আইসিসিবিতে শুরু গার্মেন্ট শিল্পের ৪ আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী

আইসিসিবি-তে পোশাক শিল্পের চার আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী উদ্বোধন করছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি

আইসিসিবিতে শুরু গার্মেন্ট শিল্পের ৪ আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় (আইসিসিবি) একযোগে শুরু হলো পোশাকশিল্প পণ্যের চারটি আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী। দেশের পোশাক খাতের উন্নয়নে দেশি-বিদেশি মেশিনারি, ইয়ার্ন এন্ড ফেব্রিক্স, গার্মেন্টস এক্সেসরিজ, প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিং মেশিনারি ও সাপোর্ট সার্ভিস নিয়ে এ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। আইসিসিবি'র ১০টি হলজুড়ে ২৪ দেশের ৪৫০ প্রতিষ্ঠান প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছে। আজ বুধবার চার দিনব্যাপী  প্রদর্শনী চারটির উদ্বোধন করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ড. রুবানা হক, বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ এন্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি মো. আব্দুল কাদের খান, জাকারিয়া ট্রেড অ্যান্ড ফেয়ার ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিপু সুলতান ভুঁইয়া, আসক ট্রেড অ্যান্ড এক্সিবিশন প্রাইভেট লিমিটেডের নন্দ গোপাল কে প্রমুখ। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিজিএপিএমইএ'র উপদেষ্টা রাফেজ আলম চৌধুরী এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য দেন বিজিএপিএমইএ'র দ্বিতীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট মোজাহেরুল হক শহীদ।

'গার্মেন্টেক বাংলাদেশ-২০২০', '১১তম ইয়ার্ন এন্ড ফেব্রিক্স সোর্সিং ফেয়ার-২০২০', '১১তম গ্যাপ এক্সপো-২০২০' এবং 'প্যাকটেক বাংলাদেশ-২০২০' শীর্ষক প্রদর্শনী চারটি চলবে আগামী শনিবার পর্যন্ত। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত প্রদর্শনীগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

জাকারিয়া ট্রেড অ্যান্ড ফেয়ার ইন্টারন্যাশনাল, আসক ট্রেড অ্যান্ড এক্সিবিশন প্রাইভেট লিমিটেড এবং বিজিএপিএমইএ সম্মিলিতভাবে প্রদর্শনীগুলোর আয়োজন করেছে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, আশির দশকে গার্মেন্টের সব এক্সেসরিজ ও সহায়ক পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। এখন এগুলো দেশেই তৈরি হয়। এই খাতের ব্যবসায়ীরা কঠোর শ্রম ও নিষ্ঠার মাধ্যমে খাতটিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।   '৮৪ সালের প্রথম দিকে আমি গার্মেন্ট ব্যবসা শুরু করিনি। আমার কিছু বন্ধু এই ব্যবসায় জড়িত ছিল। তখন আমার বন্ধুরা বললো, আমাদের কিছু বোতাম এসেছে, কিন্তু বোতামগুলো শার্টের রঙ ও ডিজাইনের সঙ্গে মিলছে না। তারা আমাকে বললো, ‌'তুমি দেখো মানানসই বোতাম জোগাড় করে দিতে পারো কিনা। ' আমি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে কিছু বোতামের স্যাম্পল জোগাড় করলাম। তারা দেখে বললো, 'বোতামগুলো চালানো যাবে, তবে রঙটা ম্যাচ করছে না। দেখো রঙ করানোর ব্যবস্থা করতে পারো কিনা'। আমি আবারও ঘুরতে শুরু করলাম। এরপর রঙ করার জায়গা খুঁজে বের করলাম। এরপর সুতা জোগাড় করে বিভিন্ন গার্মেন্টে দিতাম। এভাবে শুরু। তখন কার্টন, বোতাম, সুতা- সবকিছু কন্টেইনার ভর্তি করে বিদেশ থেকে আনতে হতো। আজ দেশেরই তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে কত দূর এগিয়ে গেছে! এখন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে এগুলো। আজ এই প্রদর্শনীতে প্রায় হাজারখানেক দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। এটা তো আগে ভাবাই যেত না। প্রদর্শনীর আয়োজকরা বলেছেন, প্রদর্শনীতে আনা পণ্য ও যন্ত্রপাতি আবার ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়। তাই এগুলোর উপর থেকে যেন আমদানি শুল্ক মওকুফ করা হয়। আমি সেই চেষ্টা করব।   

তিনি বলেন, আজকে গার্মেন্ট এক্সেসরিজ গার্মেন্টশিল্পের সাথে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন গার্মেন্ট এক্সেসরিজ শিল্প ও গার্মেন্ট শিল্পকে আলাদা করে ভাবার কিছু নেই। আমরা আপনারা সবাই এক ও অভিন্ন। আমাদের যদি এক্সেসরিজ না থাকতো, বাইরের দেশ থেকে আনতে হতো, তাহলে কিন্তু রফতানি আয় কমে যেতো। এই খাতে প্রায় ৪/৫ লাখ শ্রমিক রয়েছে। সব মিলিয়ে ভালো অবস্থানে আছি। এখন আমরা নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে শ্রীলংকা, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি করছি।  

দেশের অর্থনীতিতে পোশাক শিল্পের অবদান ব্যাপক। ৪৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। রফতানি পণ্যের ৮৪ শতাংশ এ খাত থেকেই আসে। তারপরও বৈশ্বিক নানা কারণে খাতটির খারাপ সময় যাচ্ছে। সবাই মিলে এই সংকট মোকাবেলা করতে হবে। আশা করি খুব শীঘ্রই সুদিন ফিরবে। খাতটির উন্নয়নে বর্তমান সরকার সব ধরণের সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে।

প্রধানমন্ত্রী আগামী বছর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা পূর্বাচলে করার নির্দেশ দিয়েছেন মন্তব্য করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, চলতি বছরের মাঝামাঝিতে পূর্বাচলে নিজস্ব স্থায়ী প্রদর্শনীকেন্দ্র হয়ে যাবে। আশা করছি আগামী বছর থেকে সবাই পূর্বাচলে এ ধরনের প্রদর্শনীর আয়োজন করতে পারবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ড. রুবানা হক বলেন, গার্মেন্ট খাতটি খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের হতাশার কথা যেমন আছে, আশার কথাও আছে। গত এক বছরে আমাদের প্রবৃদ্ধিও হয়েছে। কিন্তু, গত ছয় মাসে আমরা ভালো করিনি। এ সময়ে ৭ দশমিক ৬৪ ভাগ নেগেটিভ গ্রোথে আছি। পরিমাণের দিক দিয়ে বললে প্রায় সাড়ে ১০ ভাগের মতো উৎপাদন কমে গেছে। ৬৯টি ফ্যাক্টরি গত ছয় মাসে বন্ধ হয়ে গেছে। ৩২ হাজার ৯শত জন চাকরি হারিয়েছে। একইসঙ্গে ৫৩টি ফ্যাক্টরি চালু হয়েছে। যার মধ্যে ২৬টি নতুন। যারা নতুন তাদেরকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা হচ্ছে- তারা কিসের ফ্যাক্টরি করছে? কেন করছে? দোষ আমাদেরও কম না। কেন বুঝে না বুঝে ফ্যাক্টরি বাড়িয়ে তুলছি? আমাদের যথেষ্ঠ গবেষণা হয়নি। যেভাবে গার্মেন্ট এগিয়েছে, সেভাবে এক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং খাতও এগিয়েছে। আমরা আলাদাভাবে দাবি-দাওয়া তুলে ধরছি। কিন্তু, আমরা তো পৃথক নই। গার্মেন্ট খাতের সঙ্গে এক্সেসরিজ বা প্যাকেজিং খাত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাহলে কেন এককভাবে আমাদের সমস্যা খুঁজে বের করে তার সমাধান বের করছি না? কেন সম্মিলিতভাবে বাজেটে সুপারিশ করছি না? টেকসই উন্নয়নে গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, আমরা অনেক গার্মেন্ট পণ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাত বা রিসাইক্লিং করে ব্যবহার করতে পারি। এতে খরচ যেমন কমবে তেমনি উন্নয়ন টেকসই ও পরিবেশবান্ধব হবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ক্রেস্ট দেওয়া হয়। আমাকে দেওয়া কোনো ক্রেস্ট আমি বাসায় নিয়ে যাই না। এত ক্রেস্ট রাখবো কোথায়? যদি দিতেই হয়, রিসাইক্লিং করে নতুন কোনো ব্যবস্থা করুন। প্রচুর পরিমান হ্যাঙ্গার আমরা গার্মেন্ট পণ্যের সঙ্গে ব্যবহার করে রপ্তানি করি। এগুলো তো ফেরত এনে ফের ব্যবহার করা যায়। রিসাইক্লিং ব্যবসার দিকে আমরা মনোনিবেশ করতে পারি কিনা সেটা সবার ভেবে দেখা দরকার। তৈরি পোশাক খাতে যেমন নানা সমস্যা আছে, তেমনি গার্মেন্ট এক্সেসরিজ বা প্যাকেজিং খাতেও আছে। সবাই যার যার খাত নিয়ে আলাদাভাবে চিন্তা না করে একসঙ্গে কীভাবে উন্নতি করা যায়, কীভাবে সবাই মিলে দেশটাকে এগিয়ে নেওয়া যায় সেভাবে ভাবা দরকার।

স্বাগত বক্তব্যে রাফেজ আলম চৌধুরী বলেন, গত বছর প্রদর্শনীতে ৫০ হাজারের মতো দর্শনার্থী এসেছিল। এবার  ৮০০ বুথ ও ৬০০টি স্টলে দেশি-বিদেশি ৪৫০ এক্সিবিটর অংশ নিয়েছে। এখানে এসে গার্মেন্ট খাতের সর্বশেষ প্রযুক্তি সম্পর্কে জানতে ও জানাতে পারছেন সংশ্লিষ্ট খাতের স্টেকহোল্ডাররা। প্রয়োজনীয় পণ্য সোর্সিং করতে পারছেন। বিশ্বে এখন ৬০০-৭০০ বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্ট অ্যাক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং বাজার রয়েছে। কিন্তু, আমরা তার মাত্র দুই শতাংশ রপ্তানি করতে পারছি। এটা বাড়াতে পারলে অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখা সম্ভব হতো। এজন্য জরুরি ভিত্তিতে একটি  ইনস্টিটিউট দরকার যেখানে এই খাত নিয়ে গবেষণা হবে, প্রশিক্ষণ হবে। এছাড়া ব্যাংকিং ও কাস্টমস সেক্টরেরও সহজিকরণ দরকার। কিন্তু, শুরু থেকে এই খাতটি অবহেলিত। কোনো ধরণের প্রণোদনা আজ অবধি দেওয়া হয়নি। গত ছয় মাসে প্রায় ১০০ ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আগে গার্মেন্ট এক্সেসরিজ ও প্যাকেজিংয়ের প্রতিটি পণ্য আমদানি করা হতো। তার বিকল্প হিসেবে দেশে এ শিল্পের পদযাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে প্রায় দেশে ১৭ হাজার শিল্প-কারখানা রয়েছে। প্রায় সাত বিলিয়ন ডলারের শিল্পখাত হিসেবে ধরা হয়। ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য অর্জনে দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে তৈরি পোশাকখাত। এর মধ্যে ১২ বিলিয়ন ডলার এক্সেসরিজ পণ্য উৎপাদন করতে হবে আমাদের।

(বিজিএপিএমইএ সভাপতি আব্দুল কাদের খান বলেন, গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং সেক্টরটি একটি প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারক খাত। দেশের পোশাক শিল্পের সকল প্রতিষ্ঠানের এক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং পণ্যের ৯৫ভাগ চাহিদা আমরা পূরণ করছি। ফলে ওই সকল প্রতিষ্ঠানের লিড টাইম কমার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। কিন্তু খাতটি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকায় প্রত্যক্ষ রপ্তানিকারকদের মতো রপ্তানি প্রণোদনা পাচ্ছে না। উৎপাদিত পণ্যে ৪০ ভাগের বেশি ভ্যালু এডিশন থাকলে রপ্তানি প্রণোদনা দেওয়া হয়ে থাকে। গার্মেন্ট এক্সেসরিজ এবং প্যাকেজিং সেক্টরের উৎপাদিত পণ্যের ভ্যালু এডিশন শতকরা ৪০ ভাগের বেশি। প্রণোদনা পেলে এই খাতের রপ্তানি কয়েকগুণ বাড়তো। তিনি বলেন, কোনো একটি বিশেষ পণ্যের পরিচিতি ও রপ্তানি বাড়াতে সরকার প্রতি বছর কোনো একটি পণ্যকে বর্ষ পণ্য ঘোষণা করে। প্যাকেজিং পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে ২০২১ সালে এই খাতের কোনো একটি পণ্যকে বর্ষ পণ্য ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি। চার দিনব্যাপী প্রদর্শনী চারটি টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক খাত সংশ্লিষ্টদের জন্য অভিজ্ঞতা অর্জনের অসাধরণ সুযোগ সৃষ্টি করেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, প্রদর্শনীগুলোতে পোশা তৈরির সর্বাধুনিক আন্তর্জাতিক প্রযুক্তিসমূহ তুলে ধরা হয়েছে। এসব প্রযুক্তি তৈরি পোশাক শিল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জ উৎপাদন, মান, কমপ্লায়েন্স এবং মূল্য সংযোজন বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে।

আয়োজকরা জানান, প্রদর্শনী চলাকালে ১৭ জানুয়ারি বিকাল ৪টায় আইসিসিবি'র ৪ নম্বর হলে ''ইনোভেশন অ্যান্ড ভ্যালু অ্যাডিশন ইন বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি'' এবং ''এআই অ্যান্ড অটোমেশন; মিথস: ইটস ইম্প্যাক্ট অ্যান্ড ওয়ে ফরোয়ার্ড'' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান হবে। টেক্সটাইল ফোকাস ম্যাগাজিন গ্রুপের ব্যবস্থাপনায় আলোচনা অনুষ্ঠানে এ শিল্প সংশ্লিষ্ট অংশীদার এবং প্রযুক্তিবিদরা অংশগ্রহণ করবেন।
প্রদর্শনীতে গার্মেন্ট এক্সেসরিজ, লেবেলিং, জিপার, ট্যাগ, ট্যাপ, থ্রেড, রিবন, বাটন, রিভেট, লেইস, হুক, ট্রান্সফার ফিল্ম, পেপার, ইনক ইত্যাদিসহ সংশ্লিষ্ট মেশিনারি তুলে ধরা হয়েছে।