ধন্যবাদ ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’

ধন্যবাদ ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’

বাণী ইয়াসমিন হাসি

৭১’এ দেশ মাতৃকার প্রয়োজনে জীবনবাজি রেখে লড়েছিলো এদেশের কৃষক শ্রমিক জনতা। তাদের সাথে যোগ দিয়েছিলো ছাত্ররা। এদেশে রুমী আজাদদের সংখ্যা হাতেগোনা। সংখ্যার হিসেবে খুব কম এলিটই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

গোটা পৃথিবীটাই আজ অন্যরকম এক যুদ্ধে লিপ্ত। না, এ যুদ্ধে অস্ত্রের কোন ঝনঝনানি নেই, বারুদের গন্ধ নেই। কিন্তু মৃত্যু আছে। অদেখা ভাইরাসের বিরূদ্ধে এক অসম যুদ্ধ।

আমাদের এই ছোট্ট দেশটাও কঠিন এক সময় পার করছে। প্রতি মুহূর্তে অমানবিকতা আর অনাচারের আস্ফালন। হ্যাঁ এর ভিড়ে মানবিকতার গল্পও আছে।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সারাদেশে মানুষের পাশে যেসব সংগঠন দাঁড়িয়েছে, তাদের অন্যতম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। কেউই যখন আক্রান্ত হয়নি তখন থেকেই জনসচেতনতা বাড়াতে লিফলেট, মাস্ক ও স্যানিটাইজার বিতরণ শুরু করে সংগঠনের নেতাকর্মীরা।  

এখন ঢাকাসহ সারাদেশে সাধ্যমত খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে সংগঠনের নেতাকর্মীরা। শুধু খাদ্য সামগ্রীই নয়, মোবাইল ফোনে ছাত্রলীগের মেডিকেল টিম স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। মানুষের বাড়িতে ওষুধ পৌঁছে দেওয়া, বিনা পয়সায় অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করেছেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ক্যাম্পাস, মসজিদ, বাজার ও মোড়ে মোড়ে হাত ধোয়ার জন্য সাবান ও পানির ব্যবস্থা করেছে। মানুষের বাড়ি বাড়ি খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দিতে রাতভর খাদ্য সামগ্রীর প্যাকেট করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে খাদ্য সামগ্রীর প্যাকেটের উপর ঘুমিয়ে পড়েছে ছাত্রলীগের কর্মীরা এমন ছবিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেও জেলা-মহানগর ও উপজেলা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রাতদিন মানুষের সেবায় কাজ করছে। মানুষের বাড়ি বাড়ি খাদ্য পৌঁছানোর পাশাপাশি ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, মাস্ক ও স্যানিটাইজার বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন। ক্যাম্পাস ছুটি হওয়ায় অনেক  ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা এখন নিজ নিজ গ্রামে অবস্থান করছ। সে কারণে স্ব স্ব এলাকার নেতাকর্মী, বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে এগিয়ে  এসেছে মানুষের সেবায়।

বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে থেমে গেছে স্বাভাবিক জনজীবন। সর্বত্রই চলছে অঘোষিত লকডাউন। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছে দিন মজুর ও খেটে খাওয়া মানুষ। এসব অসহায় দরিদ্র মানুষের দিকেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ছাত্রলীগ।

যার যা প্রয়োজন নিয়ে যান এমন ব্যানার নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফ্রি সবজি বাজারের আয়োজন করেছে তারা। যেখান থেকে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো যার যতটুকু প্রয়োজন বিনামূল্যে নিতে পারবেন। নিজেদের অর্থায়নে বিভিন্ন জায়গা থেকে সবজি সংগ্রহ করে পথে পথে বিতরণ করছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।

চলতি মৌসুমের আগাম ইরি-বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। তবে ধানের বাম্পার ফলন হলেও করোনা আতঙ্কে ধানকাটা শ্রমিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় শ্রমিক সঙ্কটে থাকা এলাকাগুলোতে ধান কেটে কৃষককে সহায়তা করছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। একদিকে করোনাভাইরাসের প্রভাব, অন্যদিকে শ্রমিক সংকটসহ কৃষি মজুরি আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় পাকা ধান নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। যেখানে আগে দৈনিক মজুরি ছিল ৩০০ টাকা, এখন তা ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফলে কৃষকরা শ্রমিক জোগাড় করতে দিশাহারা হয়ে পড়ায় ধান নষ্ট হতে চলেছে। এ অবস্থায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এলাকার দরিদ্র কৃষকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। গত শনিবার গাজীপুরের শ্রীপুরে কৃষকের ধান কেটে ঘরে তুলে দিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। উপজেলার কাওরাইদ ইউনিয়নের গুনিয়া ফকির পাড়া গ্রামের কৃষক সারফুল মিয়ার এক বিঘা জমির ধান কেটে ঘরে তুলে দেন তারা।

কৃষক সারফুল লোক না পেয়ে পাকা ধান কাটতে পারছিলেন না। এদিকে কালবৈশাখীর আশঙ্কা। এই খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এবং ধান কেটে ঘরে তুলে দেয়।

