আর কতদিন ঘরে আটকা থাকতে হবে?

আর কতদিন ঘরে আটকা থাকতে হবে?

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় সপ্তাহান্তের রাতে হোস্টেলের এ ব্লকের এক রুমে জুয়ার আসর বসতো। ঢাকা শহরের কয়েকজন প্রভাবশালী- ধনীর ছেলেরা সেই আসরে খেলতে আসতেন। একেকজনের পকেট থেকে অনায়াসে বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা নেমে যেতো। সেই সাথে চলতো খাওয়া-দাওয়া।

খাওয়ার লোভে বসে থাকা আমরা কতিপয় দরিদ্র দর্শক, চোখের সামনে এতগুলো টাকা উড়তে দেখে বিস্মিত হতাম। আমরা তখন বাসা থেকে পুরো মাসের জন্য পেতাম পনের শ টাকা। তিন তাসের আসরে কেউ কেউ আবার ব্লাইন্ড খেলতেন। ব্লাইন্ড খেলায় ভাল তাস পড়লে লাভের সম্ভাবনা যেমন, খারাপ তাস পেলে ক্ষতিরও ঝুঁকি তেমন।
ব্লাইন্ড খেলে যেমন সাতের ট্রয় পেয়ে বোর্ডের সব টাকা পাওয়া যায়, আবার পাঁচ টপ দুই আর তিন পেলে সব খোয়াতেও হয়।

আমি পেশায় একজন এপিডেমিওলজিস্ট। প্রায় তিন দশক পরেও বাংলাদেশে এই বিষয়টা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের তেমন কোন ধারণা নাই। ডাক্তার মানেই অধিকাংশ মানুষের কাছেই বড় বড় ডিগ্রী করা আর রোগী দেখা। এর বাইরেও যে চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক বিস্তৃত, সেটা নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে শুরু করে জনগণের অনেকেরই অজানা। এই যে পৃথিবী জুড়ে কোভিড১৯ এর বৈশ্বিক মহামারী চলছে, এটি নিয়ন্ত্রণে অন্যতম মূখ্য ভূমিকা রাখছে এই এপিডেমিওলজিস্টরাই। যদিও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এপিডেমিওলজিস্টদের তেমন কোন ভূমিকা কার্যকরভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। আইইডিসিআর নামের সরকারী যে এপিডেমিওলজির প্রতিষ্ঠানটি আছে, তাকে ব্যর্থ বলা হলেও কম বলা হবে। নিজেদের কর্মকাণ্ডে ইতিমধ্যে এটিকে একটি অথর্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে।

আমাদের নিউক্যাসেলে ডেসমন্ড নামে এক ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্ণেল ছিলেন। শহরের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হ্যামিলটনে তার একটা টেকওয়ে রেস্টুরেন্ট ছিল। আমি বাংলাদেশের শুনে তিনি আমাকে অনেক আদর করতেন। কখনো টেকওয়ে রেস্টুরেন্টে গেলে নিজের জন্য রান্না করা খাবার থেকে খেতে দিতেন। একদিন তিনি আমাকে বলেছিলেন, একজন সৈনিকের সারা জীবনের স্বপ্ন থাকে একটা যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করার। আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল একাত্তরে। আমি তখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন আমিও তাকে মন থেকে খুব শ্রদ্ধা করতাম। প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’ আমি তার সাক্ষাতকার ছেপেছিলাম।

বর্তমান যুগে কার্যপরিধি অনেক বাড়লেও মহামারী নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারাটা যে কোন ভাল মানের এপিডেমিওলজিস্টের জন্যই কাঙ্খিত। মধ্যপ্রাচ্যে যে মার্স রোগের মহামারী হয়েছিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন কনসালট্যান্ট হিসেবে পরবর্তীতে তা নিয়ে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলার মহামারীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো আমার এক আফ্রিকান ছাত্রী। এক সাক্ষাতকারে সে আমার নাম উল্লেখ করে বলেছিল, এই জ্ঞান সে আমাদের কাছ থেকে শিখেছে। দীর্ঘ প্রবাসে থাকার ফলে আমি নিজভূমে পরবাসী হয়ে গেছি। কিছু করতে গেলেই কিছু মানুষ হৈ হৈ করে ওঠে, ‘বিদেশে থেকে ও কী করবে?’। বিদেশে থেকে আমি কী করছি, এই প্রশ্ন আজকাল আমিও নিজেকে করছি। পাশাপাশি খুব জানতে ইচ্ছে করে, ক্ষমতা থাকা সত্বেও দেশে থেকে তারাই বা কী করছে?

ফেব্রুয়ারীর চার তারিখ থেকে করোনা নিয়ে কথা বলছি। আটউ মার্চ বাংলাদেশে সরকারী ভাবে প্রথম করোনা পজিটিভের কথা বলা হলে এই মহামারী মোকাবেলায় কার কি করণীয় তা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে বিস্তারিত লিখেছি। আমাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জেনেভা অফিস থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী দিয়ে সহায়তা করেছেন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা। সাধ্যমত করণীয় সম্পর্কিত পরামর্শসমূহ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পৌছে দিয়েছি। দেরীতে হলেও প্রায় প্রত্যেকটি পরামর্শই গৃহীত হয়েছে, যদিও বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা মাঝেমধ্যেই প্রকট হয়ে উঠেছে। তারপরও নিজেকে বুঝ দিয়েছি, ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’।

গত পরশু সারা দেশ থেকে গার্মেন্টস কর্মীদের ঢাকামুখী স্রোত থেকে যারপর নাই হতাশ। রাস্তা জুড়ে পিপড়ের সারির মত মানুষ আর মানুষ। কিসের সোশাল ডিসট্যান্সিং আর কিসের স্বাস্থ্যবিধি! সারা দেশ যেখানে লকডাউনে, রাষ্ট্রীয় ছুটি যেখানে বাড়ানো হয়েছে, সেখানে গার্মেন্টস কেন অন্য পথে হাঁটবে? সমস্যাটা আসলে কোথায়? শেখ হাসিনার সরকারকে বিব্রত করার কোন মহাপরিকল্পনার অংশ?

খুলনা থেকে শৈশবের বন্ধু টিপু ফোন করেছিল। জিজ্ঞেস করলাম, বাইরে ঘোরাঘুরি করিস না তো। ও বরাবরই স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। বললো, সারাদিন ঘরেই থাকে, খুব প্রয়োজন না হলে বের হয় না। তবে খুলনা শহরে মানুষজন স্বাধীনভাবে ঘোরাঘুরি করছে। পত্রিকায় শহরের প্রাণকেন্দ্র পিকচার প্যালেসে মানুষের ভীড়ের ছবি ছাপা হয়েছে। সোশাল ডিসট্যান্সিংয়ের ব্যাপারটায় অনেকেই তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না।

ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে যোগাযোগ করেন। ঘরে থাকতে থাকতে তারা বিরক্ত। এভাবে আর কতদিন ঘরে থাকতে হবে বলে অনেকে জানতে চান। এই প্রশ্নের উত্তরটা তো আমার কাছে নাই। তবে সামান্য একজন এপিডেমিওলজিস্ট হিসেবে দীর্ঘ পচিশ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি মার্চের প্রথম দিকে বলেছিলাম, ১৫ এপ্রিলের মধ্যে আমরা বুঝতে পারব বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে। আজ মনে হচ্ছে, আমার পূর্বাভাসটা হয়তো ভুল হবে না। তারপরও আরো সতর্কতার সাথে বলবো, পুরো এপ্রিল মাসটাই আমাদের আসলে দেখা দরকার। তাই, আমি বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করবো, পরিস্থিতি যেদিকেই যাক না কেন, পুরো এপ্রিল মাস জুড়ে যেন দেশে লক ডাউন বলবৎ থাকে। পুরো এক মাস লক ডাউনে থাকলে দেশ যে পরিমান অর্থনৈতিক ক্ষতির সন্মুখীন হবে, মানুষের জীবনের স্বার্থে তা মেনে নিতে হবে।

সুতরাং, পুরো এপ্রিল লকডাউনে থাকার মতো একটা মানসিক প্রস্তুতি এখন থেকেই আমাদের নিয়ে রাখা উচিত। তাতে ভালো বৈ মন্দ হবে না।

লেখক- জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, কবি এবং সাহিত্যিক।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর