক্রবর্তী 

বাড়িটা কেনা থেকেই সোমনাথ বলছিল, ‘তুই লেখক মানুষ। দিন কয়েক আমার নতুন কেনা বাগানবাড়িটায় কাটিয়ে আসতে পারিস। নিরিবিলি জায়গা। প্রাকৃতিক শোভাও মন্দ নয়।

গিরিধারি আছে। বলে দিলেই হবে। তোফা খাতির-যত্ন করবে। হুড়হুড় করে লেখা বেরিয়ে আসবে দেখবি।
’  আমি অবিশ্যি প্রথমটা ওর কথায় তেমন গা করিনি। নতুন জায়গা। তায় গঞ্জ এলাকা। গিরিধারি লোকটাই বা কেমন হবে জানি না। কিছু লোক আছে যাদের কৌতূহল বড্ড বেশি। নতুন লোক দেখলেই ইনিয়ে বিনিয়ে এমন বকর বকর করতে শুরু করে যে মাথা খারাপ হবার যোগাড়। গিরিধারি অমন লোক হলে আমার সুবিধে তো হবেই না, বরং কাজকর্ম সব চৌপাট হয়ে যাবে। কিন্তু হঠাৎ করেই লেখার চাপটা এমন মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছলো যে চট করে আমার সোমনাথের কথাই মনে পড়ল। বাড়িতে থেকে সংসারের দায় সামলে সম্পাদকের হাতে সময়ে লেখাগুলো দেওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বুঝতে পারলাম, মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকা গল্পগুলোকে ঠিক মতন শব্দে নামাতে গেলে সত্যিই আমার কটা দিন খানিক নিভৃতি দরকার। কথাটা সোমনাথের কাছে পাড়তেই সে একগাল হাসল। বলল, ‘তখনই বলেছিলাম। পাত্তা দিসনি। জানি তো কাঙালের কথা বাসি না হলে খাটে না। ’     খুব ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়েও জয়াতলা পৌঁছতে বেশ বেলাই হয়ে গেল। অনেকটা পথ। বাসে ট্রেনে ভিড় ঠেলাটা বেশ ধকলই হয়ে গেল। তবু বেশ অনেকখানি এলাকার ওপরে পাঁচিল দেওয়া বাংলোবাড়িটার সাদা পাথরের ফলকের ওপরে ‘নিরিবিলি’ লেখা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মন ভালো হয়ে গেল। শহরাঞ্চলে এতখানি জায়গার ওপরে বাড়ি কল্পনাই করা যায় না। বাড়িটার আশপাশ ফাঁকা। গাছপালা, ধানজমি। মূল রাস্তা থেকে যে মোরাম বিছনো পথটা ‘নিরিবিলি’-র গেট পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে তার দু’ দিকে সারি দেওয়া বাবলা গাছ। দূরে একটা সরু নদী। নদী শীর্ণ হলেও তাতে ভালোই জল রয়েছে। একজন লোক খালি গায়ে সেই খালে খেপলা জালে মাছ ধরছিল।      আমি ‘নিরিবিলি’-র সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একজন মাঝবয়েসি লোক প্রায় দৌড়ে এল বড় রাস্তার দিক থেকে। আমার সামনে একটু ঝুঁকে দু হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে বলল, ‘আপনি জয়ন্তবাবু তো?’ ‘হ্যাঁ’, ওপর নীচে মাথা নাড়লাম আমি, ‘তুমি গিরিধারি?’ ‘আজ্ঞে হ্যাঁ বাবু’, হাফ পাঞ্জাবির বুকপকেট থেকে চাবি বের করে গেটের তালা খুলতে খুলতে বলল গিরিধারি, ‘আমি এখানে দাঁড়িয়েই ছিলুম সকাল থেকে। এই একটু আগে বড় রাস্তার ধারের দোকানটায় চা খেতে গেসলুম। তাই আপনাকে একটু দাঁড়াতে হল। ’ ‘আরে না না। আমি সবেই এসে পৌঁছলাম’, বলতে বলতে ভেতরে ঢুকলাম আমি। সুন্দর বাড়ি। ছিমছাম। সামনে ছোট্ট উঠোন। সেখানে বেশ কিছু ফুলগাছ। বাড়ির পিছন দিকটায় বেশ অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাগান। অনেক গাছ। ফলের, ফুলের। একটা পুকুরও আছে, শান বাঁধানো। পাশে একটা দোলনা। বাড়িটা যিনি বানিয়েছিলেন, বেশ শৌখিন মানুষ ছিলেন, সন্দেহ নেই।  গিরিধারি ঘরের দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘আসুন। ’ বাড়িটার একতলায় গোটা দুই শোবার ঘর, ডাইনিং, কিচেন টয়লেট। ডাইনিং থেকেই দোতলায় ওঠার সিঁড়ি উঠে গেছে। সিঁড়ির মুখে কোলাপসিবল গেট। তালা দেওয়া। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘গিরিধারি, ওপরে কটা ঘর আছে?’ গিরিধারি একবার আমার চোখের দিকে তাকিয়েই নিজের চোখ নামিয়ে নিল। তারপর খুব মৃদু স্বরে বলল, ‘ওপরে শোবার ঘর নেই কত্তা। একটাই বড় হল। সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম। ব্যাস। এ বাড়ির আগের মালিক, যিনি এ বাড়ি বানিয়েছিলেন, এখানে থাকলে ওই বড় হলঘরটায় কাজ করতেন। ’ ‘কাজ মানে? কী কাজ করতেন তিনি?’ আমি কৌতূহলী হয়ে বলি। ‘তিনি ছবি আঁকতেন’, গিরিধারি মুখ মাটির দিকে নামিয়ে রেখে বলল, ‘ওখানে সে সব সরঞ্জাম এখনও রাখা আছে। আগের মতো করেই। ওগুলো নাড়ানো হয়নি। ‘কেন?’ ‘প্রয়োজনও তো পড়েনি বাবু’, গিরধারি যেন খানিক বিরক্ত হল, ‘আসুন আপনার থাকার ঘরটা দেখে নিন। ’   একটা ঘর গিরিধারি আমার জন্যে পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছে। ধপধপে বিছানা। টেবিল চেয়ার... ঘরে দু’খানা মস্ত জানালা। গিরিধারি আগে থেকেই জানলাদুটো খুলে রেখেছে। সেই খোলা জানলা দিয়ে ঝকঝকে আলো এসে পড়েছে ঘরের মেঝের ওপরে। এই ঘরটা বাড়ির পিছন দিকে। ঘরের লাগোয়া একটা বারান্দা আছে। সেই বারান্দায় দাঁড়ালে শান-বাঁধানো পুকুরটা দেখা যায়। পুকুরের পাশেই দোলনাটা। আমি দোলনাটার দিকে চাইতেই কেন যেন মনে হল দুলে উঠল ওটা। আমার অকারণ গা শির শির করে উঠল। কী যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে দোলনাটার দিকে চাইলেই। আমি দ্রুত চোখ ফিরিয়ে পাঁচিলের ওদিকে তাকালাম। দূরে নদীটা দেখা যাচ্ছে। গাছপালার আড়ালে, আবছা।  গিরিধারি বলল, ‘আপনি হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্রাম নিন। আমি আপনার জলখাবার নিয়ে আসছি। ’    ২    ‘নিরিবিলি’ আমার কাজের পক্ষে খুবই আদর্শ সন্দেহ নেই। গিরিধারিকেও যত দেখছি আশ্চর্য হচ্ছি। লোকটা  কর্তব্যপরায়ন এবং মিতভাষী। প্রয়োজনের বাইরে একটিও বাড়তি কথা বলে না সে। এমনকি অনেক সময় আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও সে নিজেই দেখেছি প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়।  