এবার একটু ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক -দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান। তখন আমাদের ৫৬ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ডটির নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। বাঙালি অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী আমাদের শোষণ করতে চেয়েছে বারবার। যে রাষ্ট্র গঠনে আমাদেরও ভূমিকা ছিল, রাতারাতি তারা যেন হয়ে গেল সেই রাষ্ট্রের মালিক, আমরা নগণ্য প্রজা। তাদের সীমাহীন বৈষম্যের শিকার হয়েছি আমরা। বঞ্চিত হয়েছি মৌলিক অধিকার থেকেও। সেই শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় আর শোষণের হাত থেকে বাঙালি জাতিকে রক্ষা করতে সময়ের দাবিতেই ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ হাতে প্রতিষ্ঠা করেন ছাত্রলীগ। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ছাত্রসমাজের ডাকা হরতালের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অবদান রাখতে শুরু করে। এরপর ১৯৫১ সালের আদমশুমারি চলাকালে সারা দেশে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বাংলা ভাষার পক্ষে মতামত দিতে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে। এরপর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনী প্রচারে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসনের প্রতিবাদে ছাত্রলীগই প্রথম রাজপথে সোচ্চার হয়। ১৯৬২ সালের শিক্ষা-আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা ও ছাত্রলীগের ১১ দফা, অতঃপর ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হতে ছাত্রলীগের অবদান ছিল মাইলফলক। এ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রলীগ বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সাড়ে ১৭ হাজার ছাত্রলীগের নেতাকর্মী আত্মাহুতি দিয়েছে। এই গৌরব পৃথিবীর আর কোনো ছাত্রসংগঠনের আছে কি না আমার জানা নেই। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর পিতাহীন বাংলাদেশ বারবার গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে। সে সময়গুলোতেও ছাত্রলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে এসেছে। ১-১১-র অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে শত শত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে অকথ্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। দেশব্যাপী হেফাজতে ইসলামের নৈরাজ্য, বিএনপির আগুন-সন্ত্রাস, জামায়াতের জঙ্গি তৎপরতা ঠেকাতে সোচ্চার ছিল ছাত্রলীগই। এ ছাড়া সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে পাহারা দিয়েছে পূজামণ্ডপ, করেছে রাস্তা মেরামতের কাজও, পরিবেশ রক্ষার জন্য লাগিয়েছে হাজার হাজার গাছ। দাঁড়িয়েছে বন্যার্ত, শীতার্ত মানুষের পাশে। কখনো করেছে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি, আবার কখনো ছুটে গেছে কোন অসহায় পরিবারের পাশে দাঁড়াতে।

সত্য, সুন্দর ও মানবিক জনপদ গড়ে তুলতে সমাজের যে অংশ সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সে অংশের নাম ছাত্রসমাজ। যুগে যুগে কালে কালে সমাজের জ্ঞান পিপাসু তরুণরাই সকল অন্যায়, অবিচার, শোষণ, বঞ্চনা, লাঞ্চনার বিরুদ্ধে আর আর্তের পক্ষে সবার আগে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে। লড়াই করছে প্রাণপণ।

করোনা আক্রান্ত সন্দেহে সন্তান মাকে রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে রেখে পালিয়ে যাচ্ছে। মৃত বাবার লাশ গ্রহনে অসম্মতি জানাচ্ছে সন্তান। মৃতের দাফন বা জানাজায় অংশ নিচ্ছে না স্বজন। করোনা আক্রান্ত রোগীর পরিবারকে সামাজিক ভাবে হেনস্থা করা। ডাক্তার নার্সদের বাড়িছাড়া করা- এমন অমানবিকতার গল্প শুনছি আমরা প্রতিদিন। হ্যাঁ পাশাপাশি হাজারো মানবিকতার গল্পও আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুকুর বিড়ালকে নিয়মিত খাবার দিচ্ছে ছাত্রলীগের কিছু ছেলে। কেউবা আবার নিজে হাতে রান্না করে খাবার বিলি করছে ছিন্নমূল মানুষদের মাঝে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত সেই প্রথম থেকে ওর এলাকা ময়মনসিংহের অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছে। নিজের অসুস্থ শরীরের তোয়াক্কা না করেই। সাদ বিন কাদের শুধু খাদ্যসামগ্রীই নয় ঢাবির সমস্যাগ্রস্থ ছেলেমেয়েদের পাশে দাঁড়িয়েছে। কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে নিজের এলাকায় মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের জহিরুল তার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সংশপ্তকের মাধ্যমে। সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে এই দুর্যোগে মানুষের পাশে আছে ছাত্রলীগ। সারাদিন মানুষের সেবায় কাটিয়ে রাতে যখন ঘরে ফেরে তখন অনেক ছাত্রলীগ কর্মীই হয়তো একটু ভাত ডাল আর পেট ভরে পানি খেয়ে ঘুমিয়ে যায়। সারাদিন মানুষের বাড়িতে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া ছেলেটার বাড়িতেই হয়তো ঠিকমত চুলা জ্বলে না।

ছাত্রলীগ কান্না লুকিয়ে হাসতে জানে। বঙ্গবন্ধু, দেশ, দেশের মানুষ তার তাদের আপার প্রশ্নে আপোষহীন ছাত্রলীগের প্রতিটা কর্মী। হ্যাঁ তাদের পকেটে হয়তো তিনবেলা খাওয়ার টাকা থাকে না। কিন্তু তাদের বুকপাজরে বঙ্গবন্ধু থাকে, দেশপ্রেম থাকে। করোনা সংক্রমণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিকে একপাশে সরিয়ে রেখে তাই তারা পারে, তারা পারছে মানুষের পাশে থাকতে। এই সংকটে মানুষ কাঁদছে। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে ছাত্রলীগ।

এই আঁধার কাটবেই। আমাদের সম্মিলিত শুভ ইচ্ছা শেষ পর্যন্ত আমাদের জিতিয়ে দেবে। আমি বিশ্বাস করি দেশের আপামর দু:খী মানুষ তাদের এই চরম দুর্দিনে তাদের পরম বন্ধু ছাত্রলীগের সাহসী যোদ্ধাদের মনে রাখবে। ধন্যবাদ ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’।

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট।