গণতন্ত্রের আইকন থেকে আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার আসামি সু চি

গণতন্ত্রের আইকন থেকে আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার আসামি সু চি

অনলাইন ডেস্ক

অং সান সু চিকে এক সময় মানবাধিকার রক্ষার দূত হিসেবে গণ্য করা হতো। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় মিয়ানমারের সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে গৃহবন্দি জীবন কাটিয়েছেন তিনি বছরের পর বছর। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখায় ১৯৯১ সালে তাকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও দেওয়া হয়। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার দিন কমিটির চেয়ারম্যান তাকে ‘ক্ষমতাহীনদের ক্ষমতা’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

কিন্তু ক্ষমতায় গিয়ে আপাদমস্তক বদলে গেলেন সু চি। মানবতার পক্ষে তার আর সে অবস্থান নেই। রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতি নীরব সমর্থন জানিয়ে বিশ্বজুড়ে ইতিমধ্যে নিন্দার পাত্রী হয়েছেন এক সময়ের গণতন্ত্রের আইকন সু চি। এবার সেই গণহত্যার অপরাধেই আসামি হিসেবে আন্তর্জাতিক আদালতের সম্মুখীন হয়েছেন।

৭৩ বছর বয়সী সু চি মিয়ানমারের সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন করার ফলে ১৯৮৯ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বেশিরভাগ সময় তিনি গৃহবন্দি ছিলেন। এর ফলে তিনি শান্তিপূর্ণ উপায়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতীক হয়ে দাঁড়ান বিশ্বের মানুষের চোখে। দীর্ঘ ২৫ বছর পর ২০১৫ সালে তার রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) থেকে নির্বাচন করে সংখ্যাগরিষ্ঠতাও অর্জন করেন। তবে প্রকৃত বিজয় আসে আরও ৫ বছর পর যেদিন তিনি ১৫ বছরের গৃহবন্দিত্ব থেকে অবশেষে মুক্তি পান। ২০১৫ সালের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে মিয়ানমার গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে শুরু করলে দেশটির ক্ষমতার ভাগী হন সু চি।

২০১৬ সালে সু চি যখন পশ্চিম ইউরোপ সফরে যান, তখন তাকে বরণ করা হয়েছিল গণতন্ত্রের মানসকন্যা রূপে। তার দীর্ঘদিনের সমর্থনদাতা পশ্চিমারা মনে করেছিলেন, সেনাবাহিনীর বাড়াবাড়ি খর্ব করতেই তিনি তার ক্ষমতা ও নৈতিকতার অবস্থানকে ব্যবহার করবেন। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পরপরই আদতেই বদলে যেতে থাকে তার রূপ ও কর্মকাণ্ড। বছরে পর বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালিয়েছে তার মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে চালানো দুটি নৃশংস জাতিনিধন অভিযানে বাড়িতে মানুষ হত্যা, নারী ও যুবতীদের ধর্ষণ, পুরো সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ তদারকি করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এর শিকার হয়ে কমপক্ষে ৮ লাখ রোহিঙ্গা ভিটেবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রতিবাদ করেননি সু চি, বরং তিনি আরও সেনাবাহিনীর পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন।

জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ একবাক্যে বলে আসছে, রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমার মানবতাবিরোধী অপরাধ করে আসছে। রয়টার্সসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার অনেক ছবিসহ প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু সবই অস্বীকার করেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, প্রাণভয়ে ছুটে আসা লাখ লাখ মানুষের ঢল। যাদের কথাতেই উঠে আসে নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ। মানবিক কারণে যাদের আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। রাখাইনে ঠিক কি হয়েছে তা বিশ্ববাসীকে সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে দেয়নি মিয়ানমার সরকার। কিন্তু তাতে আটকায়নি আদালতের দরজা। জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালতে এই গণহত্যা নিয়ে মামলা ঠুকে দেয় আফ্রিকার ছোট্ট দেশ গাম্বিয়া। মঙ্গলবার এ মামলার শুনানি শুরু হয়েছে।

অনেকেরই ধারণা ছিল, মিয়ানমার বুঝি এই আদালতকেও এড়িয়ে চলে যাবে। কিন্তু এখানেও চতুর খেলা খেলছে দেশটি। আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন সু চি। গণহত্যায় অভিযুক্ত সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়ে তাদের হয়ে লড়ছেন তিনি। দেশের ভেতর সু চির পক্ষে একের পর এক সভা-সমাবেশ হচ্ছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, আসলে রাজনৈতিক সুবিধা লুটতেই জাতিসংঘের আদালতে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সু চি। এমন সিদ্ধান্তে বিস্মিত হয়েছে সু চির বন্ধুমহলও। তারা বলছেন, এতে বিশ্বজুড়ে তীব্র নিন্দাই কুড়াচ্ছেন সু চি।  

 

নিউজ টোয়েন্টিফোর/ডিএ