ইসলামে শিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য

ইসলামে শিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য

 মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ

শিক্ষাদান এবং শিক্ষাগ্রহণ, এরূপ দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সুন্দর সম্পর্ক। দাতা-গ্রহীতার সম্পর্কের চেয়ে অনেক পবিত্র এ সম্পর্ক। শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থী কেবলই জ্ঞান লাভ করে না, তাঁর উপদেশ ও পরামর্শ থেকে পায় জীবন ও চরিত্র গঠনের মূল্যবান নির্দেশনা। শিক্ষকের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দ্বারা সমৃদ্ধ হতে চাইলে তাঁর প্রতি শিক্ষার্থীকে হতে হবে শ্রদ্ধাশীল ও অনুগত, থাকতে হবে তাঁর ওপর গভীর আস্থা।

আর তখনই শিক্ষক শিক্ষার্থীকে সর্বোত্তম শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সক্ষম হবেন। এর ফলে সাধিত হবে শিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য এবং প্রতিষ্ঠানে সৃষ্টি হবে সুন্দর পরিবেশ। শিক্ষার্থীর দুর্বিনীত আচরণ শিক্ষককে নিদারুণ হতাশায় ভরে তোলে, বিনিময়ে শিক্ষার্থী কিছুই লাভ করে না। অবাধ্য ও দুর্বিনীত শিক্ষার্থী শিক্ষকের কাছ থেকে শিখতে পারে না কিছুই, তার অর্জন কেবলই শূন্য।

শিক্ষক মহৎ সেবা দানে নিয়োজিত। তাঁর এই সেবা অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা যায় না, যেমনি যায় না মাতা-পিতার সেবা সন্তানের প্রতি। মা-বাবা সন্তান জন্ম ও প্রতিপালনের গুরুদায়িত্ব পালন করেন আর শিক্ষক তাকে শিক্ষিত করেন। তার হৃদয়-মনকে জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত করেন, তাকে সমাজে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেন।

প্রিয়নবী (সা.) যে ঐশী বাণী অর্জন করেছেন, সেই বাণীর আলোকে তিনি মানবকুলকে মহান রব, মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্কের নীতিমালা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি স্বয়ং নিজে পরিচয় তুলে ধরে বলেন, ‘আমি শিক্ষক হিসেবে প্রেরিত হয়েছি। ’ (ইবনে মাজাহ : ২২৫)

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মাঝে যে সম্পর্ক তা সকল হীন স্বার্থ ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শিক্ষক কিছু প্রত্যাশা করেন না। শিক্ষক শিক্ষার্থীর মাঝে দেখতে চান জ্ঞানের আলো, বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ এবং পরিচ্ছন্ন ও সচেতন মন।

শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শিক্ষক আশা করেন, সদাচরণ ও সত্স্বভাব। শিক্ষার্থীকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে শিক্ষক আনন্দিত হন। বিপথগামী হতে দেখে ব্যথিত হন। শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষকের যে ব্যাকুলতা, তা না পাওয়ার হতাশা নয়, বরং হারিয়ে যাওয়ার বেদনা, শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত না হওয়ার বেদনা, জীবনে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ার বেদনা।

মা-বাবা তার সন্তানকে শাসন করেন। সেটা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি স্বাভাবিক ও কাম্য হলো—শিক্ষক শিক্ষার্থীকে শাসন করা। শিক্ষার্থীকে আজকাল শাসন করা যায় না, এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়। এটা ঠিক নয়। শিক্ষার্থী যথার্থ ক্ষেত্রে, যথাসময়ে তার শিক্ষকের যথার্থ নির্দেশনা, চারিত্রিক দৃঢ়তা ও শৃঙ্খলাবোধ প্রত্যাশা করে ও পছন্দ করে, যতই দুর্বিনীত হোক না কেন। শিক্ষকের যথার্থ যুক্তি ও ন্যায়বোধের কাছে সে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য।

পরিবেশ ও প্রতিরোধ তা ক্ষণিকের জন্য বিলম্বিত করে মাত্র। শিক্ষার্থীরা বয়সে তরুণ, স্বভাবে চঞ্চল ও চিন্তায় বিপ্লবী। এদের মধ্যে মুষ্টিমেয় ক্ষেত্রবিশেষে নেতৃত্ব দিতে চায়, কিছু একটা করতে চায়, সবার কাছে তার কৃতিত্ব তুলে ধরতে চায়। যথাযথ পথনির্দেশের অভাবে এরা অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্ত হয়, হয় বিপথগামী। এদের মধ্যে নেতৃত্ব গ্রহণের ও সমস্যা সমাধানের কিছু প্রতিভা হয়তো আছে। এ সত্য উপলব্ধি করে তাদের প্রতিভা ও কার্যস্পৃহাকে যথাযথ খাতে চালিত করে তাদের মধ্যে যথার্থ নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেন। বিজ্ঞজনরা বলেন, ‘শাসন করা তারই সাজে, সোহাগ করে যে’।

শিক্ষকের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষকসমাজ এ ব্যাপারে যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারবে না বলেই সচেতন মহল মনে করে। শিক্ষকের পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার অভাব, বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা ও বেতনকাঠামো, শিক্ষাব্যবস্থাকে দলীয়করণ, দক্ষ শিক্ষকের অভাব এবং শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদার অভাবের কারণে শিক্ষকসমাজ সমাজের মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারছে না। অথচ জ্ঞান অন্বেষণের গুরুত্ব ও শিক্ষকের মর্যাদা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান হতে পারে?’ (সুরা : যুমার, আয়াত : ৯)

সুতরাং সমাজ ও ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে মূল্যবোধ সৃষ্টি করার জন্য শিক্ষকসমাজের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষকতা শুধু একটি বৃত্তি বা পেশা নয়, বরং এটি একটি আরাধনা। আদর্শ ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের জ্ঞান ও গুণে মুগ্ধ শিক্ষার্থী শিক্ষককে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করে। যথার্থ শিক্ষকের কাছ থেকে দেশ আশা করতে পারে অসংখ্য প্রকৃত দেশপ্রেমিক, আলোকিত মানুষ।

লেখক : প্রিন্সিপাল, শ্যামপুর কদমতলী রাজউক মাদরাসা, ঢাকা