মানুর ঝাবরাচাচা ও একটা দেশি মুরগির গল্প

অলংকরণ: মৃনাল

গল্প

মানুর ঝাবরাচাচা ও একটা দেশি মুরগির গল্প

নীহারুল ইসলাম

যদিও এই গল্প ঝাবরাচাচাকে নিয়ে। কিংবা বলা ভাল এটা একান্তভাবে মানুর ঝাবরাচাচার গল্প। যার আসল নাম গিয়াসুদ্দিন সেখ। কিন্তু সেই নাম কবে কোথায় হারিয়ে গিয়ে কীভাবে শুধু ‘ঝাবরা’ নামটিই প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়, যারা তাকে জন্ম থেকে চেনে কেউ-ই মনে করতে পারে না।

তবে অনেকের ধারণা ঝাবরার বউ মানে শাকিরাবিবির কারণেই ওই নামটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তাহলে ব্যাপারটা একটু খুলে বলা যাক। পণ্ডিতবাড়িতে কাজের লোক অনেক। অন্দরমহলের দু-তিনজন মেয়ে বাদ দিলে খেত-খামার, আগানবাগান দেখার জন্য বাঁধা মোট পাঁচজন লোক আছে।
মাহিন্দার রব্বানকে ধরলে সাড়ে পাঁচজন। তা বাদেও ক্ষ্যাপা, আইনাল, লতিবরা তো আছেই সময়-অসময়ের জন্য। যার্বেশ আর জয়নাল মাঠঘাট সামলায়। নেসের আর ঝাবরা আগানবাগান। আর রব্বান গরু চরানো থেকে মাঠঘাটে মুনিষপাইঠের নাস্তা পৌঁছে দেওয়া বাদেও সবার সঙ্গে যোগসূত্র বজায় রেখে চলে। আর একজন আছেন, জামসেদ মামু। মুরুব্বি মানুষ। তিনি পণ্ডিতসাহেবের অবর্তমানে পণ্ডিতসাহেবের ঘরগেরস্থালির অন্দরবাহিরের সব জায়গায় মাতব্বরি করে বেড়ান। আগেই বলেছি, এই গল্প একান্তভাবে মানুর ঝাবরাচাচার গল্প। ঝাবরাচাচা এমনিতে খুব ভালমানুষ। দোষ বলতে মানুষটা একটু নেশাভান করে। বিড়ি তো খায়-ই, তা বাদেও তাড়িতে তার খুব আসক্তি। শীতকাল হলে খেজুরের তাড়ি। আর গ্রীষ্মকাল হলে তালের তাড়ি। তার কথা, ‘‘তাড়িতেখালি নেশা হয় না বাপ, প্যাট ভরে খিদাও মরে। ’’
বাগানে আম-জাম-লিচু-কাঁঠাল ছাড়াও প্রচুর তালগাছ আর খেজুরগাছ আছে। সেসবের তদারকি করে ঝাবরা নিজেই। তাই তার তাড়ির অভাব হয় না। তাড়ি খেয়ে কখন বাগানের কোথায় কোন জঙ্গলে পড়ে থাকে, বাড়ির কথা তার মনে থাকে না। শাকিরাবিবি তাকে খুঁজতে এসে ‘‘ঝাবরা–- ঝাবরা’’ বলে হাঁক ছাড়ে। আর যাকে দেখতে পায় তাকেই জিজ্ঞেস করে, ‘‘তোরা হামার ঝাবরাকে দেখ্যাছিস ব্যাটা?’’ কেউ দেখে থাকলে জায়গা বাতলে দেয়। না দেখে থাকলে শাকিরাবিবির সঙ্গে তাকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু শাকিরাবিবি কেন যে তার স্বামীকে ‘ঝাবরা’ ডাকে, সবার আজও অজানা। যাইহোক, পণ্ডিতসাহেবের বড় ছেলে রফি একটু রোমান্টিক কিসিমের। সে কখনওই তাদের জোতসম্পত্তি নিয়ে আগ্রহ দেখায় না। সে থাকে নিজের স্কুল আর নিজের পড়াশুনা নিয়ে। দ্বিতীয় ছেলে সফির বড় চাকরি। তাকে বাইরে বাইরে থাকতে হয়। তৃতীয় ছেলে মফি অসুস্থ। তার ঠাঁই কখনও বাড়িতে তো কখনও হাসপাতালে। ছোটটা রবি, কলকাতায় থেকে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন নিয়ে পড়াশুনা করছে। এবার তার ফাইনাল ইয়ার। পণ্ডিতসাহেব নিজেও ক্যানসারে আক্রান্ত। নিয়ম করে তাকে কলকাতার হাসপাতালে কেমো নিতে যেতে হয়। পণ্ডিতবাড়ির এ হেন পরিস্থিতিতে স্বভাবতই আমবাগানের দেখাশুনার দায়িত্ব এসে পড়ে পণ্ডিতসাহেবের বড় পোতা মানে রফির বড়ছেলে মানুর ওপর। মানু স্কুলে পড়ে। ক্লাস নাইনের ছাত্র সে। এখন স্কুলে গরমের ছুটি চলছে। তাহলে তার বাগান দেখতে অসুবিধা কোথায়! বাগানে বসেই তো সে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারবে। না, মানুর কোনও অসুবিধা হয় না। বরং এমন গুরুদায়িত্ব পেয়ে সে খুব খুশি হয়। তাছাড়া মাথার ওপর তো নেসেরচাচা আর ঝাবরাচাচারা রয়েছেই।
পাকা আম পেড়ে পণ্ডিতবাড়িতে পাঠানো। দুপুরের পর কাঁচা আম পেড়ে ঝুড়িবন্দি করে রাখা। সেই ঝুড়িবন্দি আম পরের দিন ভোর ভোর গরুগাড়ি করে বাজারে নিয়ে যাবে জয়নালচাচা আর যার্বেশচাচা। তাহলে তার অত চিন্তা কীসের? কোনও চিন্তা করে না মানু, নিশ্চিন্ত মনে সে বাগানের দায়িত্ব নেয়। এমনিতে সারাদিন বাগানে লোকের অভাব থাকে না। আম পাড়া। সেই আম ভ্যাটপিঠুলি পাতা মুড়ে ঝুড়ি বন্দি করা। সেই ঝুড়ি আবার গোরুগাড়িতে তুলে ত্রিপল জড়িয়ে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা। এই বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে কখন ঝড়বৃষ্টি আসে তার ঠিক নেই। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই যে যার বাড়ি ফিরে যায়। ঝাবরাচাচার সঙ্গে শুধু মানু বাগানেই পড়ে থাকে। বাড়ি থেকে তাদের জন্য তিন বেলার খাবার আসে। বাগানের কুঁড়েঘরে বাঁশের মাচায় মানুর ঘুমোতে কষ্ট হবে বলে পণ্ডিতসাহেব বাড়ি থেকে একটি চৌকি পাঠিয়েছেন। সেই চৌকিতে মানু সন্ধেবেলা লণ্ঠনের আলোয় পড়তে বসে। গরমের ছুটি শেষ হলেই হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষা। তবু সে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক পড়ে না, তার আব্বার সংগ্রহ থেকে লুকিয়ে নিয়ে আসা গল্প-উপন্যাস পড়ে। গল্প-উপন্যাস পড়তে তার খুব ভাল লাগে। সেদিন মানু একটা ভূতের গল্প পড়ছিল। ভূতের গল্প সে আগেও পড়েছে। কিন্তু হঠাৎ সেদিন ভূতের গল্প পড়তে পড়তে তার গা ছমছম করে উঠল। তার অতিপরিচিত বাগানটাকেই কেমন ভূতুড়ে মনে হল। শুধু তাই না, তাদের এই বিশাল বাগানের উত্তর-পূর্ব কোণে যে দরগাতলার অবস্থান, সেকথাও মনে পড়ে গেল তার। যেখানকার সেই শতাব্দী প্রাচীন বটগাছের নিচের জঙ্গলে নাকি বাস করে এক খতরনক গোদানা। রব্বানের মুখে প্রথম যার গল্প শুনেছিল সে।
মানু বেশ ভয় পেল। ভয় পেয়ে সে কুঁড়েঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। দেখল দূরে একটু ফাঁকা মতো জায়গায় বসে আছে তার ঝাবরাচাচা। তখনও তাড়ি গিলে চলেছে। চারপাশটা কেমন ঝুম মেরে আছে। দূরে দূরে অন্যদের বাগানের আলো ডালপালার দোলানির ফাঁকফোকর বেয়ে এসে কখনও কখনও মানুর চোখেও দোলা দিয়ে যাচ্ছে। আর আমকুড়ানির দল তো আছেই। ‘‘বৃক্ষ ফল তার থাকে গাছ হয় যার পতন হলে সেই ফল যে পায় তার। ’’ জামসেদ মামুর এই আপ্তবাক্য মেনে তাদের হাতে দুলছে এক অদ্ভুত কৌশলে তৈরি মাটির হাঁড়িতে বসানো কুপির আশ্চর্য এক আলোর প্রদীপ। যা দেখে মানুর মনে হচ্ছে জোনাকির সাম্রাজ্যে যেন দৈত্য জোনাকির দপদপানি। মানু পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় তার ঝাবরাচাচা যেখানে বসে তাড়ি গিলছে সেদিকেই। লক্ষ্য করে, ঝাবরাচাচা তাড়ি গিলতে গিলতে আপন মনে বিড়বিড় করে কত কী বকছে। যদিও তার সব কথা বোঝা যাচ্ছে না। মানু তার ঝাবরাচাচার পাশে গিয়ে বসতেই ঝাবরাচাচা বলে উঠল, ‘‘কী গো চাছা-- তুমি আখুনো ঘুমাওনি?’’ মানু বলল, ‘‘না চাচা-- ঘুম আসছে না। ’’ ঝাবরাচাচা বলল, ‘‘ঘুম আসবে কী কর্যাা বাপ! এটা তো আর পণ্ডিতবাড়ি লয় যে, এখ্যানে শুবার লেগে পালং তোষক পাবা?’’ ঝাবরাচাচার কথার মধ্যে যে শ্লেষ আছে মানু তা বুঝতে পারে না। ঝাবরাচাচা কিন্তু সেটা বুঝতে পারে। আর বুঝতে পারে বলেই আপন মনে হেসে ওঠে। তার মধ্যেই হঠাৎ মানু তার ঝাবরাচাচাকে জিজ্ঞেস করে বসে, ‘‘চাচা-- এই যে আপনি দিনরাত বাগানে পড়ে থাকেন, আপনার ভয় করে না?’’ ঝাবরাচাচা উত্তর দেয়, ‘‘ভয়! না বাপ। হামার জানে কুনু ভয়ডর নাই। গরিবের ভয়ডর লাগে না। তাছাড়া ভয়ডর কর্যা- হবে কী? হারাবার কী-ই বা আছে হামার?’

