নিজের দায়বদ্ধতা থেকেই এই বিষয় লিখতে বসলাম

নিজের দায়বদ্ধতা থেকেই এই বিষয় লিখতে বসলাম

আমিনুল ইসলাম

অ্যানি আপা, আমি আপনাকে চিনি সেই ২০১৩ সাল থেকে। সেবার দেশে গিয়ে আপনার বাসায়ও গিয়েছি। আপনার পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছি।

নিজের এবং পৃথিবীর এই কঠিন সময়ে এই নিয়ে লেখার একদম ইচ্ছে করছিল না।

এরপর মনে হলো- না লিখলে নিজের এবং সামজের প্রতি অবিচার করা হবে। দায়বদ্ধতা থেকেই লিখতে বসলাম।  

দেশের নানান পত্রিকার রিপোর্ট এবং ভাইরাল ফেসবুক পোস্ট গুলো থেকে জানতে পারলাম; আপনার বাসার কাজের মেয়েকে আপনি শুধু অকথ্য ভাষায় গালাগালিই করেননি; তাকে ভয়ংকর ভাবে মেরেছেন। সেই ভিডিও আমি নিজেই দেখছি।

 

মেয়েটার অপরাধ কি ছিল; সে কি করেছে; এমন কোনো প্রশ্নেই আমি যাবো না। আপনি তো মানবতায় বিশ্বাস করেন। আপনি তো নারী অধিকারে বিশ্বাস করেন। সেই আপনি কি করে এমন কাজ করতে পারলেন? কোনো মানুষকে কি এভাবে অকথ্য ভাষায় গাল দেয়া যায়? এভাবে মেরে আহত করা যায়?

এরপরও আমি ধরে নিলাম সাময়িক রাগের মাথায় আপনি এমন জঘন্য কাজ করে বসেছেন। কিন্তু ঘটনার এতো ঘণ্টা পরে আপনি সেই কাজের সাফাই গাইলেন; সেটাকে কোন হিসাবে দেখবো?

আপনি লিখলেন-ওই মেয়ে আপনার কাছে টাকা চেয়েছে। আপনাকে ব্লেকমেইল করতে চেয়েছে।

মেয়েটা তো আপনার বাসায় মাত্র এক দিন কাজ করেছে। ওই এক দিনে কি করে সে আপনাকে ব্লেকমেইল করে? সে যদি ব্লেকমেইলও করে থাকে কিংবা টাকাও যদি চেয়ে থাকে; তাই বলে কি আপনি তাকে এভাবে গাল দিতে পারেন? এভাবে মেরে আহত করতে পারেন? তাহলে কি করে আপনি এমন একটা কাজ করে আবার সাফাই গাইছেন?

শুধু তাই না; সেই সাফাই আপনি ফেসবুকে লিখে ১৫-২০ জনকে ট্যাগ করেছেন; যারা সমাজে পরিচিত মানুষ। এদের অনেককে আমিও চিনি। এর দ্বারা আপনি কি বুঝাতে চাইলেন? আপনার অনেক চেনা-জানা কিংবা আপনার অনেক ক্ষমতা! আপনি কি করে এই কাজ করতে পারলেন? বোর্ডে ডাবল স্ট্যান্ড করেছেন; বুয়েটে পড়াশুনা করেছেন; নামি-দামী আর্কিটেক্ট আপনি। সমাজের উপরতলার মানুষই বলা যায় আপনাকে। কিন্তু আপনি তো মানবতার কথা বলতেন। সেই আপনি কি করে এই কাজ করলেন?

এই যে আপনি রাগের মাথায় মেয়েটাকে জঘন্য ভাষায় গাল দিয়েছেন কিংবা মেরে আহত করেছেন; এই কাজ করে আপনি যতটা না অপরাধ করেছেন; আমার দৃষ্টিতে আপনি এর চাইতে কয়েক গুণ বেশি অপরাধ করেছেন; ঘটনার এতো ঘণ্টা পর যখন ঠাণ্ডা মাথায় আবার সেই কাজের সাফাই গাইছেন কিংবা নিজের ক্ষমতা দেখাচ্ছেন!

আমরা সবাই মানুষ। রাগের মাথায় ভুল-ভ্রান্তি আমাদের হয়ে যেতে পারে। নইলে তো আমরা একেক জন দেবতা হয়ে যেতাম। কিন্তু অপরাধ করে যেই মানুষ সেই অপরাধের পক্ষে ঠাণ্ডা মাথায় সাফাই গায়; সেই মানুষের পক্ষে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অপরাধ করে বেড়ানো সম্ভব। এই লেখা লেখার সময় আমি প্রচণ্ড মানসিক কষ্টের মাঝ দিয়ে যাচ্ছি।

কারণ আপনার পুত্র এবং কন্যা; এরা দু'জনেও আমার বন্ধু তালিকাতেই আছে এবং আমার এই লেখা ওরাও পড়বে। ওরা আমাকে মামা বলেই ডাকে। আমার আপন ভাগ্নে-ভাগ্নি হলে ওদেরকে যা বলতাম; আপনার পুত্র-কন্যাদেরও ঠিক সেটাই বলছি-তোমরা দয়া করে তোমাদের মার এই অপরাধের পক্ষে সাফাই গাইবে না। বরং তোমাদের উচিত হবে তোমাদের মা যাতে তার ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চায়; সেটা মনে করিয়ে দেয়া।

মানুষ ভুল করতেই পারে। সেই ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চাইতে ক্ষতি কি? উল্টো আপনি কিনা এর পক্ষে সাফাই গাইছেন!

আপনি যে অন্যায় করেছেন; প্রচলিত আইনে যেই শাস্তি আপনার প্রাপ্য; সেটা যেমন আপনার পাওয়া উচিত; ঠিক তেমনি ওই মেয়েটির কাছে আপনার হাত জোর করে ক্ষমা চাওয়া উচিত। আপনি শুধু ওই মেয়েটিকে গালিই দেননি। আপনি মেয়েটিকে বলেছেন-‘‘রাস্তার মেয়ে’’ শুধু তাই না, বলেছেন "আবার শুদ্ধ করে কথা বলে!। " শুদ্ধ করে কথা বললে আপনার সমস্যা কোথায়? আর রাস্তার মেয়ে মানে কি? তাছাড়া সে যদি রাস্তার মেয়েও হয়ে থাকে; এতে আপনার সমস্যা কোথায়? আপনার একটা মেয়ে তো প্রতিবন্ধী। এখন কেউ যদি তাকে গিয়ে বলে-প্রতিবন্ধী মেয়ের আবার বড় বড় কথা। তখন আপনার কেমন লাগবে?

এই মেয়েটা তার অবস্থানে থেকেও চমৎকার করে কথা বলতে শিখেছে; সুন্দর ভাবে গুছিয়ে কথা বলতে জানে; আপনার তো বরং এতে উচ্ছ্বসিত হবার কথা ছিল। আপনি না মানবিধাকার নিয়ে কাজ করেন? আপনি না নারী অধিকারের কথা বলে বেড়ান? সেই আপনি কি করে এই কাজ করলেন? করে ফেলেছেন ভালো কথা; ধরে নিচ্ছি প্রচণ্ড রাগে হয়তো মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারেননি; তাহলে ঘটনার এতো ঘণ্টা পর ঠাণ্ডা মাথায় কি করে ওই ঘটনার উল্টো সাফাই গান? এটা বোধকরি আমাদের সকলেরই শেখা উচিত।

মানুষ ভুল করতেই পারে। এই জন্'ই আমরা মানুষ। আমরা কেউ দেবতা না। সেই ভুলটা স্বীকার করে যদি আমরা ক্ষমা চাই; তাহলে বুঝতে হবে আমরা বুঝতে পেরেছি আমাদের ভুলটা। কিন্তু ভুল স্বীকার না করে যদি উল্টো সেই ভুলের সাফাই গাওয়া হয়; তখন সেটা আর ভুল থাকে না; সেটা হয়ে যায় অন্যায় কিংবা অপরাধ।  

যেটা আপনি করেছেন। আপনার পুত্র-কন্যা দুজনেই আমার লেখা পড়বে। আমার নিজেরই খারাপ লাগছে এভাবে লিখতে। আপনার উচিত হবে আপনার পুত্র-কন্যার দিকে তাকিয়ে হলেও ওই মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাওয়া। পুরো দেশ এবং সমাজের কাছে ক্ষমা চাওয়া। নইলে আপনার পুত্র-কন্যারা কি শিখবে? আপনি নিশ্চয় চাননা-ওরা এমন কিছু  শিখুক; যা ওদেরকে অমানুষ হতে শেখায়।

আমি জানি, কি কষ্ট করে আপনি একা একজন নারী, এই দুই পুত্র-কন্যাকে বড় করেছেন। এর মাঝে একজন প্রতিবন্ধী। আপনি নিশ্চয় চাইবেন না-ওরা অমানবিক মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠুক। ক্ষমা চান। প্রয়োজনে বার বার ক্ষমা চান। ক্ষমা চাইতে পারাটাও বোধকরি একটা গুণ। যা আমরা বেশিরভাগ বাংলাদেশি এখনও শিখে উঠিনি।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

 

নিউজ টোয়েন্টিফোর/কামরুল