ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে তীব্র সংকটে মানবিক সহায়তায় বাধা দিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, মানবিক সাহায্য প্রবেশে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে অনাহারে রাখাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। একে অনেকে গণহত্যার সঙ্গেও তুলনা করেছেন।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে ইসরায়েল সৃষ্ট এ মানবিক বিপর্যয়ের জন্য ইসরায়েলকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
স্টেসি গিলবার্ট বলেছেন, মার্কিন সরকারের একটি প্রতিবেদনের কারণে তিনি পদত্যাগ করেছেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলায় কার্যত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের চালানো বর্বর এই আগ্রাসনে গাজায় অন্তত ৩৪ হাজার ৭৮৯ এবং পশ্চিম তীরে ৪৯৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহত ফিলিস্তিনিদের বেশিরভাগই নারী এবং শিশু। ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় গাজায় ৭৮ হাজার ২০৪ জন এবং পশ্চিম তীরে ৪৯৫০ জন আহত হয়েছেন। নিখোঁজের সংখ্যা ১০ সহস্রাধিক। এছাড়া ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
সারাবিশ্ব যখন গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, তখন ফিলিস্তিনি নারী-শিশুদের উপর বর্বরতার দায়মুক্তি দিয়ে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করছে আমেরিকা। শুধু তাই নয়, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে কংগ্রেসের যৌথ সভায় ভাষণ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন মার্কিন সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদের নেতারা।
ইসরায়েলের নৃশংসতার সমর্থন দিয়ে ৭ অক্টোবরের হামলার জন্য ফিলিস্তিনকে দায়ী করে এবং এই হামলাকে ইসরায়েলের অস্তিত্বের লড়াই বলে উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, ইসরায়েলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সংহতি ও স্থায়ী সম্পর্ক তুলে ধরতে এবং গণতন্ত্র রক্ষা, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই ও এই অঞ্চলে ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইসরায়েলি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতেই এই আমন্ত্রণ।
জাতিসংঘ ও ত্রাণ সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে গাজায় সহায়তা পাঠানো এবং তা বিতরণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কথা বলে আসছে। গাজায় ফিলিস্তিনি মৃত্যুর সংখ্যা ৩৬ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার পর এবং মানবিক সংকট ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং অন্যান্য সমালোচকরা ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ ও গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করার জন্য বাইডেন প্রশাসনকে দোষারোপ করে আসছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চলতি মাসের শুরুর দিকে কংগ্রেসে ৪৬ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন পেশ করে। এতে উল্লেখ করা হয়, ৭ অক্টোবরের পর যুক্তরাষ্ট্র ও গাজায় মানবিক সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়ার অপর উদ্যোগগুলোকে পুরোপুরি সহযোগিতা করেনি ইসরায়েল। তবে এতে উল্লেখ করা হয়েছে, এতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আইনের কোনও লঙ্ঘন হয়নি। ওই আইন অনুসারে, মানবিক সহযোগিতা আটকে দেওয়া দেশগুলোতে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার বিধান রয়েছে।
এসবের প্রতিবাদ জানিয়ে স্টেসি গিলবার্ট বলেছেন, প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার দিনই আমি পদত্যাগের বিষয়টি আমার কার্যালয়কে জানাই।
এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতি বিষয়ক উচ্চ প্রতিনিধি জোসেপ বোরেল বলেছিলেন, ইসরায়েল গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশে বাধা দিচ্ছে এবং তাদের এই কর্মকাণ্ডের প্রমাণও রয়েছে।
বোরেলের মতে, আমি এটিকে অবশ্যই একটি গণহত্যা বলতে পারি। চলমান মানবিক সহায়তা সম্পর্কিত সংকটের কারণ হচ্ছে সীমান্তে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ। যুক্তরাষ্ট্রের পিবিএস টেলিভিশনে তিনি বলেন, ‘যদি মানুষ অনাহারে থাকে। অনাহারে কেন থাকবে? সেখানে ওই লোকদের সাহায্য করার জন্য কোনো মানবিক সহায়তাই নেই? এবং কেন (এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে)? কারণ ইসরায়েল সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করছে এবং মানবিক সহায়তা আসতে দিচ্ছে না। ’
শোষক ও নিপীড়নকারী শাসকদের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন জানানোর ঘটনা আগেও ঘটেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মার্কিন জনসাধারণ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। কিন্তু মার্কিন সরকার মানবতাবিরোধী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর পক্ষাবলম্বন করেছিল। ভিয়েতনামের যুদ্ধেও মার্কিন নাগরিকগণ যু্দ্ধের বিরুদ্ধে ছিল, মার্কিন বর্বরতার বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। কিন্তু মার্কিন সরকারের ভুল নীতির কারণে তারা শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের বড় অংশ এখনো ইসরায়েল সৃষ্ট জেনোসাইডের শিকার সাধারণ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সকল প্রকার মানবিকতাকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। বর্বরতার প্রতি এমন ন্যাক্কারজনক সমর্থনে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে বিশ্ব মানবতা।