স্মৃতি-ঘ্রাণে রানিগোলাপ

অলংকরণ: কামরুল

কিস্তি-২০

স্মৃতি-ঘ্রাণে রানিগোলাপ

অনলাইন ডেস্ক

কাঁচাপাকা চুলের মাঝবয়েসি মানুষের মতো আলফাডাঙ্গা উপজেলার সামনে একটি বাড়ি নির্দ্বিধায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম নাইনটিজের দিকে। বাড়িটির মালিক ভদ্রলোক রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষক। সৎ, বিদ্বান, কিঞ্চিৎ কৃপণ এবং অসম্ভব ভালো মানুষ হিসেবে এলাকায় পরিচিতি ছিলো তাঁর। তিনি সম্পর্কে আমার নানা, মো. মালেক মিয়া।

বাড়িটির নাম 'মালেক ভিলা'। মাঝবয়েসি এই বাড়িটি আমার শিশু মনে এমন মমতার কুঠুরি তৈরি করে নিয়েছে যে ধাতব বাস্তবতার কুঠার-আঘাতেও আমি এগুলোকে রেগুলার যত্ন করে রেখে দিয়েছি। মাঝে মাঝে কুঠুরি থেকে বের করে আনি, অন্তিম আনন্দ পাই। 'মালেক ভিলা'র মালিকের ছেলেপুলে ৮ জন।
কিন্তু শিক্ষার কারণে কেউ বাড়িতে থাকে না। শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ যে মামা তিনিই থাকেন শুধু। মেইন ঘরটির মুখ বাড়ির গেইটের দিকে, অর্থাৎ পশ্চিম দিকে। ঘরটির সামনে ছিলো রানিগোলাপের বাগান। দুটি বিরাট বিরাট গোলাপ-ঝাড়। বাগানটি পরিচর্যা করতেন আমার নানার কনিষ্ঠ কন্যা, যাঁকে আমি 'কুটি' বলে ডাকি। এই কুটি বলতে আমাদের এলাকায় 'ছোট'কে বোঝানো হয়। নানার সর্বশেষ সন্তান হলেন সোহানা শারমিন মিতু। 'কুটি' সম্বোধন নিয়ে একটা মজার স্মৃতি আছে। কুটি একসময় আমাদের বাড়িতে থেকে একটা কলেজে চাকরি নিয়েছিলেন। তখন আমার গৃহ শিক্ষক শ্রদ্ধেয় পাঠক স্যার আমার 'কুটি' সম্বোধন শুনে দিলেন এক ধমক। আমি কেন বড়োদের নাম ধরে ডাকি? পরে অবশ্য ব্যাপারটার মীমাংসা করি। স্যারকে বলি যে 'কুটি' কারো নাম না, সম্বোধন মাত্র। এই কুটির কাছে আমি ছোটবেলায় কিছুদিন ছিলাম, মায়ের ট্রেনিঙের কারণে। পরে একদিন আব্বু নানুবাড়িতে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমার মা কোথায়?  আমি 'কুটি'কে দেখিয়ে দিই। কুটির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। কুটিকে আমি একসময় আমার মা-ই ভাবতাম। যেমন ভাবতাম আমি আব্বুর পেটে হয়েছিলাম। শিশুতোষ এমন অনেক বিশ্বাস নিয়ে মানুষ বড়ো হয়।  

আরও পড়ুন : দাদি ও আমার 'সাপুড়ে' বর

ফিরে যাই নানুদের গোলাপ-বাগানে।
নানুদের দুটো পিতলের ফুলদানি ছিলো, বাড়িতে কোনো প্রোগ্রাম হলেই গোলাপ বাগান থেকে বেশ কিছু প্রস্ফুটিত  গোলাপি গোলাপি রানিগোলাপ ফুলদানি দুটোর মধ্যে ভর করতো। ভেতরে সম্ভবত পানি দিয়ে দিতেন কুটি। গোলাপের সঙ্গে কিছু লাল-হলুদ-সবুজ পাতাবাহারও শোভা পেতো। ওইসব দিনে রানিগোলাপ ছিলো খুব কমন। বাড়িতে বাড়িতে রানিগোলাপের বাগান থাকতো গ্রামে। মোঘলাই সংস্কৃতির অনেক কিছুর মতো রানিগোলাপও বিস্তার লাভ করেছিলো সেই ১৪ শতকে।
মোঘল সম্রাট বাবর গোলাপ ও সুগন্ধি খুব পছন্দ করতেন। তিনিই প্রথম ভারতবর্ষে  পারস্য থেকে সুগন্ধি ও বিশেষ জাতের গোলাপ আনিয়েছিলেন। সেইসব সুগন্ধময় রানিগোলাপই রাজকীয় ঐতিহ্যের ধারা ধরে রেখে আমাদের ছোটবেলাগুলোকে সুরভিত করতো।
এখন গোলাপের রাজারা বাগানে বাগানে কিংবা ফুলের দোকানে শোভিত ও বিগলিত দরে ফুটে থাকলেও রানিগোলাপকে আর কোথাও তেমন দেখা যায় না। বেচারা রানিগোলাপ অভিমানে,অবহেলায় কীভাবে যে বিলুপ্ত হয়ে চলেছে তা নিয়ে উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা কতোটুকু ভাবছেন তা আমি জানি না।

ছোটোবেলায় নানাবাড়িকে আমার খুব সমৃদ্ধ ও সৌখিন মনে হবার কারণ মনে হয় এই রানিগোলাপের বাগান।  শুধু নানাবাড়ি নয়, রানিগোলাপওয়ালা যেকোনো  বাড়িকেই খুব সৌখিন মনে হতো। আমাদের এলাকার হসপিটালে ছিলো একটা রানিগোলাপের বাগান। আম্মুর এক কলিগের বাড়িতেও ছিলো।  

আমি এসব জায়গায় যেতাম শুধু গোলাপের ঘ্রাণ নেবার জন্য। পরবর্তীকালে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন নিউমার্কেটে দেখতাম কয়েকটা রানিগোলাপের ঝাড়। উসিলা পেলেই যেতাম রানিগোলাপের ঘ্রাণ নিতে।
আসলে যেতাম ছোটবেলার স্মৃতি-গন্ধের স্বাদ নিতে।

আরও পড়ুন : নকিয়া-১১১০

ফিরে যাই 'মালেক ভিলা'য়। কুটি অর্থাৎ ছোটোখালা উচ্চ শিক্ষার জন্য বাড়ি ত্যাগ করার পর রানিগোলাপের বাগানটি অযত্নে ঠোঁট ফোলাতে ফোলাতে ফুল দেয়া কমিয়ে দিলো। একবার গিয়ে দেখি ঝোপদুটো মারা গেছে। শুকনো  জোড়া ঝাড়গুলো দাঁড়িয়ে আছে তাদের মায়ের শোকে। কুটি নিরুপায়_ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার চাপ, জীবন সংগ্রামের চাপ, বিসিএসের চাপ।
এসবের মধ্যে গোলাপ বাগানের কথা আর তার মাথায় নাই। এরপর তো বিয়ে করে পরের বাড়ি।  