সোমনাথ ব্যবসায়ী মানুষ। সে এই বাড়িটা কিনেছিল ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে। তার এক ব্যাংক ম্যানেজার বন্ধুর কাছ থেকে এই বাড়ির সন্ধান এসেছিল তার কাছে। অনেক সময় ব্যাংকলোন শোধ করতে না পারার জন্য ব্যাংক উপভোক্তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। সেই সম্পত্তি নিলামে চড়িয়ে ব্যাংক তার টাকা তুলে নেয়। ঠিকঠাক খোঁজ রাখতে পারলে বাজারের থেকে অনেকই কম দামে সেইসব সম্পত্তি কিনে নেওয়া যায়। ‘নিরিবিলি’ সোমনাথের হাতে এসেছিল সেই পথেই।

লোকেদের কাছে আউটস্কার্টের এই ধরনের বাংলোবাড়ির চাহিদা আছে। এঁদের অনেকেই ছুটি কাটাতে বা আমোদ আহ্লাদের জন্যে শহরের বাইরে এমন বাংলো টাংলো কিনে রাখেন। সোমনাথের লক্ষ্য ছিল, অল্প পয়সায় বাড়িটা কিনে নিয়ে তেমনই কোনো শাঁসালো পার্টির কাছে চড়া দামে বিক্রি করে দেবার। বাড়িটা সে নিলামে অবিশ্বাস্য কম দামে পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বছর ঘুরতে চললেও ‘নিরিবিলি’ কেনার মতো খরিদ্দার এখনও সে যোগাড় করতে পারেনি। গিরিধারি আগের মালিকের আমল থেকেই এই বাড়ি দেখাশোনার কাজ করত। সোমনাথ তাকেই আবার বহাল করেছে সম্পত্তি হাতে পাওয়ার পরে। মাঝেমধ্যে কয়েকবার জয়াতলায় গেছে সে, কিন্তু রাত কাটায়নি একবারও, এবং যেটা আশ্চর্যের, গিরিধারি একবারও তাকে ‘নিরিবিলি’-তে থেকে যাওয়ার জন্যে অনুরোধও জানায়নি।     সোমনাথের এই সব কথাই আগে শুনেছিলাম, কিন্তু কোনো প্রশ্ন জাগেনি আমার মনে। কে জানে, ‘নিরিবিলি’ নিয়ে তেমন আগ্রহ ছিল না বলেই হয়ত প্রশ্ন তৈরি হয়নি। কিন্তু এখানে আসার পর এক দু দিন কাটতে না কাটতেই আমার মনে হচ্ছে, ‘নিরিবিলি’-তে কী একটা যেন গোলমাল আছে। গিরিধারিও ক্রমশই কেমন যেন রহস্যময় হয়ে উঠছিল আমার কাছে। সন্ধের পরে কিছুতেই সে নিরিবিলি-র ধার মাড়াতে রাজি নয়। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির চাবিও হাজার ইচ্ছে প্রকাশ করার পরেও আমার হাতে দিতে সে নাচার। আর সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের, তার আগের মালিকের বিষয়ে সে একেবারে স্পিকটি নট। হাজার চেষ্টা করেও না পেরেছি তাকে দিয়ে সেই শিল্পী মানুষটির কথা কিছু বলাতে, না সে খুলে দিয়েছে দোতলায় সেই মানুষটির স্টাডি। আমি ওপরের ঘরটা দেখবার ইচ্ছে প্রকাশ করলেই সে কেবল ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থেকেছে আমার দিকে। তারপর খুব নিস্পৃহ গলায় দুটিমাত্র বাক্য আউড়ে গেছে মুখস্ত বুলির মতো, ‘থাক না বাবু, কটা দিনের জন্যে এসে ঠাঁই নিয়েছেন এই বাড়িতে। এ বাড়ির সব রহস্য নাই বা খুঁড়ে দেখলেন...’  আমার কৌতূহল তাতে আরও বেরেছে, কিন্তু গিরিধারিকে আর খোসামোদ করতে ইচ্ছে করেনি।    ‘নিরিবিলি’-তে আমার কাজ ভালোই এগোচ্ছিল। এখানে অফুরন্ত সময়। বিরক্ত করারও কেউ নেই। মাঝেমধ্যে শুধু বাড়ি এবং সোমনাথের সঙ্গে ফোনে কিছু কথাবার্তা। একলা জীবন কাটাতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠছি এখন। সকাল থেকে লেখা। দুপুরে খেয়ে দেয়ে ভাতঘুম। প্রথম দু একদিন বিকেলে বড় রাস্তার দিকে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম খানিক। কিন্তু রাস্তায় উঠতেই বটগাছের নীচের চা দোকানে বসা লোকজন এমন অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত, যে অস্বস্তিতে বৈকালিক ভ্রমণ এখন বাড়ির পিছনের বাগানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছি। একদিন বিকেলে শানের ঘাটে গিয়ে বসেছিলাম খানিক। পুকুরের জলে আমার ঠিক পিছনে এক মহিলার মুখ দেখতে পেয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম কেউ কোত্থাও নেই! তাড়াতাড়ি পুকুরঘাট থেকে উঠে এসে দেখলাম পাশের দোলনাটা একা একাই দোল খাচ্ছে। ঘরে ফিরে চুপ করে বসে রইলাম খানিকক্ষণ। সন্ধের মুখে গিরিধারি রাতের খাবার দিতে এলে তাকে ঘটনাটার কথা জানাতে সেই একই রকম ঠান্ডা বরফের মতো মুখ করে সে শুধু বলল, ‘ও কিছু নয়। আপনার দেখার ভুল। ’  ঠিক পাঁচ দিনের মাথায় সন্ধেবেলা খাবার দেবার সময় গিরিধারি গম্ভীর মুখে বলল, ‘বাবু, কাল আপনি ফিরে যান। ’ ‘কেন?’ আমি চমকে উঠে বললাম। ‘কাল সন্ধেবেলা পূর্ণিমা পড়ে যাচ্ছে। কাল সমস্ত নিশি জুড়ে ‘নিরিবিলি’-র বাগান, মাঠ, পুকুর, দোলনারা পূর্ণিমা তিথি পাবে বাবু...’ ‘তাতে কী হয়েছে গিরিধারি?’ আমি তার কথার মাঝখানেই বলে উঠি খানিক বিরক্ত হয়েই। আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে গিরিধারি মাটির দিকে মুখ করে আবার বলল, ‘কাল আপনি ফিরে যান বাবু। ’ গিরিধারির ওই শীতল ঘ্যানঘ্যানানিটা আমার কাছে ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠছিল। একটু রুক্ষ স্বরেই বললাম, ‘দেখ গিরিধারি, আমি তো এখানে বেড়াতে আসিনি। এসেছি একটা কাজ নিয়ে। কাজটা শেষ না হলে আমার এখানে আসাটা ফালতু সময় নষ্ট হয়ে যাবে। আর আমার কাজটা তিথি নক্ষত্র মেনে শুরু বা শেষ করা যায় না...’ গিরিধারিকে খুবই চিন্তিত দেখাল। স্বগতোক্তির ঢঙে সে বলে চলল, ‘কেন যে বুঝতে চাইছেন না বাবু, আমার ক্ষমতাও যে সীমিত। পূর্ণিমা রাতে যে শক্তি নিয়ে জেগে উঠবেন তিনি, তা কি আমার শক্তি দিয়ে ঠেকাতে পারব?’ ‘কার শক্তি? কে জেগে উঠবে গিরিধারি?’ আমি ধমকে উঠলাম, ‘তুমি কি আমাকে ইচ্ছে করে ভয় দেখাতে চাইছ নাকি?’ ‘আজ্ঞে না বাবু’, গিরিধারি দরজার দিকে পা বাড়ালো, ‘আমি আপনাকে বার বার করে সাবধান কত্তে চাইছি বাবু...’ রাতে আমার ভালো ঘুম হল না। অদ্ভুত একটা উদ্বেগ। গিরিধারি কম কথা বলে। তার আচরণেও খানিক অস্বাভাবিকতা আছে ঠিকই, কিন্তু মানুষটাকে আমার খারাপ বলে মনে হয়নি একবারও। সে কেন তাহলে বার বার আমাকে চলে যেতে বলছে? কী আড়াল করতে চাইছে সে আমার কাছ থেকে?     ৩ দুপুরে খাবার দিতে দিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল গিরিধারি, ‘বাবু তাহলে আমার কথা শুনলেন না। থেকেই গেলেন শেষ পর্যন্ত?’ ‘হুঁ’, মাথা নাড়লাম আমি, ‘আর দিন দুই লাগবে লেখাটা শেষ করতে। তার আগে এখান থেকে আমার নড়ার উপায় নেই হে গিরিধারি। ’ ‘আজ সন্ধের পরে আর বাইরে বেরোবেন না। নিজের কাজের মধ্যেই আটকে রাখবেন নিজেকে’ গিরিধারি প্রায় অনুনয়ের সুরে বলল, ‘যেই আসুক, যেই ডাকুক, দরজা খুলে বাইরে বেরোবেন না, তাকেও ডাকবেন না ঘরের ভেতরে। ’ ‘কে আসবে আমার কাছে গিরিধারি? কেই বা বাইরে ডাকতে পারে আমায়?’ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করি। ‘যদি কেউ আসে’, আবার চোখ মাটির দিকে নামিয়ে নেয় গিরিধারি, ‘যদি ডাকে কেউ বাইরে...’    বিকেল থেকে একটা বিচ্ছিরি অস্বস্তি পেয়ে বসল আমায়। সন্ধের পরে সে অস্বস্তি বাড়ল বই কমল না। ‘নিরিবিলি’ নামের বাড়িটাকে আজকেই প্রথম সত্যি সত্যিই যেন বড্ড অন্যরকমের নিরিবিলি মনে হতে লাগল। প্রাণপণে নিজের লেখায় মনোনিবেশ করার চেষ্টা করলাম। বুঝতে পারলাম, মন বসছে না। হঠাৎই একটা হাল্কা খুট করে আওয়াজ হতে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম সিঁড়ির কোলাপসিবল গেটের তালাটা খোলা। অবাক হয়ে গেলাম। কে খুলল তালাটা? নাকি গিরিধারি ভুল করে তালাটা খুলেই রেখে গেছে আজ? ওপরের স্টাডি আমাকে যেন অসীম কৌতূহলে টানছিল। পায়ে পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকলাম আমি।
ঘরে আলো জ্বলছে। উজ্জ্বল হলদেটে আলো। ঘরের অগোছালো আসবাব চোখে পড়ছে। ছড়ানো ছিটনো রং, তুলি, প্যালেট। একটা ইজিচেয়ার। ঘরের ঠিক মাঝখানে কাঠের লম্বা স্ট্যান্ডের ওপরে ক্যানভাস। একটা অসমাপ্ত ছবি, এক নারীর। কে আঁকছে এখানে এই ছবি? অবাক লাগল। আর কেই বা এখানে এমন করে আলো জ্বালিয়ে রেখে গেল কে জানে! কী যে ঘটছে আজ। শরীর জুড়ে একটা অন্যরকমের শিহরণ টের পেলাম আমি। এই প্রথম মনে হল, গিরিধারির কথা শুনে আজ দুপুরে এখান থেকে চলে গেলেই বোধহয় ভালো হত। পায়ে পায়ে সেই ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি।     এমন জীবন্ত ছবি আগে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। ছবির নারীর দিকে সরাসরি তাকাতে অস্বস্তি হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে ছবির মধ্যে থেকে সেই নারীও যেন অপলকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সেই দৃষ্টিতে এক রহস্যময় কৌতুক। আমি চেষ্টা করেও চোখ ফেরাতে পারছি না সেই ছবির দিক থেকে। ছবিটা যেন প্রবলভাবে আমাকে টানছে। আমি তাকিয়ে রইলাম ছবির দিকে। হঠাৎই মনে হল, ছবির মুখ যেন বদলে যাচ্ছে। যে নারীর মুখে ছিল কৌতুক, সেই মুখই ক্রমশ যেন যন্ত্রণা আর ক্রোধে পূর্ণ হয়ে উঠছে। তার ঠোঁটের কোণে যে আলগা হাসিটা লেগে ছিল, সেটাও মুছে গেছে এখন। একটু ফাঁক হয়ে আছে ঠোঁটদুটো। ঠোঁটের কষ বেয়ে লাল রং গড়িয়ে নেমেছে চিবুকের ওপরে। আমি হাত বাড়িয়ে সেই লাল রং স্পর্শ করতেই চমকে উঠলাম। চটচটে রংটা রক্তই। তাজা রক্ত। সেই রক্ত আরও, আরও বেরিয়ে আসছে ছবির ঈষৎ হাঁ মুখের মধ্যে থেকে। একটা আঁশটে গন্ধ বেরোচ্ছে ছবিটা থেকে।  আমি ভীষণ ভয় পেয়ে দুদ্দাড় করে নেমে এলাম সিঁড়ি দিয়ে। বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে। বমি পাচ্ছে আমার। ঘরের দরজা খুলে বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম বুক ভরে তাজা বাতাস নেবার জন্যে। বাইরে বাগান, পুকুর, শানের ঘাট, দোলনা সব চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে তখন। বাগানের গাছ থেকে বিচ্ছিরি শব্দ করে একটা পাখি ডাকছে। কুকুর কেঁদে উঠল নদীর দিক থেকে। ঠিক তখনই দেখতে পেলাম এক যুবতী সেই চাঁদের আলোর মধ্যে প্রায় মিশে গিয়ে বসে আছে দোলনার ওপরে। তার দিকে চোখ পড়তেই আমায় তিনি হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। গিরিধারি চলে যাওয়ার সময় বারবার বারণ করেছিল আমাকে। হাতজোড় করে অনুরোধ করেছিল, যেই ডাকুক, আমি যেন বাইরে না বেরোই। তবু বেরিয়ে পড়লাম। সেই জ্যোৎস্নায় ওই রূপসীর ডাক উপেক্ষা করার শক্তি আমার ছিল না। প্রায় সম্মোহিতের মতো এগিয়ে চললাম আমি তার দিকে। সে খিল খিল করে হাসছিল। হাসতে হাসতে এগিয়ে যাচ্ছিল পুকুর ঘাটের দিকে। একটুও হাওয়া নেই, তবু তার শাড়ির আঁচল উড়ছে। উড়ছে তার মাথার খোলা চুল। পুকুরের জলের কাছে নেমে গিয়ে সে হাত বাড়ালো আমার দিকে। বলল, ‘এসো। ’ ‘কোথায়?’ যেন স্বপ্নের মধ্যে থেকে বললাম আমি। ‘ওই যে ওইখানে’, বলেই আমার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিল সে। টাল সামলাতে না পেরে আমি জলের মধ্যে পড়লাম। সেই নারীর শরীর আমাকে জড়িয়ে রেখেছে। আমার মনে পড়ল, আমি সাঁতার কাটতে পারি না। সে তখনও খিল খিল করে হাসছে। বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে পড়ল, এই নারীকে আমি চিনি। একেই এক্ষুনি দেখে এসেছি ‘নিরিবিলি’-র দোতলার স্টুডিওতে। ক্যানভাসে... তার দু’ হাত সাপের মতো পেঁচিয়ে ধরছে আমায়। সমস্ত শরীর দিয়ে সে যেন পিষে ফেলতে চাইছে আমাকে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ঠিক তখনই অনেক দূর থেকে কে যেন আমার নাম ধরে চিৎকার করে উঠল, ‘জয়ন্ত, জয়ন্ত...’ মেয়েটির ভারী বুক চেপে বসেছে আমার বুকের ওপর। তার ঠোঁট নেমে আসছে আমার ঠোঁটের ওপরে। সেই ঠোঁট থেকে রক্তের গন্ধ এসে মিশে যাচ্ছে পুকুরের জলে। আমি চোখ খুলে রাখতে পারছি না আর। ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি। নিজের মধ্যে। পুকুরের জলের মধ্যে।  তলিয়ে যেতে যেতেই শুনতে পেলাম পুকুরের জলে তীব্র আলোড়ন উঠেছে। কারা যেন আমার শরীর ধরে টান মারছে বিপ্রতীপে। দু’ দিকের সেই টান সইতে সইতে চেতনা হারিয়ে গেল আমার...    
আমার মুখের ওপরে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল। আরও অনেকগুলো উদ্বিগ্ন মুখ আমার চারপাশ ঘিরে রয়েছে। আমি একটু ধাতস্থ হয়েছি দেখে সোমনাথ হাসল, ‘ঠিক আছিস এখন?’ ‘হুঁ’, মাথা নাড়লাম আমি। ‘কলকাতা ফিরতে হবে তো। অতখানি পথ। ধকল নিতে পারবি তো, নাকি...’ ‘পারব, পারব’, সোমনাথকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলাম না আমি, ‘নিরিবিলিতে আর এক মুহূর্তও থাকতে রাজি নই আমি। ’ ‘কিন্তু এই ভূতুড়ে বাড়িতে আপনি একলা একলা কী কত্তি এসছিলেন বাবু?’ সোমনাথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন জিজ্ঞেস করল আমায়। ‘ভূতুড়ে বাড়ি?’ সোমনাথ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। ‘আপনি কিছু জানেন না?’ ‘না তো?’ ‘আপনি কেনার আগে এই বাড়িটা ছেল এক আর্টিস্ট বাবুর। বাবুটা ভালো ছেল না, জানেন তো?’ ‘কেন?’ ‘লোকটার চরিত্তিরের দোষ ছেল। একেকবার একেক মেয়েমানুষ নে উঠত এ বাড়িতে। মদ খেত, ফূর্তি করত, আর ছবি আঁকত তাদের। তা সেইরকম এক মেয়েমানুষরেই এক পূর্ণিমার রাতে গলা টিপে মেরে ওই পুকুরে ডুইবে দে গেসল সেই বাবু। দু তিনদিন পরে সেই লাশ ভেসে উঠেছিল। ফুলে ঢোল। তবুও বোঝা যায়, কী রূপ ছেল বাবু সেই মেয়েটার...’ আমি চমকে উঠলাম। আমার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়েও সামলে নিলাম নিজেকে। কী লাভ! আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মধ্যে থেকেই আর একজন বলে উঠল, ‘একদম ঠিক সময়ে আপনি এসেছিলেন দাদা। আমরা তো জানতেই পারতাম না কিছু...’ ‘এঁরা?’ আমি ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম। ‘নিরিবিলি’-র আশেপাশেই থাকেন সব। গিরিধারির ফোন পেয়ে ছুটে এসে এদের সাহায্যেই তো...’ ‘কোন গিরিধারি?’ এবারে আমি নই, আমার চারদিকে ভিড় করে থাকা লোকগুলোই বলে উঠল, ‘এই ভূতুড়ে বাড়ির কেয়ারটেকার?’ ‘হ্যাঁ’, মাথা নাড়ল সোমনাথ। ‘তা কী করে হবে বাবু?’ প্রবল বেগে মাথা নাড়তে লাগল ওরা, ‘আজ প্রায় দিন পনের হল, গিরিধারি করোনায় মরেছে বাবু। আমরা তার দেহ দেখতেও পাইনি। সরকারি বাবুরাই ক্যানিং-এর কোভিড শ্মশানে পুইড়ে ছাই করে দে গেছে তাকে...’ ‘হতেই পারে না’, সোমনাথ প্রতিবাদ করে উঠল, ‘এই তো আমার ফোনের কললিস্টে গিরিধারির নাম রয়েছে। আজ দুপুরেই কথা হল তার সঙ্গে। বলল, “শিগগির আসুন বাবু। আপনার বন্ধুর বড় বেপদ। ” তাছাড়া জয়ন্ত এখানে আসার আগেও...’ বলতে বলতেই নিজের ফোন অন করল সোমনাথ। তারপর আপন মনে বিড়বিড় করতে লাগল, ‘কী আশ্চর্য, কী আশ্চর্য!’ ‘কী হল?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। ‘গিরিধারির কল রেকর্ড, এমনকি তার ফোন নম্বরটাও উড়ে গেছে আমার মোবাইল থেকে...’     

news24bd.tv/ডিডি   
 

এই রকম আরও টপিক