সাগরে ট্রলার ডুবি: জীবিত উদ্ধার ৭৩, নিহত ১৫

অনলাইন ডেস্ক

সেন্টমার্টিনে ডুবে যাওয়া রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলারটির আরো একজন জীবিত যাত্রীকে গভীর রাতে উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে উদ্ধার জীবিত যাত্রীর সংখ্যা দাঁড়াল ৭৩ জনে। যাদের অধিকাংশই নারী। আর নিহত ১৫ জনের ১১ জনই নারী।

বাকীরা শিশু।

নৌবাহিনী সূত্র জানাচ্ছে, গভীর রাতে সে সাঁতরে উপকূলে ভেসে আসেন তিনি। সেখান থেকে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়।  তাকে শুশ্রূষা দেওয়া হচ্ছে।

উদ্ধারকাজের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ তথ্য জানান। খবর বিবিসির।

এদিকে এই পাচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের ধরতে রাতভর অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। কক্সবাজার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, অভিযানে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরা সবাই স্থানীয় বাঙালি এবং পাচারচক্রের মূল হোতা বলে পুলিশ মনে করছে।

এদের মধ্যে কেউ শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের পাচারের জন্য মালয়েশিয়া যেতে রাজি করেছে। কেউ তাদেরকে সংগ্রহ করেছে, কেউ রয়েছে শিবির থেকে ট্রলার পর্যন্ত নিয়ে গেছে এবং কেউ এই যাত্রাপথে তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে।

news24bd.tv

কয়েকজন নৌকার মাঝিও রয়েছে আটকদের মধ্যে। ডুবে যাওয়া ট্রলারটি থেকে উদ্ধার দুইজনকে দালাল সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। উদ্ধারদের সবাইকে টেকনাফের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

সন্দেহভাজন পাচারকারী ছাড়া বাকীদের শরণার্থী শিবিরে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ। আর নিহতদের মরদেহ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে।

ছোট ছোট দলে পাচার: ডুবে যাওয়া ট্রলারে যারা ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা।

সেন্টমার্টিনে নৌবাহিনীর অফিসার-ইন-চার্জ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এস এম জাহিদুল ইসলাম এমন তথ্য জানান।

‘উদ্ধারপ্রাপ্তদের সাথে কথাবার্তা বলে যা জানা যাচ্ছে তাতে, ছোট ছোট দলে ভাগ করে এদেরকে আলাদা আলাদাভাবে নিয়ে জড়ো করা হয়েছিল টেকনাফের নোয়াখালী নামক স্থানে। ছোট ছোট নৌকায় করে রাতের আঁধারে তাদের সেখানে আনা হয়। একেকটি দলে ছিল ১৫ জন করে। তাদের লক্ষ্য ছিল মালয়েশিয়া যাওয়া। ’

বেশিরভাগ উদ্ধারপ্রাপ্তরাই জানিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেরই মালয়েশিয়ায় আত্মীয়স্বজন আছেন।

তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেই যাচ্ছিলেন তারা। মালয়েশিয়ায় তাদের প্রাথমিক আশ্রয়দাতা হতেন এসব আত্মীয়স্বজন।

ছোট নৌকায় করে নোয়াখালী নামক স্থানে আনার পর তাদের বড় ট্রলারটিতে তোলা হয়, যেটি শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় সেন্টমার্টিনে নিমজ্জিত অবস্থায়। এটি ছিল একটি মাছধরা ট্রলার। ভেতরে ছিল প্রচুর মাছ ধরা জাল।

মালয়েশিয়ায় কেন যাচ্ছিলেন, কীভাবে যাচ্ছিলেন?
সেন্টমার্টিনে নৌবাহিনীর অফিসার ইন চার্জ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এস এম জাহিদুল ইসলাম বলেন, তিনি উদ্ধারপ্রাপ্তদের অনেকের সাথেই কথা বলেছেন এবং জানতে পেরেছেন, মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে এরা মাথাপিছু ৪০ হাজার করে টাকা দিয়েছিলেন দালালকে।

তবে কক্সবাজারে পুলিশের এসপি এবিএম মাসুদ হোসেন বলছেন, এদের সবাইই যে অর্থ ব্যয় করে মালয়েশিয়া যাচ্ছিল সেটা বলা যাবে না।

‘খেয়াল করে দেখবেন প্রচুর পরিমাণে তরুণী ছিল ট্রলারটিতে। এরা মূলত যাচ্ছিল তাদের হবু স্বামীদের কাছে। ’

তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় যেসব রোহিঙ্গা যুবক রয়েছেন, তারা অনেক সময় বিয়ের জন্য পাত্রী পান না। তারাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজেরা ব্যয় বহন করে রোহিঙ্গা তরুণীদের নিয়ে যান বিয়ের জন্য।

‘ক্যাম্প থেকে এভাবে বিয়ের জন্য পাত্রী নিতে কন্যার পিতাকেই যৌতুক দেয় পাত্ররা’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নারীদের বিয়ের পাত্রী হিসেবে মালয়েশিয়া যাওয়ার আগ্রহের প্রবণতা নতুন নয়।

গত বছর টেকনাফের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাওয়া শত শত নারীকে আটক করে আবার ক্যাম্পে ফিরিয়ে এনেছিল বিজিবি, যারা বিয়ে করার জন্য মালয়েশিয়া যাচ্ছিলেন।

ওইসময় একজন রোহিঙ্গা তরুণী বলেছিলেন, তারা গরীব হওয়ার কারণে ভালো থাকার এটাই সেরা উপায় বলে মনে করেন। তিনি নিজেও বিয়ে করার জন্য মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করার সময় ধরা পড়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, যাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কপালে নেই।

সেসময় বিজিবির কর্মকর্তারা বলেছিলেন, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর হাতে অনেক তরুণীর স্বামী মারা যাওয়ার কারণে টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে পুরুষের চাইতে নারীর সংখ্যা বেশি। ফলে তাদের বিয়ের উপযুক্ত পাত্রের সংখ্যা কম। এজন্য তারা মালয়েশিয়ার যেতে আগ্রহী থাকেন।

ওদিকে মালয়েশিয়ায় যেহেতু বিয়ের উপযুক্ত রোহিঙ্গা পুরুষের জন্য পাত্রীর সঙ্কট, তাই তাদের কাছেও টেকনাফের ক্যাম্পের তরুণীদের চাহিদা থাকে।

এই দ্বিপাক্ষিক চাহিদা সৃষ্টি হওয়ার কারণে গত বছর থেকেই শরণার্থী শিবিরগুলোতে মানবপাচারকারী চক্রগুলোর কার্যক্রম ব্যাপকভাবে চলার বিষয়টি প্রকাশ পায়।

আর সেন্টমার্টিনের ট্রলারডুবির ঘটনায় এই প্রবণতা অব্যহত থাকার বিষয়টি সামনে এলো।

নিখোঁজের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি: নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড সদস্যরা এখনো নিখোঁজদের সন্ধানে উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন।

লে. কমান্ডার ইসলাম মনে করেন, যাদেরকে এখনো পাওয়া যায়নি, তাদেরকে আর জীবিত পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

আর মৃতদেহও যেহেতু ভেসে উঠতে কিছুটা সময় লাগে এবং দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়তে পারে, ফলে সেগুলো কখন, কোথায় এবং কীভাবে পাওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয় আছে। তবে ট্রলারটিতে ঠিক কতজন মানুষ ছিল তা নিয়ে এখনো সংশয় আছে।

যদিও ১৩৮ জন মানুষ সেখানে ছিল বলে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে কিন্তু নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার ইসলাম বলছেন, ১৩৮ সংখ্যাটি প্রচার পাওয়ার কারণ হচ্ছে, উদ্ধারদের মধ্যে একেকজন একেক রকম সংখ্যা বলছিলেন, বলার সময়েও তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করছিল। কিন্তু শুধুমাত্র একটি তরুণী খুব জোরের সঙ্গেই ১৩৮ সংখ্যাটি উচ্চারণ করছিলেন।

‘সে বলছিল, আমি জানি, ট্রলারে ১৩৮ জন মানুষ ছিল। ’ তার এই তথ্যকে আমলে নিয়ে ১৩৮ সংখ্যাটিকে ট্রলারের যাত্রীসংখ্যা ধরে নিখোঁজদের উদ্ধার তৎপরতা চালানো হচ্ছে।

যাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে তাদেরকে এরই মধ্যে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিমজ্জিত ট্রলারটি মঙ্গলবারই টেনে তুলে আনা হয়।

সেটি খোঁজার পর ভেতরে আর কোনো মৃতদেহ নেই বলে জানায় কর্মকর্তারা।

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)