দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে মৃত্যু বেড়ে ১২ জন দাঁড়িয়েছে। উপকূলীয় ছয় জেলায় এ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। জেলাগুলো হলো: খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা ও চট্টগ্রাম।
রোববার (২৬ মে) থেকে সোমবার (২৭ মে) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ওই ১২ জনের মৃত্যু হয়।
মৃতরা হলেন: ভোলার লালমোহন উপজেলার চর উমেদ এলাকার আব্দুল কাদেরের স্ত্রী মনেজা খাতুন (৫৫), দৌলতখান উপজেলার মাইসা (৪) ও বোরহান উদ্দিন উপজেলার জাকির (৫০), খুলনার গরিয়ারডাঙ্গা গ্রামের গহর মোড়লের ছেলে লালচাঁদ মোড়ল (৩৬), বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার দাড়িয়াল ইউনিয়নের চর দাড়িয়াল এলাকার জালাল সিকদার (৫৫), জেলার বড়বিঘাই গ্রামের হোটেল মালিক লোকমান হোসেন ও কর্মচারী মোকছেদুর রহমান, সাতক্ষীরার নাপিতখালি গ্রামের বাসিন্দা শওকত মোড়ল (৭০), পটুয়াখালীর কলাপাড়ার অনন্তপাড়া এলাকার আবদুর রহিমের ছেলে মো. শরীফ (২৪), দুমকির নলদোয়ানি গ্রামের বৃদ্ধ জয়নাল হাওলাদার, বাউফলের বৃদ্ধ করিম, চট্টগ্রামের খুলশী থানার চৌধুরী নগর শতাব্দী হাউজিং এলাকার পথচারী সাইফুল ইসলাম হৃদয় (২৬)। তিনি একটি কার্টন ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। হৃদয়ের গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে।
প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
খুলনা: তীব্র বাতাস ও বৃষ্টিতে গাছ উপড়ে ঘরের ওপর পড়ে লালচাঁদ মোড়ল নামে এক যুবক মারা গেছেন।
রোববার রাতে উপজেলার সুরখালী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের গাওঘরা গরিয়ারডাঙ্গা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
সুরখালী ইউপির চেয়ারম্যান এস কে জাকির হোসেন বলেন, ঝড়ের রাতে নিজের ঘরে শুয়ে ছিলেন লালচাঁদ। ঘরের পাশে একটা বড় জামগাছ ছিল। ঘরের অবস্থা খুব বেশি ভালো ছিল না। ঝড়ে জামগাছ উপড়ে ঘরের ওপর পড়ে। সোমবার সকালে লোকজন গিয়ে গাছ কেটে মৃত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. নাজমুল হুসেইন খাঁন বলেন, রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেন লাল চাঁদ মোড়ল। পরে রাতেই তিনি বাড়ি ফিরে যান। বাড়ি গেলে গাছচাপায় তিনি মারা যান।
ভোলা: গাছ-ঘরচাপায় নারী ও শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার ভোররাতের দিকে লালমোহন, দৌলতখান ও বোরহান উদ্দিন উপজেলায় তাদের মৃত্যু হয়।
এ ব্যাপারে লালমোহন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম মাহবুব উল আলম জানান, ঘূর্ণিঝড়ে ঘরের নিচে চাপা পড়ে মনেজা খাতুন নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। মনেজা খাতুন রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এ সময় তার স্বামী ও ৫-৭ বছর বয়সী নাতিনও তার সঙ্গে একই ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। ঝড়ের সময় তার স্বামী ও ছোট নাতিন বের হতে পারলেও মনেজা ঘরের নিচে চাপা পড়েন। পরে প্রতিবেশীরা গিয়ে তার মরদেহ উদ্ধার করেন।
দৌলতখান উপজেলায় ঝড়ের মধ্যে ঘর চাপা পড়ে মাইসা নামের একজন মারা গেছে বলে দৌলতখান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সত্য রঞ্জন খাসকেল জানান।
এ ছাড়া বোরহান উদ্দিন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহীন ফকির বলেন, বোরহান উদ্দিন উপজেলায় ঝড়ে গাছ চাপা পড়ে জাকির নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এ দিকে ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে দ্বীপজেলা ভোলায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বরিশাল: দেয়াল ধসে ও গাছের ডাল ভেঙে পড়ে জেলায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
বরিশালের জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম জানান, রোববার (২৬ মে) রাতে ও সোমবার (২৭ মে) বরিশাল নগরের রুপাতলীতে দেয়াল ধসে দুজনের মৃত্যু হয় এবং বাকেরগঞ্জ উপজেলায় গাছের ডাল ভেঙে পড়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে।
পুলিশ জানান, রোববার থেকে চলমান ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন লিলি পাম্পের দক্ষিণ পাশের একটি বিল্ডিং এর ৪র্থ তলার দেয়াল ধসে পড়ে লোকমান হোটেলের মালিক লোকমান (৫৫) ও মোকসুদুলের মৃত্যু হয়। এ সময় আহত সাকিব (২০) নামে এক যুবক আহত হন। তিনি বরিশাল শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অর্থোপেডিক্স ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আছেন। এদিকে বাকেরগঞ্জ উপজেলায় গাছের ডাল ভেঙে পড়ে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে।
অপরদিকে প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে গোটা বরিশাল বিভাগে লন্ডভন্ড হয়েছে অসংখ্য গাছপালা। শহর ও গ্রাম মিলিয়ে পানিবন্দি আছেন অনেক মানুষ। ফসলি জমি, রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে রয়েছে। সেই সঙ্গে মধ্যরাত থেকে এ পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
সাতক্ষীরা: শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালি আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে শওকত মোড়ল (৭০) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় এ ঘটনা ঘটে।
মৃতের ভাতিজা নুর মোহাম্মদ জানান, বিকেলের পর থেকে প্রচণ্ড ঝড় ও নদীতে তুফান উঠলে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। চাচা শওকত মোড়ল নাপিতখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়ণকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য জামাকাপড়সহ স্ত্রীকে নিয়ে বের হন। বাসা থেকে বাঁধের ওপর গিয়ে যাওয়ার সময় পড়ে গিয়ে মারা যান তিনি। মরদেহ এখন বাসায় রয়েছে।
শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় অসুস্থ এক বৃদ্ধ মারা গেছে বলে শুনেছি। ’
পটুয়াখালী: কলাপাড়ায় ঘূর্ণিঝড় রেমাল থেকে ফুফু ও বোনকে রক্ষা করতে গিয়ে মো. শরীফ (২৪) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। রোববার (২৬ মে) দুপুরে ধূলাসর ইউনিয়নের কাউয়ারচর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
এ দিকে দুমকির নলদোয়ানি গ্রামে ঘরের ওপর গাছ পড়ে বৃদ্ধ জয়নাল হাওলাদারের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া, বাউফলের নাজিরপুরে পরিত্যক্ত ঘরে গাছ পড়ে করিম নামের আরেক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শরীফের ফুপু মাতোয়ারা বেগম কাউয়ার চর এলাকায় বসবাস করেন। ওই বাড়িতে তার বোনও ছিল। দুপুর ১টার দিকে অনন্তপাড়া থেকে শরীফ তার বড় ভাই ও ফুফাকে নিয়ে বোন এবং ফুফুকে উদ্ধার করতে যায়। এ সময় সমুদ্রের পানিতে কাউয়ারচর এলাকা ৫ থেকে ৭ ফুট পানিতে প্লাবিত ছিল। সাঁতার কেটে তারা ফুফুর ঘরে যাওয়ার সময় সমুদ্রের ঢেউয়ের তোড়ে শরীফ হারিয়ে যান। একঘণ্টা পর ওই স্থান থেকে শরীফের মরদেহ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা।
মহিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন তালুকদার জানান, ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম: নগরীতে একটি নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ধসে সাইফুল ইসলাম হৃদয় (২৬) নামে এক পথচারীর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার (২৭ মে) সকালে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামীর চন্দ্রনগর তালতলার জেডএ আবাসিক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সঞ্জয় কুমার সিনহা বলেন, সকালে কাজে যাওয়ার সময় বায়েজিদ তারা গেইট এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ধসে ওই যুবকের ওপরে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলে তিনি মারা যান। মাদ্রাসার জন্য ওই ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছিল। ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে প্রবল বৃষ্টিপাতে দেয়ালটি আলগা হয়ে পড়ে যায়। এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
news24bd.tv/তৌহিদ