কেন যুদ্ধের ময়দানে ‌‘সামরিক পোষাক পরতেন না’ সোলাইমানি

কেন যুদ্ধের ময়দানে ‌‘সামরিক পোষাক পরতেন না’ সোলাইমানি

অনলাইন ডেস্ক

যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী আইআরজিসি'র কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার পর তাকে স্মরণ করছে দেশটির জনগণ।

ইরানি গণমাধ্যম জানায়, তিনি সাধারণ মানুষের কাছে কতটা প্রিয় ছিলেন তা বোঝা গেছে তার জানাজা নামাজ ও শোক র‍্যালিতে লাখো মানুষের উপস্থিতি। যা বিশ্বকে হতবাক করেছে। একিকে নজিরবিহীনও বলা হচ্ছে।

কাসেম সেলাইমানিকে যেভাবে চেনে ইরানিরা: কাসেম সোলাইমানি ইরানে হাজি কাসেম নামেই বেশি পরিচিত। ১৯৯৭ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী হাজি কাসেমকে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী'র কুদস ব্রিগেডের প্রধানের দায়িত্বে নিয়োগ দেন। ফলে ৪১তম সারাল্লাহ ডিভিশনের অন্য সেনা সদস্যরা মর্মাহত হন। এই ভেবে যে এখন থেকে আর হাজি কাসেমকে কাছে পাওয়া যাবে না।

কারণ হাজি কাসেম ছিলেন এই ডিভিশনের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। তবে কুদসের প্রধান হলেও তিনি এই ভিডিশনের সদস্যদের কখনো ভুলে যাননি। ৪১তম সারাল্লাহ ডিভিশনের হাজ কামাল দুস্তি তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব কথা বলেন।

কেরমানের এই খ্যাতনামা যোদ্ধা হাজ কামাল দুস্তি ছিলেন শহীদ সোলাইমানির কাছের মানুষ।

হাজি কাসেম বছরে মাত্র দুইবার অর্থাৎ হযরত ফাতেমা জাহরা (সা.) এর ওফাত বার্ষিকী এবং রমজান মাসে নিজ বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হতেন। প্রতিরক্ষা যুদ্ধের সময় ৪১তম সারাল্লাহ ডিভিশনের ৪২০ ব্যাটেলিয়ানের কমান্ডার মোহাম্মদ শারিফ শাহ মোরাদি ছিলেন হাজ কাসেমের অতি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি।

শুক্রবার মার্কিন ড্রোন হামলায় জেনারেল কাসেম সোলাইমানির শাহাতাদের ঘটনা শোনামাত্রই তিনি মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

তিনি বলেন, গেল রমজান মাসে সোলাইমানির সঙ্গে আমার সর্বশেষ দেখা হয়েছিল। তখন তিনি নীতি নৈতিকতার বিষয়ে অনেক কথা বলেছিলেন এবং সেইসঙ্গে সিরিয়া ও ইরাক যুদ্ধের অনেক অভিজ্ঞতা নিয়েও কথা বলেন। আট বছরের প্রতিরক্ষা যুদ্ধের সময়কার মতোই আমরা একসঙ্গে বসে গল্প করেছি। বছরে অন্তত দুইবার তার সঙ্গে দেখা হত। কিন্তু এখন থেকে তাকে আর দেখতে পাব না।  মনে হচ্ছে আমি এতিম হয়ে গেলাম।

‘সাধারণ মানুষ জেনারেল সোলাইমানিকে সামরিক অঙ্গনে ও যুদ্ধক্ষেত্রে একজন ত্যাগী ও সাহসী মানুষ হিসেবেই চেনে। কিন্তু তার বড় মাপের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানতো। তিনি বিভিন্ন যুদ্ধে নিহতদের স্মৃতিকে চিরঞ্জীব ও অম্লান করে রাখার জন্য অনেক কাজ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অন্য সবার চেয়ে অগ্রগামী এবং বলা যায় ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অগ্রনায়ক। তিনি ছিলেন যুদ্ধে নিহতদের পরিবার ও সন্তানদের আশ্রয়স্থল। ’

‘জেনারেল সোলাইমানির জীবন ছিল প্রেমাসক্ত। তিনি ভালবাসার প্রকৃত অর্থ বাতলে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ভেঙেপড়া ও হতাশাগ্রস্ত মানুষের মধ্যে নতুন করে প্রাণসঞ্চারকারী। এটা সবাই জানত যে কাসেম সোলাইমানি যখনই নিহতদের কোনো শোকানুষ্ঠানে উপস্থিত হতেন সেখানকার নীরবতা ভেঙে যেত এবং যুদ্ধে নিহতদের সন্তানেরা হৈ চৈ করে ছুটে এসে সোলাইমানির পাশে বসত। মনে হত বাচ্চারা যেন বাবার সাথে মোলাকাত করতে এসেছে। ’

‘তিনি বাচ্চাদের এতোটাই আদর স্নেহ করতেন যে তার উপস্থিতিতে বাচ্চারা এক মুহূর্তের জন্যও স্থির হয়ে বসে থাকত না। এমনকি সোলাইমানিকে পেয়ে তারা বড়দের কথাও শুনতে চাইত না এবং আনন্দে দিশেহারা হয়ে যেত। ’

এমনই একদিনের ঘটনা, জেনারেল সোলাইমানি একবার নিহতদের পরিবারের একটি মজলিসের পেছনের দরজা দিয়ে আস্তে করে ভেতরে প্রবেশ করে নিঃশব্দে একটি চেয়ারে বসে পড়েন। এক পর্যায়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য সোলাইমানিকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। কিন্তু বাচ্চারা হঠাৎ তাকে পেয়ে ঘিরে ধরে কথা বলা শুরু করে, কেউ গা ঘেঁষে দাঁড়ায়, কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত। বাস্তবতা হচ্ছে শোকানুষ্ঠানগুলোতে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই কথাবার্তা হয় এবং একে অপরকে সহমর্মিতা জানায়।

সোলাইমানির শোকানুষ্ঠানে নিহত আনসারির স্ত্রী ফাতেমা জাফরি বলেছেন, আজ আমরা সকলে সমবেত হয়েছি এমন এক শোকার্ত পরিবারের মতো যাদের বাবা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা স্বজনহারা একে অপরের দুঃখ বেদনা ভালোভাবে উপলব্ধি করছি।

কাসেম সোলাইমানি নিহতদের পরিবারের এতিম শিশুদেরকে খুব আদর করতেন, তাদের খোঁজ খবর নিতেন, কোলে নিতেন, নিজ হাতে তাদের মুখে খাবার তুলে খাওয়াতেন। তিনি তার হাসি দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে শিশুদের মনকে খুশীতে ভরে দিতেন। এমনকি নামাজ পড়া অবস্থায় এক শহীদের ছোট্ট সন্তানের দেওয়া গোলাপ ফুল গ্রহণ করেন।

ইরানের গণমাধ্যম আরও জানায়, জেনারেল সোলাইমানি যেমন ছিলেন অত্যন্ত নরম মনের মানুষ তেমনি যুদ্ধের ময়দানে ছিলেন অত্যন্ত শক্ত মনের মানুষ। তিনি লেবানন, ফিলিস্তিন, ইরাক ও সিরিয়ায় আমেরিকা ও ইসরাইলের বহু ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হন। তিনি ইরাকে শিয়া মুসলমানদেরকে সংঘবদ্ধ করার পাশাপাশি দেশটির সুন্নি মুসলমান ও কুর্দিদের সহায়তায় এগিয়ে গিয়েছিলেন। তার কারণেই দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল ইরাক ।

ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস সন্ত্রাসীদের দমন করা ছিল জেনারেল সোলাইমানির বড় কৃতিত্ব ও অবদান। যে কারণে তিনি ছিলেন আইএস'র পৃষ্ঠপোষক আমেরিকার চক্ষুশূল, জানায় ইরানের গণমাধ্যম।

তিনি সবসময় যুদ্ধের ময়দানে থাকতেন এবং কখনো সামরিক পোষক পরতেন না। কারণ তিনি ছিলেন গণমানুষের নেতা।

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর