‘যুদ্ধটা সবে শুরু, শুরুতেই হেরে যাবেন না’

‘যুদ্ধটা সবে শুরু, শুরুতেই হেরে যাবেন না’

এবিএম জাকিরুল হক টিটন

আজ আমি আপনাদের টাইটানিকের কিছু ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেব। অভিজাত এ জাহাজটি ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল ডুবে গিয়েছিল আটলান্টিক মহাসাগরে। টাইটানিক নামের সাথে কমবেশি অনেকেই পরিচিত।

ওয়ালেস হার্টেন একজন ইংরেজ বেহালাবাদক।

তিনি মারা যান ৩৩ বছর ১০ মাস ১৮ দিন বয়সে। এটা কোনো বিষয় নয়। যেটা আশ্চর্যের বিষয় সেটা হচ্ছে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ভদ্রলোক ছিল জনতার একজন। উনি যেদিন মারা যান, সেদিন উনি বিখ্যাত হবার সুযোগ পেয়েছিলেন।
ভয়ঙ্কর এক ট্রাজেডি তাকে বিখ্যাত হবার সুযোগ করে দিয়েছিল।

হার্টান মারা গিয়েছিলেন ১৯১২ সালের ১৫ এপ্রিল; যেদিন আটলান্টিকের বুকে ডুবে গিয়ে ছিলো আরএমএস টাইটানিক জাহাজ। সেদিন টাইটানিকে যতলোক ডুবে মরে ছিলো হার্টেন তাদের একজন।

ওয়লেস হার্টেন ছিলেন টাইটানিকের মিউজিশিয়ান দলের প্রধান। আপনারা যারা জেমস ক্যামেরন পরিচালিত বিখ্যাত মুভি টাইটানিক দেখেছেন তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে সেই মুভির অসাধারণ সেই দৃশ্যগুলির কথা। ওই ছবিতে হার্টনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জোনাথন ইভান্স জোনস। এখন আপনাদের চোখের সামনে নিশ্চয়ই ভেসে উঠছে সেই অপরূপ দৃশ্য। জাহাজ ফুটো হয়ে যখন প্রচন্ড গতিতে আটলান্টিকের হিমশীতল পানি ঢুকছে, যাত্রীদের কেউ কেউ তখন মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছে। বাকিরা প্রাণ বাঁচাতে হুরহুরি করে লাইফবোটে স্থান করে নিতে যার উপর নাই চেষ্টা করে যাচ্ছে।

জাহাজের তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রী মায়েরা যারা জানেন, ওই ছোট লাইফবোটে তাঁদের স্থান হবে না। তারা তাদের আদরের শিশু সন্তানদের কপালে চুমু দিয়ে রুপকথার গল্প বলে ঘুমিয়ে দিচ্ছেন ঠিক তখনি বেহালা হাতে জাহাজের ডেকে এসে দাঁড়ালেন হার্টেন। তারপর বড় করে একটা শ্বাস নিলেন। তারপর চোখ বুজালেন তিনি। অপার্থিব আঙাগুলে বেজে উঠলো স্কটিশ হাইমের সেই মধুর সুর- "Nearer my God, to Thee "---।

হার্টেলে কে দেখে আর একজন বেহালা হাতে এগিয়ে এলেন। তার পর আরও একজন হার্প হাতে এগিয়ে এলেন। তাপপর আরো একজন। তার পর সবাই মিলে সুর মেলালেন অপূর্ব সুরে।

যাত্রীরা শেষ বারের মত প্রাণ ভরে শুনলেন। তারপর সবাই দেখলেন চারটি মানুষ জাহাজের ডেকে মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে দাড়িয়ে রয়েছেন। যাত্রীরাও দাঁড়িয়ে পড়লেন কেউ কেউ। সবার চোখে অশ্রু। জাহাজের ক্যাপ্টেন স্মিথ লাইফবোটে উঠতে অস্বীকার করছেন। সেই অসম্ভব অতি প্রকৃতির সুর কে পিছনে রেখে নিজের কেবিনে শান্ত ভাবে দাঁড়িয়ে দেখছেন স্রোতের বেগে জাহাজে পানির বেড়ে ওঠা। জাহাজের চিফ আর্কিটেক টমাস অ্যান্দ্রুজ গ্রাড ডাইনিং রুমের এক অপূর্ব ভাস্কর্য চরম মমতায় ছুঁয়ে দেখছেন। জলোচ্ছ্বাসের মত দূরন্ত গতিতে পানি ভাসিয়ে দিচ্ছি জাহাজের এদিক সেদিক। খরকুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে মানুষ। আর চারটি অলৌকিক স্থির মানুষ তখনো দৃঢ় ভাবে বাজিয়ে যাচ্ছেন সেই মোহিত ‘Nearer, my God,toThee (প্রভু, তোমার নিকটে আরও) ...।

ডুবে যাওয়া টাইটানিকের যাত্রী সংখ্যা তুলনায় লাইফবোট ছিলে নিতান্তই অল্প। যেমন আমাদের দেশের জনসংখ্যর তুলনায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নিতান্তই অপ্রতুল। তার তাই নিয়েই এক ভয়াবহ মহামারির মুখে দাড়িয়ে আছে প্রিয় স্বদেশ। আর দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এই হতভাগা দেশের অর্ধেকের বেশি লোক জানে না কত ভয়াবহ হতে পারে তাদের পরিণতি। আমরা যারা কমবেশি জানি বা অনুমান করতে পারি তারা আতঙ্কিত প্রহর গূনছি। মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে অস্থির হয়ে যা যা করছি, তা আমরা নিজেরাও বুঝতে পারছি না। ঘরে বন্দি হয়ে লোক দিয়ে মন মন চাল, ডাল, তেল কিনে ঘর ভরাচ্ছি। একবারও ভাবছি না বা ভাবার প্রয়োজনই মনে করছি না অন্যদের কী হবে, অন্যরা কী পাবে! প্যানডেমিক আর জাহাজ ডুবির মধ্যে এটাই বড় মিল। দুটোই শরীরের আগে মনকে খায়। এটাই সময়। আপনার ভেতরেও একটা ওয়ালেশ হার্টলে বাস করে। আপনার সাথে হয়তো আলাপ নেই। কিন্তু অবশ্যই আছে। মানুষটা কে খুঁজে বের করুন। তার হাতে ধরিয়ে দিন আয়ুধ। বলুন তাকে, বাজান মায়েস্ত্রো, বাজান।

তারপর তন্ময় হয়ে শুনুন। যুদ্ধটা সবে শুরু হয়েছে। শুরুতেই হেরে যাবেন না। নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন না। সব সময় ভালো থাকবেন। ভালো থাকার কোনো দিনক্ষণ লাগে না। মোট কথা ভালো থাকার কোনো বিকল্প নেই।

এবিএম জাকিরুল হক টিটন: রাজনীতিবিদ, লেখক

সূত্র- পূর্বপশ্চিম।

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর