সাহস করে সত্যিটা বলেন...

সাহস করে সত্যিটা বলেন...

বাণী ইয়াসমিন হাসি

ঢাকা বিভাগের সাথে প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সে নারায়ণগঞ্জের ৩০০ শয্যা হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক জানালেন উনার হাসপাতালের ডাক্তার নার্সসহ ১৬ জন আক্রান্ত। তারমধ্যে ঐ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কও রয়েছেন। উনি আক্রান্তের কারণ হিসেবে বললেন উনারা কোন এন-৯৫ মাস্ক পাননি। প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বলা হলো উনারা কাছাকাছি মানের মাস্ক সংগ্রহ করছেন, সামনের সপ্তাহে আরও করবেন।

প্রধানমন্ত্রীর মাস্ক সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে একজনের কথার মাঝখানে ডিজি হেলথ মাইক কেড়ে নিয়ে বললেন, উনারা চাহিদা জানালে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।

প্রধানমন্ত্রী ঘোর বিস্ময় নিয়ে বললেন নারায়ণগঞ্জে রিসার্চবেইজড কিছু নেই! একটা ল্যাব করার মত উপযুক্ত কোন প্রতিষ্ঠান নেই! ঢাকার এত কাছে! তারমানে কি এরা এতদিন ঢাকার উপর নির্ভর করে চলছে! নারায়ণগঞ্জের জন্য ডেডিকেটেড টেস্টের ব্যবস্থা করতে বললেন প্রধানমন্ত্রী। দিনে একবার নয় একের অধিকবার স্যাম্পল পাঠাতে বললেন। প্রধানমন্ত্রী, এরা এতদিন বলে আসছে সব ধরণের প্রস্তুতি আছে তাদেরকে আপনি কি বলবেন? এরা আপনাকে কতটা অন্ধকারে রাখে তার প্রমাণ তো আপনি মাত্রই পেলেন।

নারায়ণগঞ্জে যদি এই অবস্থা হয় তাহলে বাকি দেশের কি অবস্থা ?

গোপালগঞ্জের ডিসি প্রধানমন্ত্রীকে বললেন, কোথাও পরিবারগুলোর পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। উনারা এটা নিয়ে কাজ করছেন। এজন্য সবার ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছাতে সময় লাগছে।

কয়েক সপ্তাহ চলে গেলেও এখনো কোথাও কোন পূর্ণাঙ্গ তালিকা নেই। যে জেলায় বা উপজেলায়ই প্রশ্ন করা হয় সবার একই উত্তর- এটা নিয়ে কাজ চলছে! আমার প্রশ্ন হলো- দেশটা তো আরো কয়েক বছর আগেই ডিজিটাল হয়ছে। তাহলে ডিজিটালি কেন সব নাগরিকের তথ্য নেই? এই খাতে যে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ, সেগুলো তাহলে কোথায় যায়?সবই কি আসলে শুভংকরের ফাঁকি !

করোনা আক্রান্ত রোগীদের স্বাস্থ্য সেবাদানকারী চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য সদস্যদের কোয়ারেন্টাইন কিংবা অবস্থানের জন্য বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল নির্ধারণ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার (১৪ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। গত মঙ্গলবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় নির্ধারিত হাসপাতালে সেবাদানকারী ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের অবস্থান বা কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্যে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওসহ রাজধানীর ২০টি হোটেলে ব্যবস্থা করছে সরকার।

‌অদ্ভুত ব্যাপার হলো প্রস্তাবিত তালিকায় থাকা হোটেলের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় এ বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না এবং তাদের সঙ্গে কেউ এ বিষয়ে আলোচনা করেনি। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আমিনুল হাসান বলেন, ‘আমরা শুধু হোটেলগুলোর নাম প্রস্তাব করেছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। এটা চূড়ান্ত তালিকা নয়। ’

হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না। মন্ত্রণালয় এ সম্পর্কে বলতে পারবে। ’ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব (হাসপাতাল) সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘হোটেলগুলো এখনও রিকুইজিশন করা হয়নি। ’ হোটেলগুলোর সঙ্গে কথা বলছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হোটেলগুলোর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছে। ’

যখন বলা হলো যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে এটা মন্ত্রণালয় দেখবে এবং সিদ্ধান্ত নেবে, তখন তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি একজন কর্মকর্তাকে এ কাজে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ’ কর্মকর্তার নাম জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে ঐ কর্মকর্তার নাম মনে করতে পারছি না। ’ গণমাধ্যম থেকে মানুষ জানছে যে ডাক্তার নার্সদের জন্য চার তারকা-পাঁচ তারকা মানের হোটেল বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো- ডাক্তার নার্সরা তিনবেলা ঠিকমত খাবারই পাচ্ছেন না। কোন কোন বাড়িওয়ালা তাদেরকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশও দিয়েছে! আর কত দায়িত্বহীনতা দেখবো?

সব বর্ডার বন্ধ। এবার সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসা ব্যবস্থা ঠিক করবেন নাকি নিজেও মরবেন ! সাহস করে সত্যিটা বলেন। আর লুকোচুরি খেলবেন না। সমস্যা তুলে ধরার কারণে নারায়ণগঞ্জের ঐ ডাক্তার কিন্তু কোন শাস্তি পাননি বরং ঐখানকার সমস্যার সমাধান হচ্ছে। চার মিনিটের সাড়ে তিনমিনিটই তেল আর বন্দনায় ব্যয় করবেন না। প্রধানমন্ত্রী সমস্যা শোনার জন্য জানার জন্য ভিডিও কনফারেন্সে বসেছেন আপনাদের তেলের জন্য না।

জরুরি দুর্যোগের সময় সবধরনের সম্ভাষণ আর তেল-ঘি এড়িয়ে কিভাবে মূল বক্তব্য দিতে হয়, সংকট ও সমস্যার কথাগুলো তুলে ধরতে হয়; সেই প্রশিক্ষণ দেওয়াটা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। নেতা আর আমলা দুই পক্ষকেই দিতে হবে। মাঝেমধ্যে মনে হয় সৃষ্টিকর্তা কি এদের কমনসেন্স টুকুও দেন নাই? কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের কথা আপনারা সবাই শুনেছেন। করোনার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে এ হাসপাতালটাকে। আসেন দেখে নিই এ হাসপাতালটার প্রস্তুতি কেমন?

এই হাসপাতালে কোন সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন নেই। সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন ছাড়া আইসিইউ কিভাবে চলছে? এক্সরে মেশিনটাও এখনো চালু হয়নি। শ্বাসকষ্টই যেখানে মেইন কমপ্লেইন, সেখানে এক্সরে ছাড়া কি চিকিৎসা দেবে ডাক্তাররা? রাস্তার পাশের ভুঁইফোড় ক্লিনিকগুলোতেও কয়েকজন করে ক্লিনার থাকে, অথচ সবচেয়ে প্রস্তুত এ হাসপাতালটি চলছে একজন মাত্র ক্লিনার দিয়েই। এখানকার ডাক্তার বা নার্সদের খাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। অবশেষে বিদ্যানন্দ এক টাকায় খাবার প্রকল্প থেকে ডাক্তার নার্সদের খাবার ব্যবস্থা করেছে।
এত সব কষ্টের মধ্যেও যারা কাজ করছেন তাদেরকে দুম করে বরখাস্ত করে পরে বলা হলো ভুল হয়েছে। এই যদি হয় দেশের সবচেয়ে প্রস্তুত করোনা হাসপাতালের প্রস্তুতির দশা, তাহলে আমরা কেমন প্রস্তুত বলেন তো?

হ্যাঁ, গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। গতকাল সমগ্র বাংলাদেশকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। সংক্রমণ রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ (২০১৮ সালের ৬১ নম্বর আইন) এর ১১ (১) ধারার ক্ষমতা বলে এ ঘোষণা করা হয়।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারি আকার বিস্তার লাভ করায় লাখ লাখ লোক আক্রান্ত হয়েছে এবং লক্ষাধিক লোক মৃত্যুবরণ করেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটছে। হাঁচি কাশি ও পরস্পরের মেলামেশার কারণে এ রোগের বিস্তার ঘটে। এখন পর্যন্ত বিশ্বে এ রোগের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী এই রোগের একমাত্র প্রতিষেধক হলো পরস্পর পরস্পর থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থান করা এবং জনসাধারণের একে অপরের সাথে মেলামেশা নিষিদ্ধ করা ছাড়া সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হলো ঘোষণা টা এত দেরি করে কেন এলো?

নতুন করে শনাক্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যার রেকর্ড হচ্ছে প্রতিদিন। সবচেয়ে কম টেস্টের তালিকায় বাংলাদেশ সম্ভবত ৩ নম্বরে। একবার চিন্তা করে দেখেন টেস্টের সংখ্যা বাড়লে শনাক্তের সংখ্যা কতটা বাড়বে! স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিং এ শুধুমাত্র তারা যে কেসগুলো কনফার্ম হয়েছে সেই সংখ্যাগুলোই ঘোষণা করছে। প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ।

এক ভিক্ষুককে এক কোটিপতি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাকে যদি আমি ৫০০ কোটি টাকা দেই তাহলে কি করবেন?
ভিক্ষুক: একটা ব...ড় (বড়) করে শপিং মল বানাবো।
কোটিপতি: তারপর কি করবেন?
ভিক্ষুক: কেন সেই শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে আমি একাই ভিক্ষা করবো, আর কোন ফকিরকেই দাঁড়াতে দেব না।
যেকোন পরিস্থিতিতেই কিছু মানুষ চুরি করবে, সেটা ত্রাণ হোক কিংবা বাপের কাফনের কাপড়!

সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে সংকট। শুধু সংখ্যার হিসেবে নয় করোনা আতঙ্কে সত্যিকার অর্থেই কাঁপছে বিশ্ব। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। যেকোন মহাযুদ্ধের চেয়েও বড় কঠিন এই যুদ্ধ। কলি যুগে দুষ্টের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিলে। মানুষের কষ্ট বেড়েছিল। বৈশাখ মাসের শুক্ল পক্ষে তৃতীয়া তিথিতে সত্যযুগের উৎপত্তি। এখন আমাদের এই সত্যযুগে যেতে হবে। এখানে সবাই একজন যোদ্ধা। সত্যের প্রশ্নে ন্যায্যতার পক্ষে মানবতার পক্ষে সাম্যের পক্ষে আপনিও এগিয়ে আসেন। আপনার চোখের সামনে ঘটা সত্যিটা তুলে ধরেন, আওয়াজ তোলেন। মরার আগে না হয় একবার চিৎকার করেই মরেন। সেই মৃত্যুও অনেক গৌরবের। সত্যের হাত ধরেই এই আঁধার কেটে যাবে। আলো আসবেই ...

লেখক : সম্পাদক, বিবার্তা ২৪ ডটনেট।