আমার চোখে লিটু

আমার চোখে লিটু

ডা. এম আর করিম রেজা

একই মেডিকেল কলেজের এক বছরের জুনিয়র লিটুর সাথে আমার পরিচয় ১৯৮৬ সাল থেকে, তবে ঘনিষ্ঠতা হয় ১৯৯১ সালে ইন্টার্নি অবস্থায় ডক্টরস হোস্টেলে পাশাপাশি রুমে থাকার সময়। ঢাকার বাইরে আমার অবস্থানের কারণে এবং তখনকার দিনে মোবাইল ফোন না থাকায় মিটফোর্ড ক্যাম্পাস ছাড়ার পর খুব একটা যোগাযোগ ছিল না। ১৯৯৬ সালে যখন ঢাকায় ফিরি তখন লিটু থাকতো হাতিরপুলের জজ গলিতে একটি ব্যাচেলর বাসায়। তখন থেকেই লিটু অনেকটা আমার পরিবারের সদস্যে পরিণত হয়, মা-বাবা সহ আমার পরিবারের সবার সাথেই তার পরিচয় ছিল।

চিকিৎসক হিসেবে লিটুর গুণাগুণ বিচার আমার এই স্মৃতিচারণের উদ্দেশ্য নয়, বরং ওর চরিত্রের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

তীব্র কৃতজ্ঞতা বোধ ছিল লিটুর। কারো দ্বারা নিজে সামান্যতম উপকৃত হলেও সেটি ভুলতো না কখনো। প্রতিদান দেয়ার সুযোগ পেলে নিজে কৃতার্থ বোধ করতো।

আমি নিজের অভিজ্ঞতায় সেটি উপলব্ধি করেছি।

যে কোনো মানুষকে খুব সহজেই অল্প সময়ে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল লিটুর। নিজের লাভক্ষতি হিসেব না করে পরিচিত যে কাউকে বিপদ বা সংকট থেকে উদ্ধার করতে ঝাপিয়ে পড়তো লিটু। লাভক্ষতি হিসেব করে গড়ে উঠা সম্পর্ককে ও বলতো 'ডেবিট-ক্রেডিট' সম্পর্ক, যেটি সজ্ঞানে এড়িয়ে চলতো সে।

গরীব রোগীর চিকিৎসা সহায়তা ছাড়াও নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী লিটু পরিচিত অনেককেই সাহায্য সহযোগিতা করতো। মৃত্যুর আগে স্বচ্ছল জীবনযাপন করলেও, সেই হাতিরপুলের অস্বচ্ছল জীবনেও লিটু অনেককেই আর্থিকভাবে সাহায্য করতো। শাহবাগে আড্ডার সুবাদে নব্বইয়ের দশকের অনেক উঠতি সংবাদকর্মী লিটুর সহযোগিতা পেয়েছে, যাদের অনেকেই এখন পেশায় পরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত, যার সাক্ষী আমি।

নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর যাদের স্বভাব, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিল লিটু। নিজে পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ করার পরেও বাংলাদেশে রয়েল কলেজের পরীক্ষা কেন্দ্র খোলার আন্দোলন করেছে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডক্টরস এসোসিয়েশনের ব্যানারে। এই সংগঠনের মিছিল মিটিংয়ে আমি না থাকলেও সংগঠনের পক্ষে দেশ বিদেশে চিঠিপত্র আদান প্রদানের কাজটি আমি করতাম। মূলত বিসিপিএসের একগুয়েমির কারণেই আসলে ব্রিটিশ কাউন্সিল পরীক্ষা কেন্দ্র চালু করতে পারছিল না। পরবর্তীতে সার্জারির অধ্যাপক মজিদ স্যার বিসিপিএসের দায়িত্বে থাকার সময় সেই পরীক্ষা কেন্দ্র চালু হয়েছিল।

বৃহত্তর কুষ্টিয়ায় জন্ম এবং আলো বাতাসে বেড়ে উঠা লিটুর জীবনযাপনে দার্শনিক বাউল লালনের প্রভাব ছিল। লালনের গান শুধু খালি গলায় গাইতো না, বরং সেটি অনুধাবন করে পালন করার চেষ্টা করতো লিটু। সুফি গায়ক বারী সিদ্দিকীর সাথেও আধ্যাত্মিকতার কারণে ওর বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। যতদূর মনে পড়ে রোগীর ইকো করার সময় এই ছবিটি তোলার মুহূর্তেও লিটু লালনের গান গাইছিল।

প্রচণ্ড পরিশ্রমী ছিল লিটু, না ঘুমিয়ে সকাল থেকে গভীর রাত একনাগাড়ে পেশাগত কাজ শেষ করার পর আবার সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করতো। যা তার পরিচিতি বাড়াতে সহায়তা করলেও, নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল করার সুযোগ দেয়নি।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রচলিত অনিয়মের বিরুদ্ধে সবসময়ই সোচ্চার ছিল লিটু। গরীব জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার চিন্তা ভাবনা করতো লিটু। এ বিষয়ে সমমনা পেশাজীবীদের সাথে আলোচনা এবং উপদেশ গ্রহণ করতো। গরীব রোগীর চিকিৎসা সহায়তা প্রদানের জন্য প্যাসেন্ট ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলতে শুরু করেছিল সবেমাত্র। জাতীয় পর্যায়ে কিছু করার জন্যে রাজনৈতিক পরিচয় একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, সেই উদ্দেশ্য নিয়েই লিটু একটি দলের রাজনৈতিক পরিচয় ধারন করতো। তার স্বপ্ন ছিল ভবিষ্যতে এমপি নির্বাচন করে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কার সাধন করা।

সেই স্বপ্ন পুরণের আগেই ২০১৯ সালের ১৮ জানুয়ারি উর্ধশ্বাসে ছুটে চলা একজন জনদরদী চিকিৎসক ডাঃ রাকিবুল ইসলাম লিটুর ইহজাগতিক জীবনের অকালে পরিসমাপ্তি ঘটেছে।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক: জাকার্তা প্রবাসী চিকিৎসক

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

এই রকম আরও টপিক

সম্পর্কিত খবর