দুই ফিটের মধ্যে যা পায় তাতেই বসে পড়ে করোনা

দুই ফিটের মধ্যে যা পায় তাতেই বসে পড়ে করোনা

শামীম আজাদ

রোজ এসময় ঘুম ভাঙে। এই ভোর চারটা টারটা আরকি। এখন আর ঘড়ি দেখি না। প্রতিদিন আমার দেহঘড়ি এভাবে এই একই সময়ে ঘুমের বাটি থেকে উপছে ফেলে জাগন-টেবিলে।

এ আমার লেখার সময়।

কিন্তু বাথরুমে যাবার আগে, মুখ ধোবার আগে এমনকি হাত বাড়িয়ে টেবিল লাইট জ্বালাবারও আগে চোখ বন্ধ রেখেই হাতিয়ে হাতিয়ে বালিশের নিচ থেকে এই মুহূর্তের এলদারোদো, গ্লাস্টিকের ছোট্ট স্যানিটাইজারের শিশিটি পেয়ে গেলাম। ঐ রকম তিন তিনটে শিশি ঘরের তিন জায়গায় রাখা আছে আর একটি গাড়িতে। তিন জায়গায় তিনটি জীবানুনাশক ডেটল ভেজা টিস্যুর প্লাস্টিক প্যাকেটও রাখা আছে এবং একটা গাড়িতে।

গাড়িইতো আমার থার্ড বেডরুম। কে জানে কখন হাত, আঙুল ও নখের গা-গোড়া মুছে ঝুলন্ত এই শত্রু হাতজোড়ার গায়ে সেঁটে থাকা মৃত্যুকনা করোনাকে মারতে হয়!

চোখ বন্ধ রেখেই দু’হাতের তালুতে দু’ফোটা স্যানিটাইজার ফেললাম। এক্ষুণি তা ভাল করে ডলবো এবং ডলার পর সে তালুগুলোকে আবার শিশিটির গায়ে হাত বুলিয়ে তার দেহকেও জীবানুমুক্ত করবো। তো প্রথমেই হাতের মধ্যেই দশটি আঙুলের মাথায় বসে থাকা যে নখগুলো আছে তাতে এই জীবন-নির্যাস মাখিয়ে নিলাম। তারপর আরও দু’ফোটা নিয়ে করতলদল ভালোবেসে বেসে মাখালাম। এবার মুঠোতে শিশিটি নিয়ে হাত বুলাতে বুলাতে ভাবলাম, জীবন এমন অদ্ভূত হবে, কখনোতো বুঝিনি আগে। এত সুখ আর এত ভয়, এখন দুঃস্বপ্নের মতো লাগে।

এখন আমার শত্রু আমার নিজের এই হাতজোড়া। ওরা তোমার মুখের কাছে গেছেতো মরেছো! কাউকে ছুঁয়ে-ছোতো সেও বাঁচবে না। চুমুতো দুরের কথা। তাই ঐ দু’হাত না ধুয়ে নিজ মুখখানাও মুছি না। করোনার মত তীব্র মৃত্যুবিষ পৃথিবীতে না এলে আমি জানতেই পারতাম না মানুষ কত হাজার বার তার মুখায়ববে, মুখ গহব্বরে, নাকের ফুটোয় ও তার চারধারে, ভুরুতে, ঠোঁটের কোনায়, থুৎনির নিচে ঐ মারাত্মক হাত লাগায়, নখ খুঁটায় বা চুলকায়।

টেবিল লাইটের সুইচ টিপে দিলাম। আলো জ্বলে উঠলো পূবে পশ্চিমে। আলোর দিকে চেয়ে বললাম, তোমাকে কি করে স্নান করাবো? তারচেয়ে তোমার ঐ ঘন কালো মিনি ডিঙ্গি নাওয়ের মত সুইচটাই সাফা করি! এবার দু’হাতে আরো দুই শীতল জীবানুনাশক বিন্দুগুলো ঘষে তাই করলাম। তারপর অস্ত্রপচার কক্ষে প্রবেশ করার আগে টিভি সিরিজগুলোতে দেখা নীল ভিনেক হাফহাতা জামাপরা শৈল্য চিকিৎসকদের মত দু’হাত উপরে তুলে খুলে রাখা বাথরুম দরোজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম।

বাথরুমে তাকিয়ে দেখি কি বিপদ! সেখানে আছে রূপালী ধাতব বসানো সিংক, সাদা প্লাস্টিকের টয়লেট সিট, ধতব র‍্যাকে ঝুলছে ধোয়া তোয়ালে, পাশে কংক্রিটের খোপে নানান রঙ ও পদার্থে তৈরী ছোট ছোট প্রসাধনী পাত্র। ঐরকম ধাতবেই না করোনার মৃত্যুবীজ ঘাপটি মেরে বসে থাকে সব চেয়ে বেশি সময়। শয়তানগুলো ধাতব হ্যান্ডেলে জ্যান্ত বসে থাকে বারো ঘণ্টা! ভাবা যায়? দশ ঘণ্টা থাকে কাঠে। আমার ফ্ল্যাটে কাঠের কিছু নেই। এবার বাঁচলে সব কাঠের করে ফেলবো। কাঠের চেয়ে কম সময় জ্যান্ত হয়ে বাঁচে কাপড়ে। ভাগ্যিস আমরা কাপড়ের কাপড় পরি। করোনার কাঁটা কাঁটা গা সমেত দেহটা একটু বড় বলে কাপড়ে আটকে যায় বিধায় বিলেতের এনএইচএস এর নির্দেশানুযায়ী সবাই মুখে মাস্ক পরে অন্যের বিষ নিঃশ্বাসের সামনে ব্যারিকেড দিচ্ছি। দরজায় বাজার রেখে গেলে দস্তানা পরে নিয়ে এসে সব সাবান জলে ধুয়ে উঠাচ্ছি। হাতে সার্জিকাল গ্লাভস ও মুখে নানান ডিজাইনের মাস্ক পরে আমরা সবাই সায়েন্সফিশন ক্যারেক্টার হয়ে সুরুত করে কাজ সেরেই দোর, হ্যান্ডেল মুছে দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করি। তারপর সাবান গোলা জলে চাবি ধুই, জুতার নিচে স্প্রে দিই, কোটের বাকলস মুছি ওয়েট টিস্যুতে। সাবানের ক্ষা্রে ফেনা তুলে কভিডের বাচ্চাগুলোর অতিসূক্ষ চর্বিদার চূড়াগুলো ক্ষয় না করে নিজের ঐ দুহাত দিয়ে কোন কিছুই ছুঁতে পারবো না। পারলে স্ট্রেইট জ্যাকেট পরে নিতাম।

এ নিয়ে কিন্তু একদম হাসি না। যদিও ফেসবুকে মাঝে মধ্যে একটু মজার চেষ্টা করি। কিন্তু আসলে কি মজা পাই? পাই না। পাই ভয়। বেঁচে থাকার জন্য এক থোক কৌতুক ধরে একটু এই তরল বিষাক্ত টাইমে টিকে থাকতে চাই।

সরকারের নির্দেশানুযায়ী তো নিজেকে আইসোলেসনে রেখেছি। ব্রিটেনে আমার বয়সী মানুষদের নিয়েই চিন্তা। সবাইকে ঘরে থাকতে হবে আর ইংরেজিতে শব্দটা 'সোশাল ডিস্ট্যান্সিং' সেটা করতে হবে। যা হচ্ছে সামাজিকতায় দূরত্ব বজায় রাখার কথা বোঝায়। এ হচ্ছে একজনের দেহ থেকে আরেকজনের দেহের মধ্যে একটা নিরাপদ দূরত্বের ব্যবধান রাখা। যাতে বীজানুর শিকল ভাঙা যায়। এর মাপ হলো দুই ফিট। কারোনার জীবানু জল টলটলে অনুসমান। তাই অতটুকু যেতে যেতেই নিচে পড়ে যায়। তখন আশে পাশে কাপড়, ধাতব, চামড়া যা পায় তাতেই বসে পড়ে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে পর্দা সরিয়ে দেখি আমার ঐ প্রানান্তকর মোছামুছির অবসরে বাইরের অন্ধকার ম্লান হয়ে এসেছে। চেয়ে দেখি ঐ অত ভোরে যাকে রাতও বলতে পারেন, এক প্রবীনা তার কুকুরকে তার প্রাত্যহিকী করাতে বেরিয়েছেন! এখনো শহর ঘুমিয়ে আছে। এসময় অন্তত এই সত্তরোর্ধের গায়ে কেউ কাশির বা হাঁচির হল্কায় পাঠাতে পারবে না কোন জীবন-হারক!

গারবেজ ফেলা ছাড়া ঘর থেকে বেরুই না। যেদিন বেরুই ময়লাময় দুর্গন্ধময় ঢাউস বিনের দিকে যাবার সময়টা কি যে ভাল লাগে। এক চিলতে সবুজ দেখা যায়, আকাশ দেখা যায়, দূর থেকে কদাচিৎ মাস্ক লাগানো প্রতিবেশি দেখা যায়। আচ্ছা, কখন ঐ গারবেজ ফেলা হয়ে গেল জীবনের সেলিব্রেশন!

থমকে যাওয়া আকাশ (প্রথম পর্ব)
শামীম আজাদ
লন্ডন
২৩ মার্চ ২০২০

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ

সম্পর্কিত খবর