হায়রে বাসন্তী! এত করেও মন পেলি না

সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

হায়রে বাসন্তী! এত করেও মন পেলি না

নিউজ টোয়েন্টিফোর ডেস্ক

বৃষ্টি-বাদলের দিনে অনেক কিছুই উঁকি দেয় মনের জানালায়। ‘সাগরিকা’ ছবির একটি সংলাপ মনের ভেতরে বার বার ঘুরপাক খাচ্ছিল। সাগরিকার ভূমিকায় অভিনয় করা সুচিত্রা সেন বাসন্তী সেজে অনেক করেন অরুণ চরিত্রের উত্তমের জন্য। কিন্তু উত্তমের মন পড়ে আছে সাগরিকাতে।

তখন সুচিত্রা একদিন বললেন, হায়রে বাসন্তী! এত করেও মন পেলি না। এসব ভাবনার মাঝে মেয়ের ফোন আসে। মেয়ে বলল, বাবা, তুমি আর কারও বিরুদ্ধে লিখতে যেও না। আমি বললাম, কার বিরুদ্ধে আবার লিখলাম? কোথায় দেখলি? মেয়ের জবাব, পত্রিকার কথা বলছি না।
সামাজিক গণমাধ্যমে সম্প্রতি একজন রাজনীতিবিদকে নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছ। এতে তুমি বলেছ, তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছিলেন। অনেক বই লিখেছেন জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়াকে নিয়ে। তিনি এখন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। আমি বললাম, বাবা, ঘটনা সত্য। ’৭২ সালে যেসব কর্মকর্তার চাকরি গিয়েছিল পাকিস্তানের পক্ষে থাকার কারণে তিনি তাদের একজন। মেয়ে আবারও বলল, তাতে তোমার সমস্যা কী? তিনি তো তোমাকে নিশ্চয়ই ভালো জানেন। ঢাকা ক্লাব কিংবা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা হয়। তিনি তোমার সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলেন। তোমার কী দরকার? তিনি এতদিন জিয়া-খালেদাকে নিয়ে বই লিখেছেন, এটা তো আওয়ামী লীগের সবাই জানেন। আর জেনেশুনে তাকে নিয়েছে। সবকিছু রাজনীতি। দেখবে তিনি আগামীতে বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনাকে নিয়ে লিখে প্রশংসিত হবেন। মেয়েকে বললাম, ঠিক আছে বাবা, আগামীতে খেয়াল রাখব। সতর্ক থাকব। আর এখন থেকে সামাজিক গণমাধ্যমে শুধু নিজের ছবি দেব। আর কিছু না। মেয়ে বলল, না, নিজের ছবিও কম দেবে। এত কী? বললাম, আচ্ছা মেনে নিলাম তোমার কথা। মনটা উদাসী হয়ে উঠল। ভাবলাম, মেয়ে তো ঠিকই বলেছে। আমার এত চিন্তার কী আছে। আমি বলেছিলাম, আজাদ চৌধুরীরা ঠাঁই পান না। জিয়া, খালেদা জিয়ার বইয়ের লেখক কেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হবেন?

আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহ্যবাহী দল। এ দলে চিন্তাবিদের অভাব নেই। ক্ষমতাসীন দলকে সবাইকে নিয়েই হয়তো চলতে হয়। এসব নিয়ে আমার  কথা বলার কী দরকার? তা ছাড়া এখানে এখন কথা বলে কোনো লাভও নেই। সরকারি দল চলে বাতাসের বেগে। আমরা যা বলি তার বিপরীত হয় সবকিছু। ইতিহাসের মেরুকরণে এখন অনেক কিছু বদলে গেছে। বিরোধী দলে থাকলে এক নীতি, সরকারে আরেক। এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ তার নিজস্ব চিন্তা ও নতুন ভাবনা নিয়ে এগিয়ে চলছে। এগিয়ে যাক। শুভ কামনা সবার জন্য। এখানে ’৭২ সালে কে সরকারি চাকরি থেকে বিতাড়িত হলেন, কে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছিলেন- এসব আলোচনার কী দরকার? তার চেয়ে পুরনো দিনের সিনেমা, রাজনীতি, সমাজ নিয়ে থাকি। দরকার পড়লে উত্তম-সুচিত্রার ছবিগুলো আবার দেখব। বার বার দেখব। তার পরও কাজ না থাকলে দেশ-বিদেশ হেঁটে বেড়াব। জীবনের এই প্রান্তে এসে বৃদ্ধাশ্রম বানিয়ে চলে যাব গ্রামে। শেষ বয়সে গিয়ে বন্ধুবান্ধবকে ডাকব সেই আশ্রমে। সবাই মিলে হারিয়ে যাব নস্টালজিয়ায়।

আজকাল অনেক কিছুই আর ভালো লাগে না। নিজেকে সেকেলে সেকেলে মনে হয়। যুগের সঙ্গে চলতে পারছি না। অতি-আধুনিকতার ঢেউ আছড়ে পড়ছে চারপাশে। রাজনীতি, সমাজ সবকিছু বদলে গেছে। মানুষও বদলে গেছে। এখন কোনো কিছুই কাউকে স্পর্শ করে না। শুধু এই নগরী নয়, মফস্বল শহরগুলো বিজ্ঞানের ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে। বন্যার মতো সামাজিক অপরাধের জোয়ার চলছে। অপরাধীদের নিয়ে কেউ কাউকে কিছু বলতে পারছে না। কারণ সবাই এখন সরকারি দল। সবাই সরকারের পক্ষে। অন্য দলের লোকজন এখন আর মাঠে-ঘাটে চোখে পড়ে না। চারদিকে তাকালে শুধু একটি দলই চোখে পড়ে। সেদিন গ্রামে গিয়েছিলাম। গ্রামগুলো আগের মতো নেই। দাপুটে মানুষ সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। সাধারণ মানুষ বড্ড অসহায়। নিরীহ আওয়ামী লীগ কর্মীদের মাঝে রয়েছে রক্তক্ষরণ। এসব ভাবনা ঠাঁই দিতে ইচ্ছা করে না। তবু অনেক কিছু মেনে নিতে কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে মনে হয় অনেক তো হলো, আর কত? ছোট্ট এই জীবনে মৃত্যুকে বার বার কাছ থেকে দেখেছি। উপলব্ধি করেছি। আবার বেঁচে থাকার আনন্দটুকু ধারণ করে শ্বাস নিয়ে কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করেছি সৃষ্টিকর্তার কাছে। মনে হয়েছে জীবন কত সুন্দর। এই সুন্দর জীবনে বেঁচে থাকার আনন্দই আলাদা। আমাদের প্রিয় মানুষজন চলে যাচ্ছেন। আমরা তো বেঁচে আছি। এ কারণে একসঙ্গে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া মানুষজনের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হলে নস্টালজিক হই। আপ্লুত হই। সমাজ ও রাজনীতিতে এখন আর আবেগের ঠাঁই নেই। রাজনীতিতেও একসময় আবেগ ছিল, দুঃখ ছিল, কষ্ট ছিল। তার মাঝে কাজ করার একটা আনন্দ ছিল। এখন শুধুই ক্ষমতার ভোগ-উপভোগ। আবেগের কোনো ঠাঁই নেই। একসময় আবেগের প্রকাশ ঘটত চিঠিতে, কবিতায়। পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন আমাদের জমানায় অনেকের মুখস্থ ছিল। সাগরিকা ছবিতে সুচিত্রা সেনের চিঠি আর উত্তম কুমারের জবাবে উচ্চমাত্রার সাহিত্য ছিল। এখনো আকুল হই সাগরিকা ছবি নিয়ে। গরিব ঘরের সন্তান অরুণ। শহরে এক বাড়িতে লজিং থেকে ডাক্তারি পাস করেন। সেই বাড়ির কন্যা প্রেমে পড়েন অরুণের। অরুণ তাকে দেখত বোনের চোখে। এরই মধ্যে একদিন মেডিকেলের এক ছাত্রীর সঙ্গে ধাক্কা লাগে অরুণের। অহংকারী মেয়েটির নাম সাগরিকা। রূপের ছটায় আগুন ধরিয়ে দেয়। দেমাগে মাটিতে পা পড়ে না মেয়েটির। প্রথম দেখাতে ঘোর লেগে যায় অরুণের। আর যান কোথায়? অপমানে ক্রুশবিদ্ধ করে তাকে। সেই অপমানের সঙ্গে যোগ হয় বিলেতে উচ্চশিক্ষায় যাওয়ার জন্য হঠাৎ সরকারি স্কলারশিপ বাতিল। ক্ষত-বিক্ষত অরুণ বিলেতে পড়তে যেতে গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে যান জমি বন্ধক দিতে। জমি বন্ধকের পরিবর্তে নিজের কন্যাকে গছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন ধনাঢ্য ব্যক্তি। অরুণ তাতে রাজি।

অরুণ চলে যান বিলেতে। সেই ধনাঢ্য ব্যক্তিটি ছিলেন সাগরিকার চাচা। তাই গ্রাম্য মেয়ে বাসন্তীকে শহরে এনে আধুনিকা করার দায়িত্ব দেন সাগরিকাকে। সব শুনে সাগরিকা রাজি হন। এর মাঝে জানতে পারেন, সেই অরুণের জন্যই বাসন্তীকে ঠিকঠাক করতে হবে তাকে। এর মাঝে বিলেত থেকে চিঠি আসে অরুণের। বাসন্তী চিঠি লিখতে জানেন না। তাই চিঠির উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে সাগরিকার ওপর। সাগরিকা চিঠি লিখতে থাকেন নিজের মতো করে। অরুণ চমকে ওঠেন চিঠির ভাষা পড়ে। এই ভাষা যেন তার চিরচেনা। এভাবেই কাহিনি গড়ায়। চিঠির আবেগে ভেসে যান দুজন। জমে ওঠে এক কঠিন প্রেমের অধ্যায়। কবিতার মতো পত্রলিখন এগিয়ে যেতে থাকে। ভালোবাসার স্রোতে হারিয়ে যান সাগরিকা। দুঃখ কথার মৃণাল কাঁটায় ফুটতে থাকে তার মন। প্রেমের উচ্ছ্বসিত জোয়ার কান্না হয়ে ওঠে হৃদয়ের দখিনা হাওয়ায়। এক অদ্ভুত সম্পর্ক। এ সম্পর্ক না যায় রাখা, না যায় ছাড়া। বিলেত থেকে ডাক্তার হয়ে ফিরে আসার সময় হয় অরুণের। তখনই ল্যাবরেটরিতে কাজ করার সময় দুর্ঘটনায় অরুণ অন্ধ হয়ে যান। এ সময় বাসন্তীকে অরুণ লিখেন, ‘আমি অন্ধ হয়ে গেছি। অন্ধ স্বামী কেউ চায় না। তাই তোমার বাবার সঙ্গে কথোপকথন ভুলে যাও। ’ এ চিঠি পড়ে স্তব্ধ হয়ে যান সাগরিকা। কারণ বাসন্তী এ চিঠিও তাকে দিয়ে বলেছেন, তোমার চিঠি। তুমি উত্তর লিখ। সাগরিকা বাসন্তীকে বললেন, দেশে তুমি অরুণের পাশে দাঁড়াও। অন্ধ হলেও অরুণের সঙ্গে বিয়ে চূড়ান্ত হয়ে আছে। অন্ধ অরুণের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন বাসন্তী। বরং দুই কথা শুনিয়ে দেন সাগরিকাকে। বাসন্তীর বাবাও অন্ধ ছেলের হাতে কন্যাকে তুলে দিতে নারাজ। কিন্তু সাগরিকার ভালোবাসা তো স্বার্থের জন্য নয়। তাই বাসন্তী সেজে অন্ধ অরুণের পাশে দাঁড়ান সাগরিকা। শেষ পর্যন্ত বাসন্তী সেজে অরুণের সব দায়িত্ব পালন করেন সাগরিকা। একদিন দুজন কথা বলার সময় হঠাৎ অরুণ বললেন, আজও আমার অন্ধ চোখে সাগরিকার রূপ। বাসন্তী সেজে অভিনয় করা সুচিত্রা বললেন, যদি বলি সাগরিকাকেই ভালোবাস? জবাবে অরুণ বললেন, হ্যাঁ। তাকেই ভালোবাসি। এবার সাগরিকা বললেন, ‘হায়রে বাসন্তী! এত করেও মন পেলি না। ’ অরুণ বললেন, তুমি কি অখুশি হয়েছ সাগরিকার কথা শুনে? বাসন্তীবেশী সাগরিকা বললেন, না ভীষণ খুশি হয়েছি। কতটা খুশি হয়েছি তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। এর মাঝে অরুণের চোখের অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অপারেশন টেবিলে যাওয়ার আগে অরুণ বললেন, কথা দাও চোখ খুলে তোমায় দেখতে চাই। বাসন্তী সেজে থাকা সাগিরকা বললেন, কথা দিলাম চোখ খুলে বাসন্তীকে দেখতে পাবে। অপারেশন শেষ হয়। অরুণ চোখ খোলার মুহূর্তে সাগরিকা রুম থেকে চলে যান। বাসন্তীকে ধরে অরুণ বুঝে ফেলেন এই তার বাসন্তী নয়। এ অন্য কোনো নারী। তখন সত্যিকারের বাসন্তী বললেন, ‘আপনি যাকে খুঁজছেন আমি সেই বাসন্তী না। ’ তাহলে আমার সেই বাসন্তী কোথায়? চিৎকার করতে থাকেন অরুণ, আমি আবার দেখতে চাই না। আমি দেখতে চাই না। আমার সেই বাসন্তীকে ফিরিয়ে আনুন। শেষ পর্যন্ত সামনে আসেন সাগরিকা। এতদিন তিনি অভিনয় করেছিলেন বাসন্তী সেজে।

আমাদের সেই আবেগ কোথায় হারিয়ে গেল? মাঝে মাঝে ভাবী, এ যুগে কেউ কি চিঠি লিখে?

বাস্তবে এখন সেই আবেগও নেই। সেই ছবিও নেই। সেই চিঠিও নেই। এখন চারপাশ অন্যরকম। অতি-আধুনিকতার নামে চলা বাড়াবাড়ির আমি ঘোর বিরোধী। শালীনতার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। ধর্মীয় ও সামাজিক শিষ্টাচারের মূল্য আলাদা। নারীর প্রতি সম্মান দেখানো প্রতিটি পুরুষের কাজ। ইসলামে নারীর সম্মানের কথা বলা আছে। কিন্তু আমরা কোনোটাই মানি না। এ কারণে বেড়েছে সামাজিক অপরাধ। সমাজব্যবস্থার পরতে পরতে আজ অশনিসংকেত। লোভ, হিংসা, বিদ্বেষ চারপাশটাকে ডোবাচ্ছে। এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলছে। খুব সহজে সবাই সবকিছু অর্জন করতে চায়। জীবনযুদ্ধে কিছু মানুষ লড়ে চলেছেন। আবার কিছু মানুষ যা কিছু তা করছেন। বেড়েছে অন্যায়, অসংগতি। এ অবস্থার অবসান দরকার। কারও একার পক্ষে তা দূর করা সম্ভব নয়। সামাজিক বৈষম্যগুলো দূর করতে হবে সবাইকে মিলিতভাবে। অসম প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। সমাজব্যবস্থার রক্তক্ষরণ রোধে বাস্তবমুখী পরিবর্তন আনতে হবে। একসঙ্গে সবাইকে কাজ করতে হবে মিলিত প্রচেষ্টায়। নতুন আলোর পথ দেখাতে হবে তারুণ্যকে। পরিবারকে সচেতন হতে হবে নিজের সন্তানকে নিয়ে। আপনার সন্তান কোথায় যাচ্ছে তার খোঁজ রাখতে হবে। অন্যথায় বিপর্যয় রোধ করতে পারবেন না। কিশোর অপরাধের বীভৎস চেহারা বেড়েই চলেছে। তারুণ্য ভুল পথে যাচ্ছে। মাদকের সর্বনাশা থাবা আজ মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এ অবস্থার অবসানে দরকার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঐক্যবদ্ধ অবস্থান; যা আমাদের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোয় ছিল।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

 

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর