১৯০৫ সালে বাঘের মেরে ফেলা একটি গরুর মৃতদেহ খুঁজতে বেরিয়ে রাতের অন্ধকারে গ্রামবাসীরা ঝাঁকে ঝাঁকে পড়ে থাকা পাখি দেখতে পান। তাদের অধিকাংশই অর্ধমৃত। অদ্ভুতভাবে এগুলোকে দেখাও যায় কোনো না কোনো আলোর উৎসের বেশ কাছাকাছি।
আসামে এক ছোট্ট গ্রাম জাতিঙ্গা।
এর জনসংখ্যা মোটে ২৫০০ জন। এক শতকেরও বেশি সময় ধরে যেখানে চলে আসছে এক অদ্ভুত ভূতুড়ে ঘটনা। বর্ষা শেষের পর আগস্টের শেষের দিকে এবং মূলত সেপ্টেম্বর মাসের অমাবস্যাগুলোতে বিকেল ৬টা থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত চলতে দেখতে পাওয়া যায় এই অদ্ভুত ঘটনা।শত শত পাখি এসে ঝাঁপ দেয় আলোর উৎসগুলোতে।
কিন্তু প্রতিবছরের এই বিপুল পরিমাণ পাখির বসবাস মোটেই ওই গ্রামে নয়। বরং বেশ খানিকটা দূর থেকে উড়ে আসে এরা এই ১৫০০ বাই ২০০ মিটারের মৃত্যুস্থলে। বিষয়টা অবশ্যই ৩০ বছর আগের মতো আর নেই। গ্রামবাসীদের নানাভাবে বোঝানোর পরে কমানো গেছে পিটিয়ে মারা এবং ঝলসে খাওয়ার পাশবিক উপক্রম। কিন্তু কমানো যায়নি পাখি মৃত্যুর হার। বহু চেষ্টা্র পরেও এই পাখিগুলিকে বাঁচানো সম্ভব হয়ে ওঠে না এখনও। আধমরা অবস্থায় তারা পরিত্যাগ করে খাওয়াদাওয়া। জোর করে খাওয়াতে গেলে নিশ্চিত মৃত্যু হয়।
১৯৭৭ সালে জুওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তরফ থেকে অর্নিথোলজিস্ট সুধীন সেনগুপ্তকে পাঠানো হয় এই গ্রামে। একাধিক বছর ধরে, ঘটনার কিছুদিন আগে থেকে বেশ কিছুদিন পর পর্যন্ত ওখানে থাকেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত পত্রিকা ‘সায়েন্স’-এর তরফ থেকে তাকে এই বিষয়ে তার রিসার্চটি লিখতেও বলা হয়েছিল। সুধীনবাবুর প্রথম পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, কুয়াশা এবং বৃষ্টির ফোঁটার উপর আলোকপাতের দরুণ তৈরি হয় প্রাথমিক বিভ্রম। আরও অদ্ভুত বিষয় তিনি লক্ষ্য করেন যে প্রতিটি আহত পাখিই তাদের শেষবার খাওয়ার প্রায় তিনঘণ্টা বাদে এসে ঝাঁপ দেয় আলোয়। অর্থাৎ আহত হওয়ার সময় তাদের অধিকাংশেরই পেট ফাঁকা থাকে এবং পেশিতে সংকোচন শুরু হয় দ্রুত। এরপর জোর করে খাওয়াতে চাইলে তারা প্রত্যাখ্যান করে এবং অধিকাংশই আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই স্বেচ্ছায় প্রাণ হারায়। তার গবেষণা বলে আহত প্রতিটি পাখি ডেটাইম ফিডার।
বহু তথ্যই সংগ্রহ করেন সুধীন সেনগুপ্ত ও তার দল। কিন্তু বিশেষ প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। কেন কেবল জাতিঙ্গার মতো ছোট একটি জায়গায় ঘটে এই বিরাট মৃত্যুযজ্ঞ, কেন এই অস্বাভাবিক আচরণ করে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি, কেন আলোক উৎসের দিকে ঝাঁপ দেয় তারা? কেনই বা খালিপেটে থাকাকালীন এমন আচরণ তাদের? কোনও স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি এসব প্রশ্নের।
বেশ কিছু থিওরির মধ্যে বলা হয়েছে এটি একপ্রকার জিও ম্যাগনেটিক ফল্ট। পৃথিবীর ভৌগলিক মেরু ও চৌম্বক মেরুর অবস্থান পার্থক্যের কারণে উৎপন্ন কোনও শক্তি তাদের বিব্রত করতে পারে বলে ধারণা করা হয়। রিদম কনসেপ্ট নামক সাম্প্রতিকতম ব্যাখ্যা থেকে আন্দাজ করা হয়, খাওয়ার পরে বিশ্রামরত পাখিরা বিক্ষিপ্ত আলোর প্রভাবকে অসময়ে সূর্যোদয় ভেবে বসে। আলোর এই অস্বাভাবিক বিচ্ছুরণের জন্য দায়ী কুয়াশার স্তর। ফলে দিকনির্ণয়ের সমস্ত উপায় ঘেঁটে যায় পাখিদের এবং তারা ছুটে যায় আলোর উৎসের দিকে। নিজেদের সমস্ত ইন্সটিংকট ঘেঁটে যাওয়ায় কাটা ঘুড়ির মতো দিকবিদিকশূন্য হয়ে পড়ে তারা।
ব্যাখ্যা কিছু পাওয়া গেলেও কোনওটিকেই একমাত্র কারণ বলে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি আজ পর্যন্ত। সমতল থেকে ৭৩০ মিটার উঁচু এই গ্রামে ৫টি অমাবস্যা জুড়ে চলা এই রহস্যময় ঘটনা বিশ্বের কাছে এখনও অন্যতম এক আশ্চর্য বিষয় হয়েই রয়ে গিয়েছে। তবে কোনো একদিন এই রহস্য উদ্ঘাটিত হবে।
নিউজ টোয়েন্টিফোর/ডিএ