দক্ষিণ এশিয়ায় মত প্রকাশ স্বাধীনতা চর্চায় বাংলাদেশ পিছিয়ে

দক্ষিণ এশিয়ায় মত প্রকাশ স্বাধীনতা চর্চায় বাংলাদেশ পিছিয়ে

অনলাইন ডেস্ক

মত প্রকাশের স্বাধীনতা পরিস্থিতির নাজুক অবস্থা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের অগ্রগতিকে ম্লান করেছে। রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক কর্মীদের দ্বারা মত প্রকাশ কর্মীদের উপর ক্রমাগত আক্রমণ, মামলা ও নিপীড়নের  ঊর্ধ্বগতি এ বাস্তবতার প্রমাণ দেয়।

মত প্রকাশের অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিনের ২০১৯ সালের  বৈশ্বিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে (গ্লোবাল এক্সপেশন রিপোর্ট) বাংলাদেশ সম্পর্কে এ কথা বলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর ২০১৯) ঢাকায় অবস্থিত সংগঠনটির বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার কার্যালয়ের পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

বিশ্বজুড়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আদর্শ পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলে এমন গুণগত নির্ণায়কগুলো বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এজন্য বিশ্বের ১৬১টি দেশের সংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সাংবাদিক ও যোগাযোগ কর্মীদের হত্যা, শারীরিক নির্যাতনসহ অন্যান্য অপরাধের বিচারিক প্রক্রিয়া এগোচ্ছে না। এ সংক্রান্ত অসংখ্য মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে আছে বা কিছু কিছু মামলা শামুক গতিতে এগোচ্ছে।

অর্থাৎ একটি বিচারহীনতার সংস্কৃতি এখানে বিদ্যমান। এর উজ্জ্বল উদাহরণ হলো এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মেহেরুন রুনি ও মাছরাঙা টিভির নিউজ এডিটর সাগর সরোয়ার দম্পতি হত্যাকাণ্ড। ২০১২ সালে সন্ত্রাসীরা এদের হত্যা করে এবং দীর্ঘ প্রায় ১০ বছরেও এ হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়ার কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

লক্ষ্যণীয় যে, এ যাবৎ ৬৮ বার এ মামলার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময়সীমা পেছানো হয়েছে।

আর্টিকেল নাইনটিন, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, এসডিজির ১৬ নম্বর অভীষ্টে সুশাসন তথা শান্তি, ন্যায়বিচার, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ও অন্তর্ভূক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। এ লক্ষ্যটি অর্জনে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি। এসডিজির অন্য টার্গেটগুলো অর্জনে এগিয়ে গেলেও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি।  

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং এ প্রেক্ষাপটে তখন দেশে গণমাধ্যম, রাজনৈতিক কর্মী ও নাগরিকদের কন্ঠরোধ ও সহিংসতা বেড়ে যায়। ওই সময়ে ৫০টির বেশি ওয়েবসাইট বন্ধ করা হয় এবং মোবাইল ফোন কোম্পানীগুলোকে নেটওয়ার্কের গতি কমিয়ে দিতে নির্দেশ প্রদান করা হয়। ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর মুখোশপরা ব্যক্তিরা একযোগে ১২ জন সাংবাদিকের ওপর আক্রমণ করে। রাজনৈতিক কর্মীদের গণ গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়ায় তিন লাখের মত মামলা দায়ের করা হয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে এবং  বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ওই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে।

গত বছর মুন্সিগঞ্জের  সাপ্তাহিক অনলাইন পোর্টাল ‘আমাদের  বিক্রমপুর’ এর সম্পাদক এবং অসাম্প্রদায়িক লেখক ও প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চুকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে।

অন্যদিকে, দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ওপর আক্রমণ হয় এবং তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ওই আক্রমণ করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

আইসিটি এ্যাক্টের ৫৭ ধারার অপব্যবহার ও তা রোধের ব্যাপারে গণমাধ্যমকর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও মানবাধিকার কর্মীদের দাবির প্রেক্ষাপটে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়। এ আইনে‘ স্বাধীনতা যুদ্ধ’ ও ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে’ নিয়ে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কোনো ধরনের প্রপাগান্ডা ছড়ালে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এছাড়া তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কারো মানহানি, মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য প্রচারের জন্য পাঁচ বছরের জেল এবং কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার বা রাষ্ট্রের আইনশৃ্খংলার অবনতি ঘটায় এমন ঘটনার ক্ষেত্রে অনাধিক ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে  তথ্য- প্রযুক্তি আইন ও ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ব্যাপক প্রয়োগের ফলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হয়েছে। পাশাপাশি গত বছরে দেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও আগস্টে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকালীন সময়ে যে সহিংসতা হয় তাতে ৪০ জন গণমাধ্যমকর্মী আহত হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো মামলা করা হয়নি এবং আজ পর্যন্ত কাউকে ওই হামলার জন্য অভিযুক্ত করা হয়নি ; যদিও এ বিষয়ে প্রযোজনীয় সাক্ষ্য ও প্রমাণ বিদ্যমান ছিল।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ে বিখ্যাত ফটো সাংবাদিক শহীদুল আলমকে ফেসবুকে ভিডিও পোস্টের অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখিয়ে ১০০ দিনের  ডিটেনশন দেওয়া হয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শহীদুল আলমকে ‘মিথ্যা সংবাদ’ প্রচারের জন্য অভিযুক্ত করেন। শুধুমাত্র গণমাধ্যম কর্মী নয়; গত বছরের আগস্টের ৪ তারিখে ঢাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা নূসরাত জাহান সোনিয়াকে ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে চাকরি থেকে সাময়িক অব্যাহতি প্রদান করা হয়।

প্রতিবেদনে বিশ্বজুড়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার এই অবনতিশীল পরিস্থতির উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট দমনমূলক আইন বাতিল করা, আন্তর্জাতিক আইন মেনে মত প্রকাশের অধিকার কর্মীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর