নিখোঁজ সাংবাদিক কাজলের ছেলের চিঠি, বাবা তুমি কোথায় আছো?

নিখোঁজ সাংবাদিক কাজলের ছেলের চিঠি, বাবা তুমি কোথায় আছো?

অনলাইন ডেস্ক

সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল প্রায় একমাস ধরে নিখোঁজ। তিনি গত ১০ মার্চ থেকে নিখোঁজ। কাজলের পরিবার মনে করছে, তাকে অপহরণ করা হয়েছে। তার নিরাপদে ফিরে আসার আকুতি জানিয়ে কর্তৃপক্ষের প্রতি বারবার অনুরোধ জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা।

আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিক কাজল, মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে মামলার পরদিন কাজল নিখোঁজ হন। বানোয়াট তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ আনা হয় তাদের বিরুদ্ধে।
 
নিখোঁজ বাবার প্রতি হৃদয়গ্রাহী একটি চিঠি লিখেছেন সাংবাদিক কাজলের ২০ বছরের ছেলে মনোরম পলক। তার আশা, বাবা যেখানেই থাকুন এটি দেখবেন।

চিঠির লেখা নিচে হুবহু তুলে ধরা হলো-

৩০/০৩/২০২০

প্রিয় বাবা,

আমি জানি না তুমি কোথায় আছো। ভাল যে নেই তা তীব্রভাবে বুঝতে পারছি। কল্পনা করতে পারছি, কী ভীষণ একা একা সময় পার করছ। বুঝতে পারছি, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছ তুমি। ঠিক সেই সময়ের মতো, যখন তুমি মাকে ভারত থেকে সার্জারির পর ফেরত নিয়ে এসেছিলে। আমার মনে হয় না তারা তোমার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারবে। এই চিঠি কি আদৌ তোমার কাছে পৌঁছাবে? তোমাকে কি তারা এই চিঠি পড়তে দেবে? তোমাকে কি তারা ফেরত আসতে দেবে? দিলে কখন দেবে? এই চিঠি যদি তোমার কাছে পৌঁছায়, তবে কিছু কথা তোমাকে বলতে চাই-

তোমার পরিবার এখনও শক্ত আছে। আশায় বুক বেঁধে আছে। এই আশা কখনও ঝাপসা হবে না। আমরা তোমার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষায় আছি। অধীর আগ্রহের সাথে বসে আছি তোমার জন্য। পৌষি খুবই আশাবাদী। ও এখনও খারাপ কোনো চিন্তা করছে না একটি বারের জন্যও। ওর অনেক কথা বলার আছে তোমাকে। ও এখন মায়ের পাশে ঘুমায়। মা আমাকে জিজ্ঞস করে, ‘তুই আসলেই তোর বাবাকে ফেরত আনতে পারবি? কাজল কবে আসবে? আমাদের কতদিন অপেক্ষা করতে হবে?’ আমি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কখনও দেই না, কারণ উত্তরগুলো আমার জানা নেই।

আমি তোমাকে ফেরত আনার চেষ্টা করছি। অনেকে বলছেন, আমি ছেলে হিসেবে অনেক করছি। আমি ছেলে হিসেবে পর্যাপ্ত করেছি, এ কথা তখনই ভাবতে পারব যখন তোমাকে আমাদের মাঝে আবার ফেরত পাব। কেউ কেউ বলছেন, আমার মতো ছেলে তাদের যদি থাকত! পিতামাতাকে তাদের সন্তানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলে যে কোন সন্তানই তাদের পিতামাতাকে ফেরত পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে। আমিও তাই করছি। আমি আমার বাবা-মা কে চিনি। আমি জানি না আমার বাবা-মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা-মা কিনা। কিন্তু আমি জানি, তোমাদের থেকে শ্রেষ্ঠ বাবা-মা আমার কখনও হতে পারত না। আমি সবসময়ই জানতাম, তোমার আর মার আমার থেকে যোগ্য সন্তান প্রাপ্য ছিল। পিতাকে নিয়ে চলে যাওয়ার ২০ দিন পরেও যে সন্তান তার পিতাকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি, সন্তান হিসেবে তার যোগ্যতা কী? এমন ছেলে থেকে কী লাভ?

আমি জানি, এমন কোনো কিছু আমার সাথে হলে তুমি এতক্ষণে আমাকে ফিরিয়ে আনতে। তুমি আমাকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া কখনও ঘরে ঢুকতে না। অনেকের জীবন তুমি এতদিনে কঠিন করে দিতে। আমি তোমার মতো ক্ষমতা রাখি না। আমাদের পরিবার সবসময়ই তোমার ওপরে ভরসা করেছে, বিপদে-আপদে, অসুখে, রোগে, আর্থিক সঙ্কটে । এখন যখন তুমি নেই, আমিই দিশেহারা হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছি আমাদের পরিবারের রক্ষণকর্তাকে।

প্রতি রাতে বাসায় সবার পরে আমি ঘুমাতে যাই। যখন রাতে একা জেগে থাকি, সবসময় আশা করি তুমি চলে আসবে। আমি জানি, তারা তোমাকে আহত করেছে, তবু আশা করি, যে কোনো উপায়ে তুমি এখনও নিজের পায়ে ফিরে আসতে পারবে। রাতে বাইরে পায়ের আওয়াজ শুনলে খুবই উদ্বিগ্ন হই। কারও গলার আওয়াজ শুনলে ভাবি, তুমি কি এসেছ?

দেশের পরিস্থিতি আগের কোনো সময়ের মতোই না। রাস্তাঘাট সম্পূর্ণভাবে ফাঁকা। সবাই বাড়িতে থাকছে। আমারও বাড়িতেই থাকতে হচ্ছে। লজ্জাজনক, আমি জানি। তুমি কখনও বাসায় বসে থাকতে না। এখন কেউ আমার সাথে দেখা করতে রাজি হয় না। আমার যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। এমন এক অসহায় অবস্থায় আছি আমি এখন। দেশ অচল হওয়ার আগে আমি ভোরবেলা বের হয়ে যেতাম। রাত ১/২টার আগে ফিরতাম না। আমি একা বের হতে পারি না। আমাকে অনেকেই বলেছে, আমার ওপর নজর রাখা হচ্ছে। কারা রাখছে, কেন রাখছে, আমি তা জানি না। আমি সাবধান থাকছি যেন আমাদেরকে ব্যবহার করে তোমাকে ভয় দেখাতে না পারে।

আমি আশা করি, তুমি তোমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছ বের হয়ে আসার। এই বাজে পরিস্থিতি থেকে আমিও সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি কোনোদিনও থামব না। তোমাকে সুস্থ, জীবিত অবস্থায় ফেরত পাওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাকে থামানো যাবে না। আমি আমার বাবাকে যে কোনোভাবে আমাদের মাঝে ফেরত চাই ।

আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। আশা করছি, তুমি দ্রুতই চলে আসবে। আশা করছি, এই চিঠি তোমার কাছে পৌঁছাবার আগেই তুমি চলে আসবে। আশা করছি, এখনি তুমি দরজায় টোকা দেবে, আমি এই শেষ কথা লিখে চিঠি শেষ করার আগে-

ইতি,

তোমার ছেলে

পলক

 

নিউজ টোয়েন্টিফোর/কামরুল