শীতে অচল রংপুরের জনজীবন, বিপাকে দরিদ্ররা

শীতে অচল রংপুরের জনজীবন, বিপাকে দরিদ্ররা

অনলাইন ডেস্ক

রংপুর মানেই শীতের জনপদ। প্রচণ্ড শৈত্য প্রবাহের কারণে অচল হয়ে পড়েছে রংপুরের জনজীবন। সেই সঙ্গে পড়ছে ঘনকুয়াশা। কুয়াশার সাথে হিম শীতল বাতাসে কাবু হয়ে পড়েছেন খেটে খাওয়া, ছিন্নমূল মানুষ।

বিপাকে পড়া সহায় সম্বলহীন হতদরিদ্র এসব মানুষ শীতবস্ত্রের অভাবে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। অনেকেই খড়কুটো জ্বালিয়ে রাত কাটাচ্ছেন।

অন্যদিকে, ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মেডিকেলে বাড়ছে শিশুদের ভিড়। শ্বাসকষ্ট, কোল্ড ডায়রিয়া নিউমোনিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বৃদ্ধরাও।

রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোহাম্মদ আলী জানান, সোমবার রংপুর বিভাগের মধ্যে কুড়িগ্রামে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। সেখানে তাপমাত্রা ছিল ৫.২ ডিগ্রি।

সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই। ঘন কুয়াশার আবরণে ঢাকা গ্রামীণ জনপদ। কখনো উত্তুরে আবার কখনো পশ্চিমা হাওয়ার দাপটে বেড়েছে শীতের প্রকোপ।

ক্রমেই তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় অসহায়ত্ব বাড়ছে দরিদ্র মানুষের।

বড়রা কোনভাবে শীতের আঘাত সইতে পারলেও শিশুদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন অভিভাবকরা।

ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ ঠান্ডাজনিত নানা রোগে ভোগা শিশুরা চিকিৎসা নিচ্ছে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় মেডিকেলে ভর্তি হয় ৮৩ জন শিশু।

শীতজনিত সকল রোগ থেকে শিশুদের নিরাপদ রাখতে অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শিশু বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মনিকা মজুমদার।

তিনি বলেন, শিশুদের পর্যাপ্ত শীতের কাপড় পরাতে হবে, বিশেষ করে মোজা-টুপি।

সূত্র জানায়, শীতে উত্তরের জনপদ বিপর্যস্ত হলেও এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে দরিদ্রদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়নি।

বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় যোগাযোগ করে জানা গেছে, চাহিদার তুলনায় শীতবস্ত্রের সংখ্যা কম হওয়ায় বেশিরভাগ পরিবারকে শীতবস্ত্র দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে শিশুদের জন্য এবার ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে কোনও শীতবস্ত্র বরাদ্দ করা হয়নি। এবার শুধু কম্বল দেওয়া হয়েছে।

এবার শীতে চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য শীতবস্ত্র পাঠানো হয়েছে উল্লেখ করে জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা ফরিদুল হক বলেন, রংপুর জেলার জন্য ৪ দফায় মোট ৪৯ হাজার ৭৪৬টি কম্বল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে কম্বলগুলো বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার মন্ত্রণালয় থেকে কম্বল ইউনিয়ন ওয়ারি সংখ্যা উল্লেখ করে বরাদ্দ পত্র দেওয়া হয়েছে। এতে করে প্রথম দফায় একেকটা ইউনিয়ন ভাগে পড়েছে ২০০ কম্বর। এরপরের বার পাবে ৯৮টি। তবে এটা চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য বলে স্বীকার করেন তিনি।

রংপুর জেলায় প্রকৃত হতদরিদ্রের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। এজন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আরও ২০ হাজার কম্বল চাওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

আমাদের ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি জানান, উত্তর জনপদের হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত ঠাকুরগাঁও জেলা। অন্যান্য জেলার আগেই শীতের আগমন হয় এ জেলায়। আর শীত আসলেই অসহায় হয়ে পড়ে জেলার দুস্থ শীতার্থরা। ঠাকুরগাঁওয়ে ১৫ লাখ মানুষের বসবাস। ৮০ ভাগ মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে।

সদর হাসপাতল সূত্রে জানা গেছে, জেলায় প্রতিবছর শীত জনিত রোগে দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। আর শীত আসলেই শিশুসহ নানা বয়সের মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতলে ভর্তি হয়।

ঠাকুরগাঁও সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় এখানে শীতের তীব্রতা অনেক বেশি। গ্রামাঞ্চলের মানুষ খড়খুটো দিয়ে বেশির ভাগ সময় শীত নিবারণের চেষ্টা করে। বেশির ভাগ হত দরিদ্র মানুষ শীতের জন্য গরম কাপড় কিনতে পারে না। তাই অনেকে শীত জনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সরকারি ভাবে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক যে পরিমাণ শীতবস্ত্র বিতরণ করে তা অপ্রতুল্য।  
এছাড়াও ঠাকুরগাঁও সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে শীত বস্ত্র না পাওয়ার অভিযোগ সীমান্তবর্তী এলাকার দরিদ্রদের। তারা জানান, জেলা শহর হতে আমাদের এখানের দূরত্ব বেশি হওয়ায় শীত বস্ত্র আমাদের এখানে আসার আগেই শেষ হয়ে যায়।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার বালিয়া গ্রামের আমজাদ হক নামে ৭৫ বছরের এক বৃদ্ধা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হামার গ্রামত অনেক শীত বাহে। সূর্য পরিলেই শীত আরও বেশি লাগেছে। কম্বলত শীত মানিবার চায় না। কিন্তু হামার কপালত কনোদিন একটাও শীতের কাপড় জুটেনি।

হত-দরিদ্র মোমেনা খাতুন জানান, ভিক্ষা করে জীবন চলে। শীত আসিলেই ভিক্ষা করবা পারি না ঠাণ্ডার কারণে। সরকার গরিবক শীতের কাপড় দেয় না। ওইলাতো পায় বড়লোক মানুষ।  

ঠাকুরগাঁও শহরে ভিক্ষা করার সময় ভিক্ষুক রাবেয়া বলেন, শীতকালে সরকারি যে কম্বল পাই তা দিয়ে শীত যায় না। এত পাতলা কম্বল দিয়ে কি করব আমরা। মোটা কম্বল হলে একটাই কম্বল পাইলে আমরা খুশি।

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর ঠাকুরগাঁও জেলায় ৬০ হাজারের বেশি শীতবস্ত্রের চাহিদা পাঠানো হয়। গত বছর প্রধানমন্ত্রী দপ্তর থেকে প্রায় ২০ হাজার শীতবস্ত্র পাওয়া গেছে। এছাড়াও অনেক বেসরকারি এনজিও সংস্থা থেকে প্রায় ৫-১০ হাজার শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। জেলায় অনেক মানুষ হত-দরিদ্র। যে পরিমাণ চাহিদা পাঠানো হয় তার অর্ধেক শীতবস্ত্র পাওয়া যায়। গত বছরের চেয়ে এ বছর আরও বেশি শীতবস্ত্রের চাহিদা পাঠানো হবে।  

ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর হাসপাতালের সিভিল সার্জন ডা. এইচ এম আনোয়ারুল বলেন, হিমালয়ের পাদদেশে ঠাকুরগাঁও জেলা অবস্থিত হওয়ার কারণে জেলায় শীতের তীব্রতা অনেক বেশি। তাই শিশু ও বিভিন্ন বয়সের মানুষ তাড়াতাড়ি শীত জনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। শীতের তীব্রতা থেকে রক্ষার জন্য গরম কাপড় পরিধান করতে হবে। শিশুদেরকে ঠাণ্ডা না লাগানোর জন্য মায়েদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ড. কে এম কামরুজ্জামান সেলিম জানান, হেমন্তের শুরুতেই জেলায় শীতের আগমন ঘটেছে। জেলায় শীতবস্ত্রের চাহিদা অনেক বেশি। কিন্তু সরকারি ভাবে আমরা তা দিতে পারি না। যতটুকু পাওয়া যায় তা গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। তাই বেসরকারি সংস্থা গুলো যদি প্রতিবছরের ন্যায় এবারও আরও এগিয়ে আসে তাহলে অনেকটা শীতবস্ত্রের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)