নাকবা দিবস: ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণে ফিলিস্তিনিদের জীবন

সংগৃহীত ছবি

নাকবা দিবস: ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণে ফিলিস্তিনিদের জীবন

অনলাইন ডেস্ক

আজ ১৫ মে, নাকবা বা মহাবিপর্যয় দিবস। বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনিরা আজকের দিনে নাকবা দিবস পালন করেন। ৭৬ বছর আগে ফিলিস্তিনেদের ওপর নেমে আসা মহাবিপর্যয় ও তাঁদের ঘর হারানোর দিন আজ। সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা।

সেই নির্যাতন-দখলদারত্ব আজও তাড়া করছে তাদের।

প্রতিবছর ১৫ মে ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা দিবস’ পালন করেন। এই নাকবা দিবসের উৎপত্তি ১৯৪৮ সালের ১৫ মে। ইহুদিবাদী মিলিশিয়ারা এদিন ফিলিস্তিনে জাতিগত নির্মূল অভিযান শুরু করে।

এর আগে ১৪ মে ইসরায়েল নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে।

তখন ওই এলাকা ছিল ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে। ইসরায়েলি বাহিনী বেশির ভাগ আরবকে তাদের এলাকা থেকে বহিষ্কার করে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করে। ইহুদিবাদী আধাসামরিক বাহিনী এবং ইসরাইলের সেনাবাহিনী এদিন নিজ ভূমি থেকে ৭ লাখ ৫০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির শিকড় উপড়ে ফেলে। হত্যা করা হয় অনেক ফিলিস্তিনিকে।

৫৩০ গ্রাম এবং শহরকে পুরোপুরি ধ্বংস করা হয় ইসরায়েল রাষ্ট্র তৈরির জন্য। এ সময় অনেক আরব পালিয়ে যান। ১৯৪৮-১৯৪৯ এই দুই বছরের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় প্রচুর ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে আবারও যুদ্ধ হয়। তখন জর্দান নদীর পশ্চিম তীর ও গাজা ভূখণ্ড থেকে আরো হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে।

নাকবার পর থেকে এই ৭৬ বছর ধরে ফিলিস্তিনিদের জীবনকে ইসরায়েলিরা নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। কোন পরিষেবাগুলো ফিলিস্তিনিরা ব্যবহার করতে পারবে, কোথায় কোথায় ভ্রমণ করতে পারবে, কী পরিমাণ সম্পদ তারা রাখতে পারবে এবং কোথায় তাদের নিজস্ব বাড়ি তৈরি করতে পারবে, তা সবই ইসরায়েল নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। আলজাজিরা পাঠকদের জন্য তাদের প্রতিবেদনে ইসরায়েলি দখলদারির অধীনে ফিলিস্তিনিদের কিছু দৈনন্দিন সংগ্রামের কথা জানিয়েছে। তা এখানে তুলে ধরা হলো।

১. ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ

গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনি এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরে ও পূর্ব জেরুজালেমে বসবাসকারীদের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। ইসরায়েল মূলত এই অঞ্চলে ফিলিস্তিনিদের চলাচল করতে দেয় না। ১৯৯৫ সালে দখলকৃত পশ্চিম তীরকে অসলো চুক্তির অংশ হিসেবে এ, বি এবং সি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছিল।

সি এলাকায় পশ্চিম তীরের ৬০ শতাংশ এবং প্রায় তিন লাখ ফিলিস্তিনির বাসস্থান। এলাকাটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করার কথা ছিল। কিন্তু ইসরায়েল এখনো এ এলাকা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। ২৯০টিরও বেশি অবৈধ ইহুদি বসতি এবং ফাঁড়ি তৈরি করা হয়েছে সেখানে। প্রায় সাত লাখ বসতি স্থাপনকারী বাস করে পশ্চিম তীরে। আন্তর্জাতিক আইনে ইসরায়েলি বসতি অবৈধ।

২. বাড়ি তৈরির অনুমতি

ফিলিস্তিনি হওয়ার কারণে বাড়ি তৈরির জন্য ইসরায়েলের কাছ থেকে অনুমতি পাওয়া যায় না। তখন অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে অনেক ফিলিস্তিনি অনুমতি ছাড়াই বাড়ি তৈরি করতে বাধ্য হন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে ৬২ বছর বয়সী ফাখরি আবু দিয়াবের বাড়ি ইসরায়েলি বুলডোজার গুঁড়িয়ে দেয়। তিনি আলজাজিরাকে বলেছেন, ‘আমার সব স্মৃতি সেই বাড়িকে ঘিরে ছিল। ’

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ সাধারণত ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের তাদের নিজস্ব বাড়ি ভেঙে ফেলার বিনিময়ে টাকা দেয়। তবে আবু দিয়াব তার স্মৃতিময় বাড়ি ভেঙে ফেলতে চাননি। ২০০৯ সাল থেকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে অন্তত ১০ হাজার ৭০০টি ফিলিস্তিনি মালিকানাধীন অবকাঠামো ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়া ১৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জাতিসংঘ বলেছে।

৩. মানব সম্পদ নিয়ন্ত্রণ

প্রতিদিন ভোরের আগে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শ্রমিক তাদের কাজে বের হন। কিন্তু ইসরায়েলি সামরিক চেকপয়েন্টগুলোর মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়। জনাকীর্ণ চেকপয়েন্টগুলো পার করার জন্য খাঁচাসদৃশ একটি গলিতে বসে অপেক্ষা করতে হয়।

ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের আন্দোলন এবং সম্পদের ওপর ব্যাপক বিধি-নিষেধ বসিয়েছে। এ ছাড়া ফিলিস্তিনিদের বেকারত্বের হার বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ স্থানে নিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ফিলিস্তিনি কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের কারণে ফিলিস্তিনজুড়ে প্রায় পাঁচ লাখ সাত হাজার ফিলিস্তিনি চাকরি হারিয়েছেন। আইএলও বলেছে, যদি গাজা যুদ্ধ জুন পর্যন্ত চলতে থাকে, তবে ফিলিস্তিনে বেকারত্ব ৪৫ শতাংশের ওপরে পৌঁছবে। যা গত বছরের একই সময়ে ২৫ শতাংশ ছিল।

৪. আর্থিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ

ফিলিস্তিনের আর্থিক সম্পদের ওপর ইসরায়েলের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীরের কিছু অংশ তত্ত্বাবধানকারী প্যালেস্টাইন অথরিটির (পিএ) হয়ে প্রতি মাসে প্রায় ১৮৮ মিলিয়ন ডলার কর সংগ্রহ করে। যা পিএ-এর মোট রাজস্বের ৬৪ শতাংশ। পিএ-এর  ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করছে ইসরায়েল। ফলে দখলকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজায় কর্মরত আনুমানিক এক লাখ ৫০ হাজার কর্মচারীর বেতন প্রদানে সমস্যার মুখে পড়ছে পিএ।  

৫. বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ

১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েল ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন দখল করে এবং তিন লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করেছিল। তখন আরব বিশ্বের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। ফিলিস্তিনিরা আমদানি ও রপ্তানি করতে পারে এমন পণ্যের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল। ২০০১ সালে ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ গাজার রাফাহতে ইয়াসির আরাফাত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ধ্বংস করে দেয়। বিমানবন্দরটি এই অঞ্চলের একমাত্র ফিলিস্তিনি পরিচালিত বিমানবন্দর ছিল।

ফিলিস্তিনের সীমানা এবং সম্পদের ওপর ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞার কারণে বাণিজ্যে ঘাটতি রয়েছে। ইসরায়েলি অর্থনীতির ওপর নির্ভরের অর্থ রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ ইসরায়েলে চলে যাওয়া।

৬. প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ

ইসরায়েল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) সরঞ্জামের আমদানি সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। ইসরায়েল যখন উচ্চগতির ৫জি মোবাইল ইন্টারনেট চালু করছে, অন্যদিকে ফিলিস্তিনি নেটওয়ার্ক অপারেটরদের শুধু অধিকৃত পশ্চিম তীরে (২০১৮ সাল থেকে) ৩জি এবং গাজায় ২জি ইন্টারনেট ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা ফিলিস্তিনের প্রযুক্তি খাতকে থামিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া ইসরায়েলি নেটওয়ার্কগুলো অনলাইনে ফিলিস্তিনি বিষয়বস্তু নিরীক্ষণ এবং সেন্সর করতে পারে।

৮. অবকাঠামো নিয়ন্ত্রণ

দখলকৃত পশ্চিম তীরের প্রধান ভূগর্ভস্থ জলাশয়সহ এই অঞ্চলের বেশির ভাগ পানিসম্পদ ইসরায়েল নিয়ন্ত্রণ করে। অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা প্রায়ই এর ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিদিন মাথাপিছু ১০০ লিটার নিরাপদ পানি ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছে। ২০২৩ সালে ইসরায়েলিরা গড়ে প্রতিদিন ২৪৭ লিটার পানি পেয়েছে, কিন্তু অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং গাজায় ফিলিস্তিনিরা পান ৮২ লিটার পানি।

৮. সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ন্ত্রণ

ইসরায়েলি দখলদারত্বে ফিলিস্তিনের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ক্রমাগত হুমকির মুখে পড়েছে। ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের বোমাবর্ষণে জাদুঘর, গ্রন্থাগার, মসজিদসহ ২০০টিরও বেশি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্থান ধ্বংস হয়েছে। ইসরায়েল গাজার প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩৯০টিরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনের দৈনন্দিন জীবন ইসরায়েলি দখলদারির অধীনে খুব সীমিত হয়ে গেছে। এই নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। জাতিসংঘের পশ্চিম এশিয়ার অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনের অর্থনীতিকে তাদের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছে। ফিলিস্তিনিরা বলছেন, ইসরায়েলের নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে, এ ব্যবস্থার অর্থ ‘নাকবা’ সত্যিই শেষ হয়নি।  

news24bd.tv/DHL