কিন্তু এই বয়সেই ঝাবরাচাচার কষ্ট হয়তো তাকে ছুঁয়ে যায়। তখন তার ঝাবরাচাচার বউ শাকিরাবিবিকে মনে পড়ে। রোজ কোলে হাতে পায়ে তিন-তিনটে বালবাচ্চাকে জড়িয়ে পাগলির মতো এই বাগানে আসে। নিজের হাতে রান্না করা খাবার দিয়ে যায়। খোঁজখবর নিয়ে যায়। সঙ্গে স্বামীকে গালিগালাজ করে। ঝাবরাচাচা নাকি সংসারের কোনও দায়দায়িত্ব পালন করে না। এই অপবাদ দেওয়ার সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায় যে, শুধু টাকাপয়সা রোজগার করে দিলেই সংসার চলে না। সংসার সচল রাখতে আরও অনেক কিছু করতে হয়। শাকিরাবিবির আক্ষেপের এসব কথা শুনে মানুর মনে পড়ে যায় তার আব্বাকে। তার আব্বা মাস্টারি করে শহরের হাইস্কুলে। রোজ স্কুল থেকে আসার সময় সংসারের জন্য শহর থেকে এটাওটা কিনে আনে। তার জন্য, তার ভাইবোনদের জন্য বিস্কুট-লজেন্স-মিষ্টিও কিনে নিয়ে আসে। কিন্তু ঝাবরাচাচা তো সেসব কিছুই করে না। লোকটা তো নিজের বাড়িতেই যায় না। ভূতের ভয় কাটাতেই হয়তো এসব বিষয় নিয়ে ঝাবরাচাচার সঙ্গে কথা বলবে ভেবে মানু বলে উঠল, ‘‘চাচা-- তাড়ি খাব। দিবেন এক গেলাস?’’ মানুর একথা শুনে ঝাবরাচাচা আঁতকে উঠল। পণ্ডিতসাহেব যদি একথা জানতে পারে, তাহলে পণ্ডিতবাড়ির ভাত তার কপালে আর জুটবে না। তাই সে বলল, ‘‘ছিঃ বাপ! অমন কথা বুলিও না। তুমি হছো পণ্ডিতের পোতা! মাস্টারের ব্যাটা! তুমি তাড়ি খাবা কেনে? লোকে বুলবে কী?’’ ঝাবরাচাচার এমন কথায় মানুর জেদ পেয়ে বসল। জোর দিয়ে সে বলে উঠল, ‘‘আমি খাব চাচা। খেয়ে দেখব-- খেতে কেমন লাগে!’’ মানুর জেদের কাছে ঝাবরাচাচা অসহায় হয়ে পড়ে। যদিও হার মানে না। মানুকে সে তাড়ি দেয় না। নেশা হয়েছে এমন ভান করে সেখানেই ঘাসের ওপর নিজেকে গড়িয়ে দেয়।
একটি দেশি মুরগি নিয়ে এসে হাজির হয় ঝাবরাচাচা। আমের সময় বাগানে অস্থায়ী রান্নার ব্যবস্থা থাকে। সেখানেই মুরগি কেটে মাংস রান্না করে। পাশের ভ্যাটপিঠুলির জঙ্গল থেকে নতুন মাটির ঠিলিতে রাখা তাড়ি বের করে আনে। তারপর মানুকে হাঁক ছেড়ে ডাক দেয়, ‘‘ও মানু-- মানু বাপ-- এদিকে আইসো!’’ ঝাবরাচাচার ডাকে সাড়া দিতে কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে মানু দেখে, একেবারে এলাহি আয়োজন! পূর্ণিমা না হলেও আকাশে ত্রয়োদশীর চাঁদ আছে। তার অস্পষ্ট আলোয় মানু স্পষ্ট দেখতে পায় একটা ঝকঝকে ফুলতোলা কাচের গেলাসে ঝাবরাচাচা তাড়ি ঢেলে রেখেছে। তারপর সদ্য কেটে আনা কলাপাতায় হাঁড়ি থেকে মুরগির মাংস তুলছে। কিন্তু তার মাংস তোলা শেষ হচ্ছে না। মানু জিজ্ঞেস করে, ‘‘এত মাংস তুলছেন কেন চাচা? এত মাংস কে খাবে?’’ ঝাবরাচাচা বলল, ‘‘কেনে বাপ, তুমি খাবা! তুমি যে বুল্ল্যা কাইল, তাড়ি খাব! সেই লেগেই তো বাড়ি থেইক্যা চুরি কর্যাে মুরগি ধরে লিয়ে এস্যাছি। তুমার লেগে মাথাটা ঢুঁড়ছি। কিন্তুক শালা পেছি না। ’’ মানু বুঝতে পারে, তার ঝাবরাচাচার নেশা হয়ে গেছে। অগত্যা সে কোনও রকমে এক গেলাস তাড়ি গিলে এক পিস মাংস চিবিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কুঁড়েঘরে চলে যায়। তার ঝাবরাচাচা যা করছে করুক গে। তিন পরের দিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙতে মানু দেখতে পায়, তার ঝাবরাচাচা সেই অস্থায়ী রান্নার জায়গায় চিৎপটাং হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আর ঠিক তার পাশে ঘাসের ওপর এক দঙ্গল পিঁপড়ে গত রাত্রে শহিদ হওয়া মুরগির রান্না না হওয়া কাঁচা মাথাটাকে তাদের আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বি. দ্র.: মানুর সম্মানে ঝাবরাচাচার পাল্লায় পড়ে দেশি মুরগিটা গলা দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মাথাটা দেয়নি। সেই মাথা নিয়ে রাত ভোর করে এক দঙ্গল পিঁপড়ে কেমন হিমশিম খাচ্ছে। অবাক বিস্ময়ে মানু সেটাই দেখছে। তাহলে কি মানু ধীরে ধীরে সাবালক হচ্ছে! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনারা কেউ কি কিছু বুঝতে পারছেন? 

news24bd.tv/ডিডি

এই রকম আরও টপিক