ছয় হাজার টাকায় মেলে কুমারী মেয়ে!

বাচ্ছারা সম্প্রদায়ের মেয়েরা

ছয় হাজার টাকায় মেলে কুমারী মেয়ে!

নিউজ টোয়েন্টিফোর ডেস্ক

ভারতের পশ্চাৎপদ বাচ্ছারা সম্প্রদায়ের রিতী এটি। এই সম্প্রদায়ে শত বছর ধরে একটি প্রথা প্রচলিত আছে। সেখানে সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের পরিবারে জন্ম নেওয়া বড় মেয়েকে পতিতাবৃত্তিতে ঠেলে দেয়।

আর এই পতিতা বাণিজ্য শুরু হয় মেয়ের মাত্র ১০ থেকে ১২ বছর বয়সেই।

পরিবারের পুরুষ সদস্য থেকে শুরু করে বাকি সবার জীবন ওই মেয়ের আয়ের ওপরই নির্ভর করে। মেয়েটির আপন বাবা অথবা ভাই দালাল হিসেবে কাজ করে। যখন এই মেয়েটির বয়স হয়ে যায়, তখন তার স্থলে জায়গা করে নেয় তারই ছোট বোন।

এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পালন হয়ে আসছে এ প্রথা।

এই সম্প্রদায়ে বিয়েটাও হয় ভিন্নভাবে। এখানে বিয়ে দেওয়ার সময় কনের পরিবার বর পক্ষের কাছ থেকে বড় অংকের অর্থ দাবি করে।

হিনা দেশটির পশ্চাৎপদ বাচ্ছারা সম্প্রদায়ের একজন সদস্য। হিনাকে জন্মের পর থেকে এই ধরণের জীবনের জন্য প্রস্তুত করা হয় এবং তারপরে খুব অল্প বয়সেই তাকে এই কাজে জোরপূর্বক ঠেলে দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, আমাকে যখন এই পেশায় ঠেলে দেওয়া হয়। তখন আমার বয়স মাত্র ১৫ বছর। পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে আমাকে আমার মা ও নানীর দেখানো পথেই চলতে হয়েছে। প্রতিদিন তার কাছে গ্রামীণ ধনী থেকে শুরু করে ট্রাক চালক পর্যন্ত একাধিক খদ্দের আসত।

‘১৮ বছর বয়সে, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার সাথে কত অন্যায় হয়েছে এবং ভীষণ রাগও হয়েছিল তখন। কিন্তু এ ছাড়া আমার আর কি-ই বা করার ছিল? যদি আমি এভাবে উপার্জন না করতাম তাহলে আমার পরিবার কীভাবে বাঁচত?’

ভারতের বাচ্ছারা সম্প্রদায়ের মানুষেরা সাধারণত ভীষণ দারিদ্র্যপীড়িত। পরিবারের জন্য উপার্জন এবং আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে তারা নারী সদস্যদের ওপর নির্ভর করে।

স্থানীয় এনজিওর সমন্বয়ক আকাশ চৌহানের মতে, এই পেশার আসা এক তৃতীয়াংশের বেশি মেয়ে বয়সে অনেক ছোট।

বাচ্ছারা, একসময় যাযাবর উপজাতি গোষ্ঠী ছিল। পরে তারা কেন্দ্রীয় রাজ্য মধ্য প্রদেশের তিনটি জেলায় ছড়িয়ে যায়। এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা বেশিরভাগ গ্রামীণ এলাকা বা মহাসড়কের পাশে থাকে, যেখানে ট্রাক ড্রাইভাররা বিরতি নিয়ে থাকে।

যে কৌশলে চলছে এই বাণিজ্য: অল্প বয়সী মেয়েরা, যারা কিনা স্থানীয়ভাবে ‘খেলোয়াড়’ হিসেবে পরিচিত, তারা দলবেঁধে না হলে একলা একলাই গ্রাহকদের অনুরোধ করার জন্য অপেক্ষা করে।

এছাড়া পথের দুই পাশে প্রায়শই ছোট দোকানের মতো বুথ থাকে, সেখানে মেয়েটির দালাল হিসেবে তার ভাই না হলে বাবা, খদ্দেরকে নিমন্ত্রণ জানায়।

তারা চালকদের সাথে একটি চুক্তি করে, যা সাধারণত গ্রাহক প্রতি ১০০ থেকে ২০০ ভারতীয় রুপি হয়ে থাকে। ডলারের হিসাবে সেটা দেড় থেকে তিন ডলারেরও কম।

স্থানীয়দের মতে, একটি কুমারী মেয়ের জন্য সর্বোচ্চ দাম পাওয়া যায়। খদ্দের প্রতি সেটা পাঁচ হাজার রুপি বা ৭২ ডলার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

হিনা বলেন, প্রতিদিন, দিনের বেলা প্রায় চার থেকে পাঁচজন পুরুষ আসে। রাতের বেলা, আমরা হোটেল বা কাছাকাছি অন্য কোথাও যাই। সবসময় সংক্রমিত রোগে ভোগার ঝুঁকি ছিল।

তারা জানিয়েছে যে এই সম্প্রদায়ের সাড়ে পাঁচ হাজার সদস্যকে পাওয়া গেছে যারা কিনা এইচআইভি পজিটিভ। আক্রান্তের হার সম্প্রদায়ের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ।

এসব খেলোয়াড়দের অনেক মেয়েরা গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এই পেশায় আসায় কয়েক বছরের মাথায় হিনা একটি মেয়ে শিশুর জন্ম দেয়।

মা হওয়ার পরও তাকে আরও বেশি বেশি পরিশ্রম করার জন্য চাপ দেওয়া হতো।

অনেক মেয়েরা এক পর্যায়ে গর্ভবতী হয়ে পড়লেও তাদের এই কাজ চালিয়ে যেতে হয়। সন্তানদের যত্ন নেওয়ার জন্য আরও অর্থ উপার্জন করতে চাপ দেওয়া হয় তাদের, জানান হিনা।

একজন যৌনকর্মী হওয়ার অর্থ হচ্ছে যে সে তার সম্প্রদায়ের মধ্যে কাউকে বিয়ে করার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

অবশেষে, হিনা স্থানীয় এনজিও'র সহায়তায় এই প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন।

‘এই জঘন্য প্রথার মধ্য দিয়ে যে মেয়েটি যায়,শুধুমাত্র সেই, এই সংগ্রামটা বুঝতে পারে। আমি জানি এটার অনুভূতিটা কেমন। তাই এই প্রথা চিরতরে উপড়ে দিতে আমি সহায়তা করে যাব। ’

সামাজিকভাবে অনুমোদিত এই প্রথার উৎস নিয়ে অনেক তত্ত্ব আছে। তাদের মধ্যে একজন জানায়, কীভাবে নরমেডিক উপজাতিদের বাহিরাগত হিসেবে অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। পরে তারা এই যৌন বাণিজ্যকে দরিদ্রতা কাটিয়ে ওঠার উপায় বলে মনে করতে থাকে।

বাচ্ছারাসদের এই পতিতাবৃত্তির প্রথা পরিহারের উদ্দেশ্যে ১৯৯৩ সালে একটি প্রকল্প চালু করা হয়। কিন্তু এটি এখনও সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করা হয়নি।

নারী ও শিশু কল্যাণ বিভাগের কর্মকর্তা রাজেন্দ্র মহাজন বলেন, প্রতি বছর আমরা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার জন্য অলাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্যে প্রতিবছর বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকি, কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের মানদণ্ডগুলো পূরণ করতে পারেনি।

জাবালি নামের এই প্রকল্পটি মূলত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সচেতনতার মাধ্যমে এই নারীদের পুনর্বাসনের উপর জোর দেবে।

এতে সরকারের সাহায্যসহ বা ছাড়া, পরিবর্তন ধীরে ধীরে হলেও আসছে।

এখন সম্প্রদায়ের অনেক অল্পবয়সী মেয়ে এই প্রথাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অন্যত্র চাকরি খুঁজে নিচ্ছেন বা আরও শিক্ষা গ্রহণ করছে। এছাড়া স্থানীয় কিছু উদ্যোগও সাহায্য প্রদান করছে।

হিনাও এখন এ ধরণের উদ্যোগের একটি অংশ- এই উদ্যোগের আওতায় তাকে ২০১৬ সালে উদ্ধার করা হয়েছিল।

হিনা বলেন, আমি অন্যান্য মেয়েদের বোঝাই যে তারা এখানে এলে সাহায্য পাবে এবং এই পেশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। আমি এজন্য আমার সাধ্যমত যা পারি, করব।

অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয়ভাবে একটি কোচিং সেন্টার পরিচালনা করে। যেখানে ভিক্টিমদের বিনামূল্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

‘এই মেয়েদের জোরপূর্বক এই পেশায় থাকতে বাধ্য হয়েছে কারণ তাদের চাকরির অন্য কোনো উপায় নেই। শুধু শিক্ষা তাদের অগ্রসর হতে সাহায্য করতে পারে; বলছেন হিনা।

সূত্র: বিবিসি

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর