ক্ষমা করবেন রাউফুন বসুনিয়া ভাই

ক্ষমা করবেন রাউফুন বসুনিয়া ভাই

আনোয়ার হোসেন মুকুল

১৯৮৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্য সেন হলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভা আয়োজনের  দায়িত্ব ছিল বাসদ ছাত্রলীগের। আমরা সন্ধ্যা থেকেই রুমে রুমে যেয়ে মিটিংয়ে আসার জন্য সবাইকে বলতে থাকি। রাত সাড়ে ৮টা/৯টার দিকে বসু ভাইয়ের সাথে আমার দেখা হয় হলের ভিতরে। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'রানা হামিদ কোথায়?' আমি বলি, 'সামনে যান, রানা ভাই আর শফি ভাই সামনেই বসে আছে।

'

আমাদের কারো এক জনের রুমে ডিমের তরকারী আর ভাত রান্না হয়েছিল, সেখানে আমারও খাওয়ার কথা তাই বসু ভাইকে বলি ভাই মিটিংয়ের দেরি আছে ডিমের তরকারি দিয়ে ভাত খাবেন? তিনি 'না' বলে গেটের বাইরে চলে যান। যথারীতি সভার প্রস্তুতি চলাকালে আমি উনাদের কাছে গেলে শফি ভাই বলেন তার ঠাণ্ডা লেগেছে। আমি বললাম, 'তাহলে সিগারেট খাচ্ছেন কেন?' আমার উদ্দেশ্য ছিল তাঁর হাতে থাকা  সিগারেটের বাকি অংশটায় ভাগ বসানো।    সে রাতের সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন আমাদের বাসদ ছাত্রলীগের হল শাখার সভাপতি কামিদ  হায়দার।

নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখার পর এরশাদের উপজেলা নির্বাচন বন্ধসহ ১৪ ফেব্রুয়ারি বটতলার জমায়েতে যোগদানের আহবান জানিয়ে আমরা স্লোগান দিতে দিতে মহসিন হল পার হয়ে সামনে এগুতে থাকি। সংখ্যায় ৩০/৩৫ জন ছিলাম। মিছিলের সামনে ছিল শফি আহমেদ, রানা হামিদ, রাউফুন বসুনিয়া ও অন্যান্যরা। মহসিন হল পার হতেই শফী ভাই দ্বিতীয় সারিতে এসে দুই একবার স্লোগান দিতেই তার গলা বসে যায়। তারপর বসু ভাই জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো বলতেই তার গলার স্বরও দুর্বল হয়ে যায়। সাধারণত প্রায় সব মিছিলে আমি অন্যান্যদের সাথে শ্লোগান দিতাম। খানিকটা লজ্জায় আমি বসু ভাইকে বলি ভাই আপনে সামনে যান আমি স্লোগান ধরছি। তখন আমি স্লোগান ধরি দ্বিতীয় সারি থেকে। ''জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো, খুনি এরশাদের গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে, শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না''। ততক্ষণে মিছিলটা বড় রাস্তায় উঠে গেছে। একটা হোন্ডা সামনে দিয়ে খুব জোরে শব্দ করে এফ রহমান হলের দিকে চলে গেল। ঠিক তখন সামনের সারিতে পাশাপাশি ছিলেন  বসু ভাই, শফী ভাই ও রানা হামিদ ভাই। তারপরই এফ রহমান হলের সামনে গাছের পাশে দাঁড়িয়ে  কেউ একজন গুলি করেছিল। ধুপ করে একটা শব্দ শুনেছিলাম । নিচু হয়ে তাকিয়ে দেখি বসুভাই। তাজা রক্তে ভিজে চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ঢেকে গেছে চোখ আর কপাল। আমাদের প্রিয় বসু ভাই ছিলেন বাকশাল সমর্থিত জাতীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক।
আজ এতো বছর পর পেছনে ফিরে তাকালে সেই সব সোনালী অতীতের অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। কী স্বপ্ন নিয়েই না সেদিন গুলির মুখে দাঁড়িয়ে বুক চিতিয়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলাম। স্বপ্নগুলো অধরাই রয়ে গেল। তারপরও আশা রাখি একদিন আমাদের সোনালি তারুণ্য আমাদের চেয়েও আরও সাহস নিয়ে এই মাটিতেই গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবে। আমরা অধীর আগ্রহ নিয়ে সেই দিনের দিনের অপেক্ষায় আছি। তারুণ্যের জয় হবেই। আজকের এই দিনে রাউফুন বসুনিয়ার সাহসী স্মৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা। বসু ভাই সবাই আপনাকে ভুলে গেলেও আমরা আপনাকে ভুলি নাই। আমাদের ক্ষমা করবেন ভাই ।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, নাগরিক ঐক্য

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর