রাষ্ট্র স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মালেকের দুর্দশা কাটেনি আজও

রাষ্ট্র স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মালেকের দুর্দশা কাটেনি আজও

অনলাইন ডেস্ক

মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের সাব-সেক্টর কমান্ডার আবদুল মালেক ভূঁইয়া। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেলেও অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণে পরিবারের ভাগ্যের চাকা রয়ে গেছে অপরিবর্তিত। বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে চরম অসহায় অবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করছেন তিনি।

মানবিক দিক বিবেচনায় দেশপ্রেমিক এ মুক্তিযোদ্ধাকে সরকারের বিশেষ সুবিধার আওতায় এনে সহযোগিতার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

মহান বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় বাংলাদেশের। পাক হানাদারমুক্ত হয় বাংলাদেশ। নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান সব পাকিস্তানি সৈন্যকে নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও যৌথবাহিনীর কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এই দিনই সূচিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশের।
অর্জিত হয় আমাদের প্রাণপ্রিয় লাল-সবুজের পতাকা।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি অর্জনের নেপথ্যে রয়েছে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা, দেশের কৃষক, শ্রমিক, জনতাসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগ। ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্মানের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিজয় অর্জনে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। তেমনই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক ভূঁইয়া। তার বাড়ি কুমিল্লা জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলার ভোলাইন গ্রামে। পিতার নাম মৃত আবদুল হাকিম ভূঁইয়া এবং মাতার নাম মৃত আয়েশা খাতুন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে আবদুল মালেক তৃতীয়।  

আবদুল মালেক যুদ্ধকালীন সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। তার নির্দেশেই পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছেন প্রায় অর্ধশত মুক্তিযোদ্ধা। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ছয়জন পাক হানাদার বাহিনীর হাতে খুনও হন। দৃঢ়চেতা আবদুল মালেক ছিলেন অদম্য সাহসী একজন মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে তার বুদ্ধিদীপ্ততায় এসেছে সফলতা। যে এলাকার দায়িত্ব পেয়েছেন সেই এলাকাই শত্রুমুক্ত করেছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল মালেক ভূঁইয়া ছিলেন ২৪/২৫ বছরের তরুণ। ইন্টারমিডিয়েটে পড়তেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশমায়ের টানে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রতিজ্ঞা নেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় তিনি সহপাঠীদের যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা জোগান সে সময়।

১৯৭১ সালের ৫ কিংবা ৬ এপ্রিল কুমিল্লার বৃহত্তর লাকসামের নাথেরপেটুয়ার বিনয়ঘর গ্রামে পাকবাহিনী দলবলে এসে নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের ওপর আক্রমণ চালায়। হানাদার বাহিনী ৩০টি বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। দুজন বৃদ্ধকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে। এ সংবাদ পেয়ে নিজেকে সংযত রাখতে পারছিলেন না প্রতিবাদী আবদুল মালেক। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিপুলসংখ্যক মানুষের সঙ্গে তিনিও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ওই যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অন্যদের মধ্যে সাবেক সচিব গোলাম মাওলা, লে. কর্নেল আবদুল কাদের, নজির আহমেদ ভূঁইয়াও অংশ নেন।  

পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর তাণ্ডবলীলায় উত্তাল দেশ। দেশকে শত্রুমুক্ত করার প্রবল আগ্রহ আবদুল মালেকের। কলেজ হোস্টেলে থেকে যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। ১৯৭১ সালের ৫ মে তিনি তার মায়ের দোয়া নিয়ে প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ভারত চলে যান। তার সঙ্গী ছিলেন ভিক্টোরিয়া কলেজের ১৫/১৬ জন সহপাঠী। আবদুল মালেক প্রায় তিন মাস ভারতে অবস্থান করে কাঁঠালিয়া, বড়মুড়া ও লোহারবন প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে দলসহ আবদুল মালেক ভারতের মেলাঘর ক্যাম্পে আসেন। ওইখানে কয়েক দিন থাকার পর জাতীয় চার নেতার সিদ্ধান্ত মোতাবেক মেজর হায়দার সবার হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে দায়িত্ব বণ্টন করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশনা দেন। অদম্য সাহস ও বিচক্ষণতার কারণে আবদুল মালেক ভূঁইয়া ২ নং সেক্টরের ৪ নং সাব-সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পান। তার নেতৃত্বে ছিলেন ৪৭ জন মুক্তিযোদ্ধা।  

দেশকে পাক হানাদারমুক্ত করার প্রত্যয়ে অস্ত্র হাতে নিয়ে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের সীমান্ত দিয়ে আবদুল মালেক তার দল নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে যেখানে পাক হানাদার বাহিনীর তাণ্ডবলীলার সংবাদ পেয়েছেন সেখানেই তিনি তার দল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ১৯৭১ সালের পয়লা রমজানে বৃহত্তর লাকসামে গৈয়ারভাঙ্গায় পাক হানাদার বাহিনীর তাণ্ডবের কথা শুনে দলবল নিয়ে সেখানে ছুটে যান তিনি। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। ওই যুদ্ধে আবদুল মালেক কমান্ডারের নেতৃত্বাধীন গ্রুপের হারুন, মোকলেছসহ ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। হৃদয়বিদারক ঘটনায় আবদুল মালেক কমান্ডারের মন খারাপ হলেও প্রাণপণ লড়াই করে যান। শেষ পর্যন্ত পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হন তারা।  

এরই মধ্যে শুনতে পান বৃহত্তর লাকসামের দক্ষিণাঞ্চলের বর্তমানে নাঙ্গলকোটের জোড্ডা ও দৌলখাঁড় ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর তা বের খবর। সেক্টর কমান্ডার আবদুল মালেক দলবল নিয়ে চলে যান জোড্ডা ইউনিয়নের গোহারুয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আশরাফ উদ্দিন ভূইয়াদের বাড়িতে। এই পরিবারসহ আশপাশের বাড়ি থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হতো। এখান থেকেই আবদুল মালেক কমান্ডার দলবল নিয়ে ওই এলাকার বিভিন্ন স্থানে গিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে করেন।  

আশরাফ উদ্দিন ভূইয়া সাংবাদিক নঈম নিজামের বড় ভাই। মালেক কমান্ডারের সঙ্গে যুদ্ধে আশরাফ উদ্দিন ভূইয়া ছাড়াও যোগ দেন তার মামা দেলোয়ার হোসেন। হঠাৎ একদিন সেক্টর কমান্ডার আবদুল মালেক খবর জানতে পারেন, বটতলি বাজারে দোকানপাটে পাক হানাদার বাহিনী আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে। নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। আবদুল মালেক কমান্ডার সাংবাদিক নঈম নিজামের ভাই আশরাফ উদ্দিন ভূইয়া, মামা দেলোয়ার হোসেনসহ দল নিয়ে বটতলি বাজারে গিয়ে পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। শেষ পর্যন্ত হানাদার বাহিনী পরাজিত হয়।  

আবদুল মালেক ভূঁইয়া সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সফলতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়ে বৃহত্তর লাকসামের দক্ষিণাঞ্চল তথা নাঙ্গলকোটকে পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত করেন। ১১ ডিসেম্বর লাকসামে পাক হানাদার বাহিনীর মিনি ক্যান্টনমেন্ট খ্যাত লাকসামের থ্রিস্টার সিগারেট ফ্যাক্টরিতে থাকা শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে লাকসাম থেকেও বিতাড়িত করতে ভূমিকা রাখেন। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান সব পাকিস্তানি সৈন্যকে নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও যৌথবাহিনীর কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের সংবাদে আবেগাপ্লুত হয়ে বিজয়ের আনন্দে উল্লসিত হয়ে ওঠেন মুুক্তিযুদ্ধে সফল নেতৃত্বদানকারী আবদুল মালেক কমান্ডার।  

স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতির খবর পেয়ে আবদুল মালেক কমান্ডার তার স্বজনদের কাছে ফেরেন। যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করায় মা আয়েশা খাতুন তাকে বুকে টেনে নিয়ে দোয়া করেন। দেশ স্বাধীনের পর আবদুল মালেক রাষ্ট্রীয় সব স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর গেজেট নং ১৮৬১, তারিখ : ১৮/১১/২০০৪ ইং। ভারতীয় তালিকা নং/লাল মুক্তিবার্তা নং ০২০৪০৬০০২৯ (লাল বই)। বামুদ সনদ/সাময়িক সনদ নং ভারতীয়-৩০৯১৪, প্রধানমন্ত্রীর সনদ ক্রমিক-১৭৪৭৪, তাং-৩০/৮/১৯৯৯ ইং, ম-১৫৯৪৮০, স্মারক : মু/বি/সা/কুমিল্লা/প্রঃ৩/১৯/২০০২/৮০৭৩, তাং-১৮/১১/২০০৪ ইং।   আবদুল মালেক কমান্ডারের অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার মতো রাষ্ট্রীয় সব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা রয়েছে। একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তিনি নাঙ্গলকোট উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারের দায়িত্ব পাওয়ার কথা থাকলেও তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে দিনের পর দিন। বিগত দিনে তিনি পাননি সরকারের বিশেষ কোনো সুবিধাও।  

মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেকের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল তার দুর্দশার চিত্র। চারবার স্ট্রোক করেছেন দেশপ্রেমিক এ মুক্তিযোদ্ধা। ভুগছেন বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যাতেও। চার ছেলে ও চার মেয়ে সন্তানকে নিয়ে চরম অর্থকষ্টে জীবনযাপন করছেন তিনি। ছেলেদের আয়-রোজগার বলতে অনেকটা দিন এনে দিন খাওয়া-র মতো অবস্থা। তিন মেয়ে ডিগ্রি পাস করে থাকলেও মাত্র এক মেয়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেকের নেই তেমন সহায়-সম্পত্তি। বসতবাড়িতে জরাজীর্ণ টিনের ঘরে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বসবাস করেন তিনি। সামান্য বৃষ্টিতেই ঘরে পানি ঢোকে। বাড়ি যাওয়ার রাস্তাটির অবস্থা বেহাল হওয়ায় ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করতে হয় তাকে।

 

নিউজ টোয়েন্টিফোর/ডিএ