যেভাবে সাহাবিদের কোরআন শেখাতেন নবীজি (সা.) 

যেভাবে সাহাবিদের কোরআন শেখাতেন নবীজি (সা.) 

 মো. আবদুল মজিদ মোল্লা

মুসলমানের ধর্মীয় জীবন পরিপালনে বিশুদ্ধ কোরআন তিলাওয়াত অপরিহার্য। কেননা কোরআন তিলাওয়াত স্বয়ং ইবাদত এবং তা নামাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের অংশ। ফকিহ আলেমদের মতে, নামাজ শুদ্ধ হয় এতটুকু পরিমাণ বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শিক্ষা করা ফরজ। আর তা হলো কোনো হরফ বা শব্দ উচ্চারণের সময় এতটুকু বিকৃতি না হওয়া, যাতে অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়।

আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতি (রহ.) বলেন, ‘এ কথা অনস্বীকার্য, উম্মতের জন্য যেভাবে কোরআন বোঝা এবং এর আদেশ-নিষেধ মানা আবশ্যক, ঠিক সেভাবে কোরআনের শব্দ ও অক্ষরগুলো সহিহ-শুদ্ধভাবে পড়া ও উচ্চারণ করাও আবশ্যক; যেভাবে ইলমে কিরাতের ইমামদের মাধ্যমে যুগপরম্পরায় নবীজি থেকে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। (আল ইতকান ফি উলুমিল কোরআন : ১/৩৪৬)

তিলাওয়াত বিশুদ্ধ করা আবশ্যক

বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শিক্ষা করা আবশ্যক। কেননা মহান আল্লাহ বিশুদ্ধভাবে কোরআন তিলাওয়াতের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর কোরআন তিলাওয়াত করো ধীরে ধীরে ও সুস্পষ্টভাবে।

’ (সুরা : মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ৪)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘এভাবে আমি অবতীর্ণ করেছি তোমার হৃদয়কে তা দ্বারা মজবুত করার জন্য এবং তা ক্রমে ক্রমে স্পষ্টভাবে আবৃত্তি করেছি। ’ (সুরা : ফোরকান, আয়াত : ৩২)

উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় আলেমরা বলেন, আয়াতে বর্ণিত ‘তারতিল’ শব্দ দ্বারা তাজবিদ (কোরআন পাঠের নিয়ম-নীতি) ও সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধান উদ্দেশ্য। আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) বলেন, তারতিল হলো হরফের উচ্চারণ বিশুদ্ধ করা এবং ওয়াকফের নিয়ম জানা। সুতরাং বলা যায়, উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ বিশুদ্ধ নিয়মেই তিলাওয়াতের নির্দেশ দিয়েছেন।

বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের মানদণ্ড

কোরআনের প্রতিটি শব্দ, বাক্য, এমনকি তার হরকত পর্যন্ত আল্লাহ কর্তৃক সংরক্ষিত। তাই জিবরাইল (আ.) ঠিক যেভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে কোরআন শিখিয়েছেন সেভাবেই তিনি সাহাবিদের শিক্ষা দিয়েছেন। নবীজি (সা.)-এর শেখানো পদ্ধতিই বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের মানদণ্ড। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এটা সংরক্ষণ ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমারই। সুতরাং যখন আমি তা পাঠ করি তুমি সেই পাঠের অনুসরণ কোরো। অতঃপর এর বিশদ ব্যাখ্যার দায়িত্ব আমারই। ’ (সুরা : কিয়ামা, আয়াত : ১৭-১৯)

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোরআন মাজিদ উত্তমরূপে তিলাওয়াত করতে চায়—যেভাবে তা নাজিল হয়েছে, সে যেন ইবনু উম্মে আবদের পাঠ মোতাবেক তিলাওয়াত করে। ’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, আয়াত : ১৩৮)

তিলাওয়াত শেখানো নবীজির দায়িত্ব 

কোরআন তিলাওয়াত করা এবং তা শেখানো ছিল নবীজি (সা.)-এর অন্যতম দায়িত্ব। মহান আল্লাহ এই মর্মে নির্দেশ দেন যে ‘তুমি তিলাওয়াত করো কিতাব থেকে, যা তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়। ’ (সুরা : আনকাবুত, আয়াত : ৪৫)

আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ কোরআন তিলাওয়াত করার এবং তা অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়ার (শেখানোর) নির্দেশ দিয়েছেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির)

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষাদান পদ্ধতি

রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের কোরআন শিখিয়ে আল্লাহর নির্দেশ পালন করেছেন। তিনি কোরআন শিখিয়েছেন এর প্রতিটি শব্দ-বাক্য উচ্চারণসহ এবং অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে। যেমন আনাস (রা.)-কে নবী (সা.)-এর ‘কিরাআত’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নবী (সা.) দীর্ঘ করতেন। এরপর তিনি ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ তিলাওয়াত করে শোনালেন এবং তিনি বললেন, নবী (সা.) ‘বিসমিল্লাহ’, ‘আর রহমান’, ‘আর রাহিম’ পড়ার সময় দীর্ঘায়িত করতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫০৪৬)

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার হাত তাঁর উভয় হাতের মধ্যে রেখে আমাকে এমনভাবে তাশাহুদ শিখিয়েছেন, যেভাবে তিনি আমাকে কোরআনের সুরা শেখাতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬২৬৫)

তিলাওয়াত বিশুদ্ধ করার পুরস্কার

পবিত্র কোরআনের তিলাওয়াত বিশুদ্ধ করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। এ কাজে যার চেষ্টা ও শ্রম যত বেশি হবে, আল্লাহর দরবারে তার মর্যাদা তত বেশি হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোরআন পাঠে দক্ষ ব্যক্তি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ফেরেশতাদের সঙ্গী হবে। আর যে ব্যক্তি কোরআন পড়ার সময় আটকে যায় এবং কষ্ট করে তিলাওয়াত করে তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব। ’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১৪৫৪)

রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা সুললিত কণ্ঠে কোরআন পড়ো, কেননা তা কোরআনের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দেয়। ’ (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ২১৪১)

সহযোগিতা করা সবার দায়িত্ব

বিশুদ্ধ তিলাওয়াত শেখার কাজে সহযোগিতা করা এবং শিক্ষার্থীরা যদি শেখার সময় ভুল করে তবে তা শুধরে দেওয়া সবার দায়িত্ব। শিক্ষার্থী যদি এমন কোনো ভুল করে, যার মাধ্যমে অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়, তবে তা শুধরে দেওয়া ওয়াজিব। আর যদি অর্থে বিকৃতি না আসে তবে শুধরে দেওয়া মুস্তাহাব ও নৈতিক দায়িত্ব। তবে মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীকে এমন ভাষায় সতর্ক করা যাবে না, যাতে তার মন ভেঙে যায় বা কোরআন শেখার সাহস হারিয়ে ফেলে। (লিকাউল বাবিল মাফতুহ : ১৪/১০৪)

আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা

তিলাওয়াত বিশুদ্ধ করতে মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা আবশ্যক। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমার প্রতি আল্লাহর ওহি সম্পূর্ণ হওয়ার আগে কোরআন পাঠে তুমি ত্বরা কোরো না এবং বোলো, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে জ্ঞানে সমৃদ্ধ কোরো। ’ (সুরা : তাহা, আয়াত : ১১৪)

কোরআনচর্চা না করার হুঁশিয়ারি

কোরআনের তিলাওয়াত শুদ্ধ হয় না বলে তার চর্চা ছেড়ে দেওয়া নিষিদ্ধ। কেননা মহানবী (সা.) কোরআন পরিত্যাগকারীদের ব্যাপারে অনুযোগ করে বলেছেন, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমার সম্প্রদায় তো এই কোরআনকে পরিত্যাজ্য মনে করে। ’ (সুরা : ফোরকান, আয়াত : ৩০)

উল্লিখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) লেখেন, ‘মক্কার কুরাইশরা কোরআন তিলাওয়াতের সময় শোরগোল ও হৈচৈ করত এবং তা শ্রবণ করত না—এটা কোরআন পরিত্যাগ। কোরআনের ওপর আমল ছেড়ে দেওয়া এবং তা মুখস্থ না করাও কোরআন পরিত্যাগ। কোরআনের প্রতি ঈমান ত্যাগ করা, তা সত্যায়ন না করা, কোরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা না করা, কোরআনের আদেশ ও নিষেধ অনুসরণ না করাও কোরআন পরিত্যাগ করা। কোরআনের পরিবর্তে কবিতা, গদ্য, গান, হাসি-কৌতুক, গালগল্প ইত্যাদির প্রতি ঝুঁকে যাওয়াও কোরআন পরিত্যাগ। ’ (তাফসিরে ইবনে কাসির)

আল্লাহ সবাইকে বিশুদ্ধভাবে কোরআন তিলাওয়াতের তাওফিক দিন। আমিন।