শেখ হাসিনা জানালেন দেশে ফেরার অজানা গল্প 

রাসেলকে কোলে নিয়ে শেখ হাসিনা

শেখ হাসিনা জানালেন দেশে ফেরার অজানা গল্প 

দেবদুলাল মুন্না

শেখ হাসিনা বললেন , “ আমাকে রাত্রে হুমায়ুন সাহেব আলাদা করে ডেকে নিলেন, তুমি একটু আসো, উনার ড্রয়িং রুমে উনি এবং উনার স্ত্রী বসা। তখন উনি বললেন, দেখ অনেক চেষ্টা করছি খোঁজ করতে, যতদূর খবর পাচ্ছি, কেউ বেঁচে নাই। শেখ হাসিনা সাক্ষাৎকারে আরো বলেন, যখন শুনলাম, সত্যি কথা কি, এ কথা শোনার পর বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার শরীরের সমস্ত রক্ত হিমশীতল হয়ে গেছিল, মনে হচ্ছে পড়ে যাব।

হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনেক সান্ত্বনা দিলেন। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর স্ত্রীও তখন তাঁদের জন্য অনেক করেছিলেন, তিনি তাঁদেরকে জার্মানির Karlsruhe শহরে গাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন। যাওয়ার সময় ১০০০ জার্মান মুদ্রা তাঁদের হাতে তুলে দিলেন যাতে হাতে কিছু টাকা-পয়সা থাকে। শুধু তাই নয় গরম কাপড় ভরে একটা স্যুটকেসও দিলেন যেন ঠান্ডায় কাজে লাগে ”।

তিনি বললেন, “সেসময় জার্মান সরকার তাঁদেরকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে চেয়েছিল, ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর রাষ্ট্রদূতকে আমাদের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করতে বললেন। রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে চেয়ে যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো তাঁর রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে যোগাযোগ করলেন। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন ম্যাসেজ পাঠালেন যে ভারতে যাওয়ার তাঁদের সব ব্যবস্থা করা হয়েছে, আমরা ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ”
 ২৪ আগস্ট সকাল ৯টা। অতি গোপনে ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তা তাদের ফ্রাংকফুর্ট বিমানবন্দর নিয়ে যান। বিমান যাত্রায় নিজেদের যতোটা আড়াল রাখা যায় সেভাবেই থাকলেন। এক রাষ্ট্রনায়কের মেয়েরা যেন বিরাট অপরাধী ব্যাপারটা এরকম।  ভারতীয় বিমানে ২৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ৮টায় দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে গিয়ে নামেন।  
শুরু হয় শেখ হাসিনার ভারতে নির্বাসিত জীবন। ভারতে আসার পরে বোন আর স্বামী-সন্তানসহ শেখ হাসিনাকে দিল্লীর লাজপাত নগরের ৫৬ রিং রোডে একটি ছোট বাসায় থাকতে দেয়া হয়। সেটাও যেন বেশ আড়ালে। যদিও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভাল ছিল। ওটি ছিল সেফ হোম । তখনও শেখ হাসিনা মনে করতেন, হয়তো মা আর রাসেলকে ওরা মারেনি। কিন্তু ৪ঠা সেপ্টেম্বর ছিল এক ভয়ংকর খবর শোনার দিন।
দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসবভনে তাদের নৈশভোজের দাওয়াত। রাত ৮টার দিকে পৌঁছে গেলেন। কিছুক্ষণ পর  প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এসে হাসিনার পাশে বসেন। হাসিনার হাত আলতো করে ধরেন এরপর এক কর্মকর্তাকে বলেন, ১৫ই আগস্ট হত্যাকান্ডের সম্পূর্ণ ঘটনা জানাতে। দুই বোন শুনছেন। পিনপতন নীরবতা। সেই কর্মকর্তা সব কিছু বলার মধ্যে এটাও জানালেন যে বেগম ফজিলাতুন্নেসা ও রাসেলও জীবিত নেই। সেসময় হাসিনা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন । ইন্দিরা গান্ধী তাকে জড়িয়ে ধরেন। এসময় ইন্দিরা গান্ধী ও ভালবাসা সম্পর্কে বলতে গিয়ে  শেখ হাসিনা বললেন, আমরা যখন কথা বলছিলাম, আমার দিকে ইন্দিরা গান্ধী তাকিয়ে বললেন, “তুমি কিছু খেয়েছো? তুমি কি ওমলেট খাবে? টোস্ট খাবে? চা খাবে? তিনি উঠে গিয়ে কাউকে বললেন, সেই ওমলেট, সেই টোস্ট আর নিজে কাপে চা ঢেলে উনি দিলেন। তুমি কিছু খাও, তোমার মুখটা খুব শুকনা, তুমি কিছু খাওনি। আসলে এই স্নেহ ও ভালোবাসাটা এতো খোলাভাবে তিনি ব্যবহার করলেন, এটা ভোলা যায় না, এটা মনে লাগে। ”
শেখ হাসিনা আরো বললেন “সত্যি কথা কি ঐ সময় সব হারাবার পর ওনার সামনে যেয়ে ওইটুকু অনুভূতি মনে হচ্ছিলো যে, না আমাদের জন্য কেউ আছে। শোকে মুহ্যমান দুই বোনের দিনগুলো দিল্লিতে ছোট একটা বাসার দুই রুমের মধ্যে কেটেছে অনেক কষ্ট আর যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে। ”
শেখ রেহানা বললেন, আল্লাহর এটা রহমত দুই বোনকে পাগল বানিয়ে রাস্তায় ফেলেনি। আপা কান্না করে এক পাশে, আমি কান্না করি অন্য পাশের্। আর একটা কখনও বলিনি, এখন ৪০ বছর হয়ে গেছে এখন বলা যায়, আমাদের দিল্লি থাকাকালীন সময় আমাদের নামও পরিবর্তন করতে হয়েছিল, মি. তালুকদার, মিসেস তালুকদার, মিস তালুকদার, আশপাশে যেন কেউ না জানে। এটা কি ব্যাপার, দেশ ছাড়া, ঘর ছাড়া, মা-বাপ ছাড়া, নামও বদলাব, থাকব না এখানে, দরকার নেই। তখন উপায়ও তো নাই। দিল্লিতে জননেত্রী শেখ হাসিনা সারাক্ষণ এক উদ্বেগের মধ্যে থাকতেন, দেশে কি হচ্ছে, কি হবে। ”
শেখ রেহানা আরও বললেন, “আপা ( শেখ হাসিনা) লেখতেন বসে বসে আজকে চিনি কতটুকু, বিস্কুট কতটুকু, সুজি কতটুকু, ওর পার্শ্বে আমার লেখা যে-আল্লাহ তুমি আমাদের কেন বাঁচিয়ে রেখেছ জানি না, কিন্তু ঐ খুনিদের ধরব, বিচার করব ইনশা আল্লাহ, তারিখ দিয়ে লেখা। ”
১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে শেখ রেহানা দিল্লি থেকে লন্ডনে পাড়ি জমান।
৭৭ এর জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে লন্ডনের কিলবার্নে শেখ রেহানার বিয়ে হয়, পাত্র লন্ডনপ্রবাসী শফিক সিদ্দিকের সঙ্গে। কিন্তু সে বিয়েতে শেখ হাসিনা তাঁর পরিবার নিয়ে অংশ নিতে পারেননি কেবল টিকেটের টাকার অভাবে। ২টি সন্তান নিয়ে টিকেট কেটে লন্ডনে যাওয়ার মতো টাকা তাঁর ছিল না।
১৯৮০ সালে, ভারতের দিল্লিতে শেখ হাসিনার বাড়িতে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা যান দেখা করতে। আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক কাবুল যাওয়ার সময় এবং সেখান থেকে ফেরার সময় তাঁদের সঙ্গে দেখা করেন। আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রহমান, আব্দুস সামাদ আজাদ, তৎকালীন যুবলীগ নেতা আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী দিল্লিতে যান। তাদের সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিতে রাজি করানো। তারা হাসিনাকে ক্রমাগত বোঝাতে লাগলেন, তার কেন দেশে ফেরা উচিত, এ মুহূর্তে এবং দলের ঐক্য বজায় রাখতে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতির পদ গ্রহণের অনুরোধ জানান। শেখ হাসিনা বলতেন, আমি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে, এটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় গৌরব। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। ১৯৮১ সালের ১৪-১৬ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার ঐতিহাসিক ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনে আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্তটি নেয় যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। দিল্লিতে থাকা অবস্থায় তিনি খবর পান, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তাঁকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছে। এর এক সপ্তাহ পরে আওয়ামী লীগের সেই সময়ের শীর্ষ নেতারা দিল্লি যান। আব্দুল মালেক উকিল, ড. কামাল হোসেন, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ আজাদ, এম কোরবান আলী, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, স্বামী গোলাম আকবার চৌধুরীসহ বেগম সাজেদা চৌধুরী, আমির হোসেন আমু, বেগম আইভি রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ১৯৮১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে দিল্লি পৌঁছান। শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কয়েকটি বৈঠকও করেন তাঁরা। এরপর ড. কামাল হোসেন ও সাজেদা চৌধুরী ছাড়া সবাই ঢাকায় ফিরে যান।
কামাল হেসেন ও সাজেদা চৌধুরীর ওপর দায়িত্ব ছিল তাঁরা শেখ হাসিনার ঢাকা ফেরার তারিখ চূড়ান্ত করবেন।
আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার। সেসময় দিল্লিতে থাকাকালে নাজিমউদ্দিন আউলিয়ার দরবারে যাওয়ার একটি ঘটনাও শেখ হাসিনার মনে দাগ কাটে যা তাঁকে দেশে ফিরতে সাহস যুগিয়েছিল। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দুই বোন নাজিমউদ্দিন আউলিয়ার দরগায় যান। তারা পরিচয় গোপন রেখেছিলেন। হঠাৎ এক খাদেম এসে একটা খাতা তাদের সামনে ধরলেন সেখানে দুই বোন দেখলেন, তাঁদের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৬ সালের ৯ই এপ্রিল এই দরগায় গিয়েছিলেন। আর তারা দুই বোন যাওয়ার তারিখটাও ছিল ১৯৮১ সালের ৯ই এপ্রিল।  
শেখ হাসিনা বললেন,“ সত্যি কথা বলতে কি একটা সাহস আমার মনে আসলো, আমাকে যেতে হবে, বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে হবে। এই বার্তাটাই মনে হয় পাচ্ছি। ”
অবশেষে এলো সেই দিন,  ১৭ই মে, ১৯৮১। দিনটি ছিলো রোববার, ঝড়-বৃষ্টির এক দিন। আকাশ কালো। তাদের দুই বোনের মনেও যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
 আওয়ামী লীগের দুই নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ আর কোরবান আলীকে সঙ্গে নিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা রওনা দেন ঢাকায়। সেদিন বিকেল সাড়ে ৪টায় ভারতীয় এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমানে তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে  ঢাকার তেজগাঁওস্থ কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেন। সেদিন সকল বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিল লাখ লাখ জনতা। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনাকে একনজর দেখার জন্য ঢাকায় মানুষের ঢল নেমেছিলো। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শেরেবাংলা নগর পরিণত হয়েছিলো জনসমুদ্রে। ফার্মগেট থেকে কুর্মিটোলা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রাফিক বন্ধ ছিল প্রায় ছ’ঘণ্টা। ঢাকা বিমানবন্দরে তিনি বিমান থেকে নামার পর আকাশ বাতাস শ্লোগানের ঝড় ওঠে ‘হাসিনা তোমার ভয় নাই, আমরা আছি লাখো ভাই’।  
দেশের মাটিতে পা রাখতেই এ দৃশ্য দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শেখ হাসিনা। তিনি বললেন, ‘যেদিন আমি বাংলাদেশ ছেড়ে যাচ্ছিলাম, সেদিন আমার সবাই ছিলো। আমার মা-বাবা, আমার ভাইয়েরা, ছোট্ট রাসেল সবাই বিদায় জানাতে এয়ারপোর্টে এসেছিলো। আজকে আমি যখন ফিরে এসেছি, হাজার হাজার মানুষ আমাকে দেখতে এসেছেন, স্বাগত জানাতে এসেছেন, কিন্তু আমার সেই মানুষগুলো আর নেই। তারা চিরতরে চলে গেছেন। ’
তিনি বললেন, “বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই। ”

বিমানবন্দর থেকে শেখ হাসিনাকে নিয়ে যাওয়া হয় মানিক মিয়া এভিনিউয়ে, সেখানে লাখো জনতার উপস্থিতি। সমাবেশ হবে। শেখ হাসিনা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। ’
১৯৮১ সালের ১৭ই মে  নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে স্বদেশে মাটিতে পা রাখেন শেখ হাসিনা এভাবেই।

(সূত্র :Hasina: A Daughters Tale’চলচ্চিত্র ) 
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর ১৯৮১ সালের ১৭ মে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলার মাটিতে ফিরে আসেন। ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস আগামীকাল শুক্রবার ( ১৭ মে) ।  


news24bd.tv/ডিডি