সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে মুজিবনগর সরকার

সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে মুজিবনগর সরকার

এফ এম শাহীন

১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। এই দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। একাত্তরের অগ্নিঝরা এ দিনেই বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিমূল রচিত হয়েছিল। বৈদ্যনাথতলার নামকরণ হয় মুজিবনগর।

পরবর্তীতে দিবসটি মুজিবনগর দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর ১০ এপ্রিল এ সরকার গঠিত হয়। বাঙালি জাগরণের মহাজাদুকর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নামের সঙ্গে মিল রেখে এ স্থানের নামকরণ করা হয় মুজিবনগর।
শপথ গ্রহণের পর মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মহানায়ক বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক সংবাদ সম্মেলনে যুদ্ধ পরিচালনাকারী সরকারের রাজধানীর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করেন। করোনার আঘাতে এবার আনুষ্ঠানিক কোন আয়োজন না থাকলেও বাঙালির চেতনায় সদা জাগ্রত থাকবে এই দিনটি।  

পাকিস্তানিদের হাতে বন্দী জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করে এদিন গঠিত হয় প্রবাসী বিপ্লবী সরকার। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান প্রায় স্বাধীন বাংলাদেশের নাম। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। স্বাধীনতার সেই ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্র রচনা করেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।  

মুজিবনগর সরকার এর ৪৯ বছর অতিক্রান্ত হলো আজ। ৫০ বছর পূর্ণ হবে ২০২১ সালে। সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে এসে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মেলাতে গিয়ে সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে আমাদের প্রাপ্তির পাল্লাই ভারী। অনেকে মনে করেন আরো মর্যাদাশীল জাতিতে আমরা পরিণত হতে পারতাম যদি আমাদের মধ্যে দেশ প্রেম ও মানবিক গুণাবলির চর্চা করতে পারতাম। আমরা আরো বেশি সমৃদ্ধশালী হতে পারতাম যদি অনিয়ম, লুটপাট, দুর্নীতি ও ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত থেকে সাম্যবাদী বিজ্ঞান ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ করতে পারতাম।   
  
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট আকস্মিক সুনামির মতোই সদ্য জন্ম নেয়া বাংলাদেশ হারিয়েছে জাতি-রাষ্ট্রটির স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে দেশ আবার পকিস্তানমুখি যাত্রা শুরু করেছিল। একই বছরের ৪ নভেম্বর কারাগারে একই খুনিচক্রের হাতে নিহত হন বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহকর্মী চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামান। নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে বাংলাদেশ।  

উল্টোপথের যাত্রী বাংলাদেশের তখন ঘোর অমাবস্যা। এমনই এক পটভূমিতে ১৯৮১ সালে তাঁর অনুপস্থিতিতে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দিশেহারা নেতাকর্মীরা তাঁর হাতেই তুলে দিয়েছিল মুক্তির মশাল। ১৯৮১ সালের ১৭ মে এক বর্ষণমুখর দিনে দীর্ঘ নির্বাসন থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। ধিরে ধিরে শেখ হাসিনা হয়ে ওঠেন বাঙালির প্রত্যাশা পূরণের স্বপ্ন সারথি।  

আমরা দুশো বছর ব্রিটিশদের অধীনে ছিলাম। আমরা ২৪ বছর পাকিস্তানিদের অধীনে ছিলাম। নয়মাস মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, স্বাধীনতার প্রকৃত প্রাপ্তি এনে দিয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। জাতির পিতার খুনিদের শাস্তি, মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী মানবতাবিরোধী কুখ্যাত রাজাকার, আল শামস, আল বদরদের বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি নিশ্চিত করাও অন্যতম অর্জন। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। ৩০ লক্ষ জীবন উৎস্বর্গ করেছি, চার লক্ষ মা-বোনের নির্যাতনের আত্মচিৎকার আজও ভেসে বেড়ায় আকাশে বাতাসে। আজ বাঙালি স্বাধীন। তবে এখন ব্রিটিশরা নেই, পাকিস্তানিরা নেই, জমিদাররা নেই। কিন্তু শোষণহীন রাষ্ট্র ,বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ সম্ভব হয়নি ।  

এক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের তলাবিহীন রাষ্ট্রীয় গ্লানি মোচন করে দুর্বিনীত গতিতে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি । রোহিঙ্গাদের দুর্দিনে মানবতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে আজ বিশ্বদরবারে মানবতাবাদী রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন করেছি। আমাদের বাংলা ভাষা ও কৃষ্টিতে আজ বিশ্বকে মুগ্ধ করে বাংলা ভাষা বিশ্বের মধুরতম ভাষা বলেও স্বীকৃত হয়েছে। আমরা অবকাঠামো উন্নয়নে বিশ্বে সুনাম অর্জন করে চলেছি।  

কিন্তু সবকিছু থামিয়ে দিতে চায় দুর্নীতি, লুটপাট, মাদক, ধর্মীয় উগ্রবাদ, অনিয়ম আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি। আজ পাকিস্তানের ২২ পরিবার না থাকলেও কয়েকজন মানুষের হাতে দেশের অধিকাংশ সম্পদ। জাতির পিতার বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র চিন্তা আজ ভূলুণ্ঠিত। তাদের কয়েকজনের হাতে দেশের নাটাই। চার দশক আগে বঙ্গবন্ধু যেমন বলেছিলেন, পাকিস্তান সব লুট করে নিয়ে রেখে গেছে এক চোরের খনি। চার দশক পরে তাঁর কন্যা যখন রাষ্ট্র পরিচালনায় তখন বলতে বাধ্য হন, আমাকে বাদে সবাইকে কেনা যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কখনো আপোষ করেননি। কিন্তু শেখ হাসিনাকে অনেকক্ষেত্রে জনসাধারণের প্রত্যাশার বিপরীতে অবস্থান নিতে দেখি। বর্তমানের মন্ত্রী পরিষদ ও আওয়ামী লীগের চেহারা দেখলে মনে হতে পারে, এরা সবাই শেখ হাসিনার পছন্দের হতে পারে না। এক অদৃশ্য অপশক্তির ইশারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু কন্যাকে ভীষণ অচেনা লাগে তখন। তাঁর সাহসী মাদকবিরোধী, ক্যাসিনো বিরোধী, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান হঠাৎ কেন থেমে যায় সে প্রশ্ন এই প্রজন্মের অনেকের। পাপিয়া কাণ্ডের ধামাকা ভিন্ন ইস্যুতে চাপা পড়ে নতুন করে রাজ্য চালায় যৌন রাণী ও তাদের খদ্দেরগণ। ব্যাংক, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতারা ক্ষমতার চেয়ারে বসে হুঙ্কার দেয়। তারা দেশের সম্পদ পাচার করে বেগম পাড়ায় আলিশান প্রাসাদ গড়ে।  

বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির যে দর্শনে জাতির পিতা আজীবন লড়াই করে গেছেন, সংগ্রাম করে গেছেন চিন্তার দাসত্ব থেকে মুক্তির জন্য। সেই দর্শন থেকে কিছুটা হলে দূরে সরে গেছে জাতির পিতার সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বর্তমানের নীতি নির্ধারকগণ আমিত্ব নিয়ে এত বেশি ব্যস্ত যে, দল দেশের সাথে প্রতারণা করে আদর্শহীন চরিত্র ধারণ করে নিজের ভোগ, উপভোগ, সম্ভোগ ছাড়া তাদের সামগ্রিক চিন্তার প্রকাশ একেবারে নাই বললেই চলে।  

স্বাধীনতার পর দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার সংগ্রামের পাশাপাশি ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে নতুন সংগ্রামের ডাক দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু কতটা সোচ্চার ছিলেন তা আলোচনায় এসেছে সামান্যই। বঙ্গবন্ধুর ভাষণগুলো লক্ষ করলে দেখা যায়, ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে তরুণ বয়স থেকে শুরু করে জীবনের শেষ পর্যন্ত সোচ্চার ছিলেন তিনি। তিনি দুর্নীতিকে দেশের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। সদ্য-স্বাধীন দেশে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কয়েক লাখ জনতার সামনে দেওয়া ভাষণে স্বাধীনতার সার্থকতা ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান ঘোষণা করেন। আবেগাপ্লুত জাতির জনক বলেন, ‘আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম—ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি আমার বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়। ...যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে। আপনারা জানেন, আমি সমস্ত জনগণকে চাই, যেখানে রাস্তা ভেঙে গেছে, নিজেরা রাস্তা করতে শুরু করে দেও। আমি চাই জমিতে যাও, ধান বোনাও, কর্মচারীদের বলে দেবার চাই, একজনও ঘুষ খাবেন না, ঘুষখোরদের আমি ক্ষমা করব না। ’ 

বাংলাদেশের ৪৯ বছরে আমাদের প্রাপ্তি আর অর্জন অনেক। তবে যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল তার অনেক কিছুই এখনো অপূর্ণ রয়ে গেছে। আমাদের আরো বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। আমাদের যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সেটা এখনো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দুর্নীতি আর সুশাসনের অভাবে সেই চেতনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এই দীর্ঘ পরিক্রমায় কতটুকু সার্থক হয়েছে, তা আজ আমাদের জিজ্ঞাসা। হাজারো সমস্যার মধ্যে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষা নিয়ে চলছে নানা বাণিজ্য। সুতরাং স্বাধীনতার ৪৯ বছরে প্রাপ্তি পুরোপুরি তখনই হবে যখন সকল অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাবে দেশ।  

স্বাধীনতা যে কোনো দেশের অমূল্য সম্পদ। মুজিব নগর সরকার হচ্ছে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম কার্যকরী সরকার, ১৭ এপ্রিল মুজিব নগর দিবসটি বাঙালি জাতির জীবনের এক অবিস্মরণীয় গৌরবগাঁথা দিন। জাতির জন্য এদিনটি একটি ঐতিহাসিক এবং জাতির চেতনাবোধ জাগ্রতের দিন হিসেবে পালন করতে হবে।

লেখক : সম্পাদক, ডেইলি জাগরণ ডট কম।
সাধারণ সম্পাদক, গৌরব ‘৭১’।

 

নিউজ টোয়েন্টিফোর/কামরুল