রাজত্ব, সম্মান, ক্ষমতা হলো মহান আল্লাহর নিয়ামত। তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন, আর যার কাছ থেকে ইচ্ছা তা ছিনিয়ে নেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘বলুন, হে সার্বভৌম শক্তির মালিক আল্লাহ, আপনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব প্রদান করেন এবং যার থেকে ইচ্ছা রাজত্ব কেড়ে নেন; যাকে ইচ্ছা আপনি সম্মানিত করেন আর যাকে ইচ্ছা আপনি হীন করেন। কল্যাণ আপনারই হাতে।
তাই মহান আল্লাহ কাউকে এই নিয়ামতগুলো দান করলে তার উচিত এই নিয়ামতগুলোর যথাযথ শুকরিয়া আদায় করা। সর্বাবস্থায় মহান আল্লাহকে খুশি করার চেষ্টা করা। নিম্নে শাসকদের এমন কিছু গুণ তুলে ধরা হলো, যেগুলো মহান আল্লাহ পছন্দ করেন—
বিনয় ও উদারতা: বিনয়, উদারতা ও নম্রতা মহৎ গুণ।
অনন্য এ গুণের মাধ্যমে খুব সহজেই আল্লাহর ভালোবাসার পাশাপাশি নাগরিকদের ভালোবাসাও অর্জন করা যায়। শত্রুকেও মুহূর্তে কাছে টানা যায় একটুখানি কোমলতার মাধ্যমে।
আবু মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এলো। তিনি লোকটির সঙ্গে কথা বলেন।
এ সময় তার কাঁধের গোশত (ভয়ে) কাঁপছিল। তিনি তাকে বলেন, তুমি শান্ত হও, স্বাভাবিক হও। কারণ আমি কোনো রাজা-বাদশা নই; বরং আমি শুকনো গোশত খেয়ে জীবনধারিণী এক নারীর পুত্র। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৩১২)
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সফল রাষ্ট্রনায়ক আমাদের প্রিয় নবীর এই বিনয়, উদারতা ও নম্রতা ছিল মজ্জাগত। তাঁর এই মহান গুণের কারণে জাহিলি যুগের চরম অহংকারী মানুষের হৃদয়েও ইসলামের সৌন্দর্য গেঁথে ছিল।
ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন তিনি। যার প্রমাণ মক্কা বিজয়ের দিন। সেদিন নবীজি এবং তাঁর প্রিয় সাহাবাদের আনন্দের শেষ ছিল না। কিন্তু সেই মুহূর্তেও তিনি অহংবোধ প্রকাশ না করে বিনয়ের বার্তা ছড়িয়েছেন। সে সময়ের সাক্ষী আবদুল্লাহ ইবনে আবু বকর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) আল্লাহপ্রদত্ত বিজয় দেখে বিনয়ে মাথা এত নিচু করে ছিলেন, যেন তাঁর দাড়ি বাহনজন্তুর পিঠ স্পর্শ করছিল। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ২/৪০৫)
তা ছাড়া যারা সর্বদা ইসলাম ধ্বংসের চিন্তায় লিপ্ত থাকত, নবীজিকে অশ্লীল ভাষায় অজস্র গালাগাল করত, বিষাক্ত বর্শা হাতে তাঁকে হত্যার চেষ্টায় লেগে থাকত এবং মাতৃভূমি ত্যাগ করতে যারা বাধ্য করেছিল, তাদেরও সেদিন ক্ষমা ঘোষণা করে নবীজি এক নাতিদীর্ঘ হৃদয়গ্রাহী ভাষণে বলেছিলেন, ‘তোমাদের প্রতি আজ কোনো অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা সবাই মুক্ত। ’ শুধু তা-ই নয়, কাফির নেতা আবু সুফিয়ানের গৃহে যে ব্যক্তি আশ্রয় নেবে, তাকেও তিনি ক্ষমা করেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় নেবে, সে নিরাপদ থাকবে। ’ (আর-রাহিকুল মাখতুম : পৃ. ৪০৫, ৪০১)
তাই অহংকার, আত্মগরিমা ও বড়ত্ব প্রকাশের এই সময়ে মহানবী (সা.)-এর অনন্য এ আদর্শ আমাদের ব্যক্তিগত, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে পুরোপুরি চর্চা করা উচিত। তাহলেই পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়ে শান্তিময় সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে উঠবে।
ন্যায়পরায়ণতা: মহান আল্লাহ নিজেই একজন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ। কিয়ামতের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে গোটা সৃষ্টিজগতের সামনে তিনি ইনসাফ ও ন্যায়বিচারের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পেশ করবেন। যেমনিভাবে তিনি দুনিয়াতে কারো ওপর সামান্যতম জুলুম করেননি, তেমনি পরকালেও কারো প্রতি বিন্দু পরিমাণ অবিচার করবেন না। এ ব্যপারে কোরআনে আল্লাহ নিজেই ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ কারো ওপর অনুপরিমাণও জুুলুম করেন না। ’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৪৪)
আর যারা ন্যায় ও ইনসাফের সঙ্গে বিচারকার্য পরিচালনা করে, তাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর ভালোবাসা। ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তারা ফিরে আসে তবে উভয় দলের মধ্যে ন্যায়ের সঙ্গে মীমাংসা করে দাও এবং সুবিচার করো, নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবসেন। ’ (সুরা : হুজুরাত, আয়াত : ৯)
এ কারণে প্রতিটি শাসকেরই উচিত, সাধ্যমতো ইনসাফ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। কারণ মহান আল্লাহ অন্যায়-অত্যাচার পছন্দ করেন না। আল্লাহর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হলো, অত্যাচারী। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘চার ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা অপছন্দ করেন— ১. অধিক হারে শপথকারী বিক্রেতা; ২. অহংকারী দরিদ্র; ৩. বৃদ্ধ ব্যভিচারী এবং ৪. অত্যাচারী শাসক। (নাসায়ি, হাদিস : ২৫৭৬)
বিশ্বস্ততা: আমানত শব্দটি আরবি হলেও আমাদের কাছে এর অর্থ অনেক পরিচিত। সাধারণত কারো কাছে কোনো অর্থ-সম্পদ, বস্তুসামগ্রী গচ্ছিত রাখাকে আমরা আমানত বুঝি। কিন্তু আমানতের প্রায়োগিক ক্ষেত্র অনেক ব্যাপক। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, তথা মানবজীবনের প্রতিটি স্তরে প্রতিটি বিষয়ে আমানত রক্ষার ভিন্ন ভিন্ন অনুষঙ্গ রয়েছে। তাই ইসলামে আমানত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পবিত্র কোরআন মাজিদে আল্লাহ তাআলা যাদের সফলতার স্বীকৃতি দিয়েছেন তাদের অন্যতম হলেন, যারা আমানতের ব্যাপারে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘এরা সেই লোক, যারা আমানতের প্রতি লক্ষ রাখে এবং স্বীয় অঙ্গীকার হেফাজত করে। ’ (সুরা : মুমিনুন, আয়াত : ৮)
আমানত রক্ষা করা নবীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও বিশেষ গুণ। এই গুণের শ্রেষ্ঠ অধিকারী ছিলেন ইসলামের প্রথম রাষ্ট্রনায়ক আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। নবুয়তপ্রাপ্তির আগেই তিনি সবার কাছে ‘আল আমিন’ তথা বিশ্বস্ত হিসেবে উপাধি পেয়েছিলেন। সুতরাং সুন্দর সমাজ ও স্থিতিশীল রাষ্ট্র বিনির্মাণে একজন মুসলিম শাসকের বিশ্বস্ততার গুণ অর্জনের বিকল্প নেই। মহান আল্লাহ পৃথিবীর সমস্ত শাসককে এই গুণগুলো অর্জনের তাওফিক দান করুন।
news24bd.tv/আইএএম