কুটির গোলাপবাগানটা যে এতোটা অভিমানী ছিলো তা বোধ করি তখন আমাদের কারো মাথায়ই কুলায়নি। বৃক্ষেরও মন থাকে, বেদনা থাকে। সবাক প্রাণির বেদনাই বুঝি না আমরা, নির্বাকের কথা আর কে বুঝতে যায়! গাছেদের প্রাণ আছে, জগদীশচন্দ্র বসুর এই আবিষ্কারেই আমরা আটকে আছি। গাছেদের যে সুরের কান আছে তাও দেখলাম হুমায়ূন আহমেদের নাটকের মারফত। কিন্তু নিজেদের ঘরের গাছগুলোর ভাষা পড়বার সময় আমাদের নাই। আমরা নাটক দেখি, বিগলিত ও বিমোহিত হই। কিন্তু গাছেদের সঙ্গে ভাব জমাই না।
গাছেদের অনুভূতি নিয়ে অদ্ভুত আলাপ হতো আমার একসময়ে 'দেশাল' বুটিক শপের এক স্টাফের সঙ্গে। ছেলেটার নাম রোমিও। যখনই যেতাম, দেখতাম তার মানিপ্ল্যান্টের সবুজ সবুজ হাসি। রোমিও বলতো, 'আপু জানেন ওরা আমাকে খুব পছন্দ করে। ওদের সঙ্গে আমি রেগুলার কথা বলি। ' রোমিওর কথা শুনে আমি একটু অবাক হই। তখন বাসায় এসে একটা বিষয় খেয়াল করতে শুরু করি। যেসব জায়গায় আমরা রেগুলার চলাফেরা করি সেসব জায়গার মানিপ্ল্যান্টের রূপ একরকম আর যেসব জায়গা একটু আবডালে থাকে, সেসব জায়গার মানিপ্ল্যান্ট কেমন যেন ঠোঁট ঝুলিয়ে বসে থাকে। তখন ইন্টারের সিলেবাসে মোতাহের হোসেন চৌধুরীর 'জীবন ও বৃক্ষ' প্রবন্ধটি পড়াতাম। ক্লাসে একবার এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলা মাত্রই ছেলেপেলে হেসে কুটিকুটি হলো। ওদের আর দোষ কী?  ছোটোবেলা থেকেই আমরা 'অ্যানথ্রোপসেন্ট্রিক' জীবন নিয়ে খুব সচেতন থেকে বড়ো হই। এখানে জীবন বলতে মনুষ্য জীবনের মাহাত্ম্যকেই সর্বাধিক ট্রিট দিয়ে থাকি। প্রাণিজগতে মানুষই শ্রেষ্ঠ ও চূড়ান্ত। অন্য সব প্রাণী বাঁচে কেবল মানুষের সাপেক্ষে, মানুষকে ঘিরে থেকেই। এই অবস্থায় বৃক্ষকে তো আরও মান্য করি না। যেন মানুষ ছাড়া পৃথিবীর আর কোনো জীবের ব্যথা বা দুঃখ থাকতে নেই।

ফলে মানুষের খুব সাধারণ নিয়মের মতোই রানিগোলাপের পর্বটি এখন আর সংশ্লিষ্ট কারো স্মৃতিতে খুব একটা আসে না। কুটি, মেজো(মেজো খালা), মা আর মামাদের আড্ডায় বহু স্মৃতি উঠে আসলেও রানিগোলাপের প্রসঙ্গটি খুব একটা আসতে দেখি না। কেননা এর সঙ্গে সবার অতো সখ্য ছিলো না মনে হয়।

যেকোনো নার্সারিতে গেলেই আমি রানিগোলাপের চারা খুঁজি। খুব এমটা পাই না। অবশ্য একবার আগারগাঁও গিয়ে পেয়েছিলাম। দাম ৫০০ করে। চারাগুলোকে বহন আর যতনের নিশ্চয়তা দিতে পারিনি দেখে কিনতে পারিনি।

রানিগোলাপ আসলেই রানি!  মহারানির অন্তরের বেদনাগুলো বিনাবাক্যে রাজকীয় চাকচিক্যের অন্তরালে গুমরাতে থাকে। কেউ টের পায় না। রানিগোলাপের সুঘ্রাণের মতো রানিদের প্রাত্যহিক আভিজাত্য সবসময় সাধারণের মনে পুলক জাগায়। দুঃখবোধকে বিক্ষত করে প্রতিমুহূর্তে।  

আমাদের বাড়িতে বেশ কিছু ফুলসমৃদ্ধ বাগান ছিলো একসময়। কিন্তু রানিগোলাপকে কখনো দেখা যায়নি সেখানে। কেন কে জানে!
আব্বুর ঝোঁক ছিলো গাঁদাফুলের দিকেই। সুন্দর করে শৃংখলিত সারিতে হলুদ কমলা গাঁদাফুলের বাগান করতেন আব্বু। বাগান ভর্তি গাঁদার বাহার। ১৬ ই ডিসেম্বরের আগের দিন মোটামুটি  ফুল চুরি হবার আশংকায় গভীর রাতে ঘুমোতে যেতেন আব্বু। কখনো কখনো ফুল পাহারাও দেয়া হতো। কিন্তু ভোর রাতে উঠে দেখা যেত বাগানের সমস্ত ফুল হেঁটে হেঁটে শহিদ বেদিতে গিয়ে ঝিমুচ্ছে। আহা, গোটা বাগানে তখন হাহাকার! তবে আব্বুকে খুব কড়াকড়িও করতে দেখিনি। করলে নিশ্চয়ই থাকতো। আব্বু ছিলেন বিরল প্রজাতির রকমের বৃক্ষ প্রেমিক। আমাদের বাড়িতে প্রায় সব ধরনের গাছই লাগিয়েছিলেন। এমনকি একবার আপেল আর আঙ্গুর গাছও লাগিয়েছিলেন। আপেল গাছটি বাঁজা হলেও আঙ্গুর ছিলো দুর্দান্ত ফলবতী। লাউয়ের জাঙলের মতো আঙ্গুরের জাঙলেতে প্রচুর আঙ্গুর হতো। স্বাদে টক না হলেও প্রকৃতিতে বিচিওয়ালা ছিলো। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই এই বিরল প্রজাতের আঙ্গুর গাছ দেখতে আসতো। কিন্তু আমার বিরল ধর্মের বৃক্ষ-প্রেমিক আব্বু শুধুমাত্র বিচির কারণে একদিন আঙ্গুর গাছটির গর্দান নিয়ে নিলেন। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রাতাপশালী লুঙ্গির তলে বেচারা বিচিওয়ালা হেডমদার হয়েও রক্ষা পেলো না। অথচ, এখনকার অনেক আঙ্গুরেই কিন্তু বিচি দেখা যায়!  আফসোস!

আরও পড়ুন : বিশ্ববিদ্যালয় ও একজন মোহাম্মদ আজম

কিন্তু নানুদের বাড়িতে বিচিত্র ফলের চেয়ে ফুলের সনারোহ ছিলো।
নানুদের বাড়ির সামনে দুই পাশে বসার জন্য সংক্রিটের দুটো বেঞ্চ মতো ছিলো। গোলাপ বাগানের পাশে সিঁড়ি দুটোতে কারেন্ট চলে গেলে বসতো সবাই। মনে পড়ে জ্যোৎস্না রাতে রানিগোলাপের সুবাস আর সিঁড়ির পাশেই রাজার সিংহাসনের মতো বসে থাকা স্পাইডার লিলির মৃদু সুবাস এমন মন-মাতানো পরিবেশ সৃষ্টি করতো যে কারেন্ট এলেও সেখান থেকে উঠতে ইচ্ছে করতো না।  
ছোটো ছিলাম। পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগের জন্য এখনকার মতো সচল ইন্দ্রিয়-শক্তি যদি তখন থাকতো, তাহলে এই গোলাপ বাগান নিয়েই কয়েকটা বই লিখে ফেলা যেতো।

আমি এখনও হাজারো বৃক্ষের ভিড়ে গিয়ে রানিগোলাপকে খুঁজি। কখনো কোথাও পেলে ঘ্রাণ নিই। না, আমি আসলে আমার মিষ্টি মধুর সুবাসিত নানুবাড়িকে খুঁজি। গাঁদার বাগানে খুঁজি আব্বুর গোলগাল মুখ। আর বিচিওয়ালা আঙ্গুরে আব্বুর হিংস্র রূপ খুঁজে ফিরি।

লেখক: অধ্যাপক ও সমালোচক

news24bd.tv/ ডিডি
 

এই রকম আরও টপিক