করোনা রোগীর বিদায়বেলা- সেবা, স্মৃতি আর বেদনা!

করোনা রোগীর বিদায়বেলা- সেবা, স্মৃতি আর বেদনা!

সেরীন ফেরদৌস

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দুলছে ৫৮ বছর বয়সী জন (আসল নাম নয়)! পরিবারের কেউ হাসপাতালের আইসিইউতে প্রবেশ করতে পারছে না! মারাত্মক ভাইরাসটির বিস্তার রোধে এ কঠিন সিদ্ধান্তটি নিতে হয়েছে কর্তৃপক্ষের! নার্স থ্যাকার এক হাতে তাঁর সেলফোনটি জনের মাথা বরাবর পর্দার এপাশে ধরে রেখেছে আর অন্য হাতে টিস্যু দিয়ে বারবার চোখ মুছছে! ফোনের অপর প্রান্তে, হাসপাতালের বাইরে আকুল হয়ে কাঁদছে জনের প্রিয়জনেরা!

কন্যা কেঁদে কেঁদে বাবাকে ডাকছে, “বাবা, বাবা, জেগে ওঠো! বাবা, আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি... বাড়িতে ফিরে আসো!” নীরবে চোখের জল গড়িয়ে পরছে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সের, কর্তব্যরত ডাক্তারের!

ব্রাম্পটন সিভিক হাসপাতালের আইসিইউ-তে চাকরি করা নার্স দারাস থ্যাকারের অভিজ্ঞতা রয়েছে ২০০৩ সালের সার্স-আক্রমণের সময়কারও। সে জানে, সে এমন একটি ইউনিটে কাজ করছে যেখানে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিকিৎসার পরেও রোগী মারা যায়!

তাঁর জন্য আরো একটি কঠিন মুহূর্ত ছিলো যখন তাঁর নিজেরই সহকর্মী গত ৯ তারিখে শেষ নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন! সেসময় শক্ত করে তাঁর হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন থ্যাকার! তিনি বলেন, “ও তো আমাদেরই একজন! যাবার আগে ওঁর পাশে পরিবারের কেউ ছিলোনা তাতে কি! পাশে দাঁড়িয়ে কেঁদেছি, ওর জন্য প্রার্থনা করেছি! আমার জন্য কঠিনতম একটি মুহূর্ত ছিলো সেটি!”

তবু, এবারে করোনা-ভাইরাসের মরণকামড়ের কাজ করতে এসে বারবারই আবেগাপ্লুত হয়ে পরছেন থ্যাকার! নিজেকে সামলে রাখা দায় হয়ে পরছে বারবার। নিজে আক্রান্ত হন কিনা সে নিয়ে ভয়তো আছেই, নিজ পরিবারের কথাও মাথায় রাখতে হয় তাঁকে। তারপরও দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ”আমাদের পিছিয়ে যাবার সুযোগ নেই! সবাইকে মিলেমিশের শেষ মুহূর্ত পরযন্ত সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যেতে হবে!”

করোনা ভাইরাসটি অতি উচ্চমাত্রায় ছোঁয়াচে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে আত্মীয়স্বজনকে আইসিইউতে প্রবেশ নিষেধ করেছেন।

কিন্তু তাঁরা তাঁদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন এই বিচ্ছেদকে পুষিয়ে দিতে! তাঁরা নিয়মিত প্রিয়জনের সাথে যোগাযোগ করে তাঁদের শেষ ইচ্ছাগুলো পালন করানোর দায়িত্ন পালন করছেন। ডাক্তার, নার্স ও সমাজকর্মীরা সেলফোন, ভিডিও কনফারেন্স ইত্যাদির মাধ্যমে শেষ মুহূর্ত পরযন্ত আত্মীয়-স্বজনকে প্রিয় মানুষটিকে দেখানোর ব্যবস্থা করেছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা নিজেদের ফোন নাম্বার দিয়ে অনুরোধ করছেন, যে-কোনো সময়ে ফোন দিলেই তাঁরা তথ্য দেবেন এই বলে।

উদ্বেগ, প্রিয় মানুষ হারানোর বেদনা, আশংকা-ভয় ইত্যাদি দুর করতে ডাক্তার-নার্স-সমাজকর্মীরা প্রতিমুহূর্তে রোগীর অবস্থা বর্ণনা করছেন কাছের মানুষদেরকে, যাতে পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষভাবে তথ্য পেয়ে তাঁরা একটু হলেও স্বস্তি পেতে পারেন! রোগী যতোই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন, ততই তাঁরা পরিবারগুলোকেও সম্ভাব্য ঘটনার জন্য প্রস্তুত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন।

সবাই মিলে সেই চেষ্টাই করেন যাতে পরিবার-পরিজন অন্ততা একবারের জন্য হলেও প্রিয় মানুষটাকে আন্তরিক “বিদায়” জানাতে পারেন! এমনি তাঁদের শেষকৃত্য কোথায় কিভাবে হবে, সেগুলোরও তদারকি করেছেন তাঁরা।

হাসপাতালের ক্রিটিকাল কেয়ার ডাক্তার ব্রুকস ফ্যালিস এই হাসপাতালেরই একজন ক্লিনারের মৃত্যুর সময় তাঁর পাশে ছিলেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে রোগীর মেয়েটিকে তিনি এক ভিডিও কনফারেন্সে ডাকেন বাবার সাথে কথা বলার জন্য। মেয়েটি ভিডিওতে বাবাকে দেখে উচ্চস্বরে বাবাকে সাহস জোগাতে থাকে। বলে, বাবা, তুমি তো জানেই কত ভালোবাসি তোমাকে অমি! আর একটু শক্ত হও তো, আরো একটু চেষ্টা করো টিকে থাকতে! তুমি পারবে বাবা, তোমার শক্তি অনেক, জানি তুমি ফিরে আসবে! ডাঃ ফ্যালিস বলেন, “আমি আর নার্স তখন কাঁদছিলাম। এই ভেবে ভালোও লাগছিলো যে শেষ পরযন্ত মেয়েটি বাবার সাথে কথা বলতে পেরেছে!”

এরকম আরো অনেক ঘটনাই আছে। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের শেষ বিদায়ের সময় নানারকম আকাঙ্ক্ষা বা রীতিনীতি পালনের রেওয়াজ থাকে। হাসপাতালে সেগুলোও যথাসাধ্য পালন করার চেষ্টা করছেন তাঁরা। যেমন, ব্রাম্পটন হাসপাতালের সমাজকর্মী ড্যানিয়েল রোগীর স্বজনের ইচ্ছা অনুযায়ী, একজন রোগীর হাত-পা এবং শরীর একটি নির্দিষ্ট দিক বরাবর করে শুইয়ে দিয়েছেন। আবার আরেকজন রোগী মারা যাবার আগে তাঁর সারা গায়ে পবিত্র পানি ছিটিয়ে দেবার কাজটি করেছেন একজন ডাক্তার। ভিডিও কলে রোগীর স্বজনেরা কিভাবে কাজটি করতে হবে তার নির্দেশনা দিয়েছেন ডাক্তারকে!

ডা. ফ্যালিসের মতে, শুধুতো করোনার জন্যই নয়, আইসিইউ লাইফ সাপোর্ট, কিডনি ডায়ালাইসিস, ভেন্টিলেটর, হার্ট-সাপোর্ট ইত্যাদি নানারকম যন্ত্রপাতিতে ঠাসা থাকে। এইসব হাজারো মেশিনপত্রের ভিড়ে প্রিয় মানুষটিকে নিথর হয়ে পরে থাকতে দেখাটাও প্রিয়জনের একটা বেদনাদায়ক ব্যাপার।

তিনি বলেন, আমাদের কাজ হলো পরিবারের সেসব বেদনাও ভাগাভাগি করে নেওয়া। আর যতোটা সম্ভব তাঁদের শেষ ইচ্ছাটুকু পূরণ করা!

নার্স থ্যাকার তাঁর সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ভেন্টিলেটরে সারি সারি শুয়ে আছে ঘুমন্ত রোগীরা, কারো নড়াচড়া নেই, সবাইকে দেখতে একই রকম লাগছে! মনে হতে থাকে, কেনো হরর ছবির অংশ এই আমি ও আমরা! কিছুই করার নেই কারো, শুধু তাঁদের জেগে ওঠার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া!

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক: কানাডার কমিউনিটি নার্স।

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর