নতুন বাজেটে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা বড় চ্যালেঞ্জ

প্রতীকী ছবি

নতুন বাজেটে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা বড় চ্যালেঞ্জ

অনলাইন ডেস্ক

গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের আগে জনগণের উদ্দেশে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ যে ইশতেহার ঘোষণা করে, তাতে ১১টি বিশেষ অগ্রাধিকারের তালিকায় এক নম্বরে ছিল দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং নতুন সরকারের প্রথম বাজেট আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। নতুন অর্থমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কবল থেকে মানুষকে রক্ষা করা। অর্থনীতির সংকট সামাল দিতে আইএমএফের ঋণের শর্ত মেনে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাগে আনা যথেষ্ট কঠিন।

বাজেট পেশের কয়েক দিন আগে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির যে হালনাগাদ তথ্য দিয়েছে, তাতে অর্থমন্ত্রীর স্বস্তিতে থাকার কথা নয়। সার্বিক মূল্যস্ফীতি গত মে মাসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। আর খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। গত এক বছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

এ রকম বাস্তবতায় অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করতে যাচ্ছেন।

অথচ তাঁকেই আইএমএফকে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে, ভর্তুকির চাপ কমাতে এক বছরে চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে। আজ যে বাজেট তিনি দিচ্ছেন, তাতে দ্রব্যমূল্যের চাপ কমানোর অঙ্গীকার করবেন। কিন্তু রাজস্ব আয় বাড়াতে যেসব পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন, তাতে পণ্যের মূল্য বাড়তে পারে– এমন পদক্ষেপ আছে। অবশ্য রাজস্ব সংগ্রহ না বাড়িয়েও উপায় নেই। এই উভয় সংকটে পড়ে মূল্যস্ফীতির চাপ তিনি কীভাবে সামাল দেবেন, তা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে, বাজারমূল্য এবং মানুষের আয়ের মধ্যে সংগতি প্রতিষ্ঠা করা হবে। বিবিএসের আরেক হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, ওই সংগতি প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না। বিবিএসের হিসাবে, জাতীয় পর্যায়ে গত মে মাসে মজুরি বেড়েছে এক বছর আগের তুলনায় ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এর মানে, সাধারণ শ্রমিকদের মজুরি যা বেড়েছে, তার চেয়ে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি হারে বেড়েছে। আর এসব মানুষের আয়ের বেশির ভাগই নির্দিষ্ট কিছু খাদ্য কিনতে শেষ হয়ে যায়। তাদের জন্য মূল্যস্ফীতির হার নিঃসন্দেহে বেশি। বিভিন্ন গবেষণায় তা উঠেও এসেছে।  
বর্তমান সরকারের আরেক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানো। সরকারের বাজেট পেশের এক দিন আগে পাওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি ব্যাংকগুলোতে গত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। আর্থিক খাতের ভঙ্গুর পরিস্থিতির উন্নতি করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

এদিকে নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও নতুন বাজেটে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করছেন অর্থমন্ত্রী। ইশতেহারে উল্লেখ রয়েছে, আর্থিক লেনদেন-সংক্রান্ত অপরাধ কঠোরভাবে দমন করা হবে। কিন্তু বাজেটে এই কঠোর অবস্থান রাখতে পারছে না সরকার। কারণ, এখান থেকে কর আদায় করে রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের চেষ্টা করতে হবে।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে কর্ম উপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির ধীরগতির এই সময়ে এবং শিক্ষা খাতে অপর্যাপ্ত ব্যয় দিয়ে এ অঙ্গীকার পূরণ কঠিন। নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করার প্রতিশ্রুতি পূরণও যথেষ্ট কঠিন। কারণ স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন বরাদ্দও সীমিত। এর চেয়েও বড় কথা, স্বাস্থ্য খাতে যতটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার পুরোটা খরচ করা সম্ভব হয় না। আগামী অর্থবছরে এ পরিস্থিতির উত্তরণ হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

মতামত জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, জানুয়ারিতে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আগের সরকারেরও দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরের পুরোটা সময়জুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, সর্বশেষ গত মে মাসে খাদ্য মূলস্ফীতি প্রায় ১১ শতাংশ।

বিআইডিএস বলছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন অন্তত ১৫ শতাংশ। নতুন বাজেটে সরকার আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কমাতে হবে। এর আগে ১৫ বছর ধরে অর্থনীতিতে উচ্চ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য এক বছর প্রবৃদ্ধি কম হলে তা মেনে নেওয়াই ভালো। এর ফলে হয়তো বিনিয়োগ কমে কর্মসংস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকবে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প চাঙ্গা করার বিশেষ পদক্ষেপ নিলে কর্মসংস্থানের সেই আশঙ্কা দূর হবে। এতে মানুষের আয়রোজগার বাড়বে, বৈষম্য কমবে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য অন্তত ৫০০ কোটি টাকার ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড গঠন করতে হবে।

তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষের আয় মূল্যস্ফীতির সমান বা তার চেয়ে বেশি হারে না বাড়বে, ততক্ষণ তারা স্বস্তি পাবে না। মূল্যস্ফীতি কমাতে হাতেকলমে বাস্তব উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু মুখে বললে হবে না। নতুন বাজেটে সরকার এ জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়, তা এখন দেখার বিষয়। তাঁর মতে, মূল্যস্ফীতি কমাতে চাইলে নতুন অর্থবছরে কোনো অবস্থাতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বা নোট ছাপিয়ে ঋণ নেওয়া উচিত হবে না। বাজেট ঘাটতি পূরণে জনসাধারণের কাছ থেকে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ বাড়াতে হবে। কেননা, ব্যাংক থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিলে তা বেসরকারি খাতে ঋণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আবার বিদেশি ঋণের ওপর বেশি নির্ভরশীল হওয়া ঠিক হবে না। কেননা, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমলে দায়দেনা পরিশোধে চাপ আরও বাড়বে।

নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবে কতটুকু রয়েছে– এমন প্রশ্নের উত্তরে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, দুদক সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কর্মকাণ্ড শুরু করতে গেলে সরকারের অনুমোদন নেওয়ার নিয়ম যেদিন থেকে শুরু হয়েছে, সেদিন থেকে দুর্নীতি লাগামহীন হয়েছে। এই নিয়ম বাতিল করতে হবে। তিনি বলেন, সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ এবং সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ ভালোভাবে খতিয়ে দেখা হোক। ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে দুর্নীতির আঁতাত ভেঙে ফেলা হোক। বেসিক ব্যাংকে ঘটে যাওয়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হোক। এমন কিছু দৃষ্টান্ত তৈরি করলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির যতাযথ বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।

নতুন বাজেটে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে এবং এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অনানুষ্ঠানিক, রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে যা মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনীতা রয়েছে। তবে শুধু ১৫ শতাংশ কর নিয়ে সাদা করার সুযোগ দিলে তাতে তেমন কর আদায় হবে না। ঘোষণা থাকতে হবে যে, ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কালো টাকা সাদা না করলে পরবর্তী সময়ে এ ধরনের সম্পত্তি বা আয় রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে। তবে কালো টাকার উৎস বন্ধ করতে হলে মুদ্রা পাচার বন্ধ করতে হবে। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। একই সঙ্গে বন্ধ করতে হবে কর ফাঁকি।

news24bd.tv/ab