আসুন মানবিকতার গল্প শুনি ...

আসুন মানবিকতার গল্প শুনি ...

বাণী ইয়াসমিন হাসি

যেকোনো দুর্যোগের সময়ই সত্যিকার মানবিকতার পরীক্ষা হয়। এবার করোনাকালের শুরুতে একশ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, গ্লাভস প্রভৃতির দাম বাড়িয়ে দিয়েছিলো। ওষুধেরও সংকট তৈরি হয়েছিল। এ সময় আমরা লক্ষ্য করলাম সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাকিয়ে না থেকে অনেক ব্যক্তি, সংগঠন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এগিয়ে এসেছে ছাত্র যুবকেরাও।

এই সংকটকালে যখন দেখি আমাদের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন, তখন আশা হারাই না।

ক্ষমতাবানরা যখন লুটপাটে ব্যস্ত তখন আলো ছড়াচ্ছেন এমন কিছু মানুষ যাদের কাছে সমাজের প্রত্যাশার লেভেল জিরো।

শেরপুরের ঝিনাইগাঁতীতে করোনা পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়া অসহায়দের খাদ্য সহায়তায় এবার নজিম উদ্দিন নামে এক ভিক্ষুক ভিক্ষা করে নিজের জমানো ১০ হাজার টাকা দান করে মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

তিনি ২১ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল মাহমুদের হাতে স্থানীয় মালিঝিকান্দা এলাকায় ওই দানের টাকা তুলে দেন।

করোনাভাইরাসজনিত পরিস্থিতিতে সরকারি সহায়তার পাশাপাশি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুবেল মাহমুদ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বন্ধুবান্ধবদের সহযোগিতায় ব্যাংকে একটি এ্যাকাউন্ট খুলে ত্রাণ তহবিল গঠন করেন। ওই ত্রাণ তহবিলে জমা হয় প্রায় ৫ লক্ষাধিক টাকা। আর ওই তহবিলের মাধ্যমে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় ১২শ’ কর্মহীন অসহায় মানুষের মাঝে খাদ্য সহায়তা তুলে দেয়া হয়। ওই অবস্থায় গত রবিবার সকালে দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজন তালিকা প্রণয়নে গান্ধীগাঁও এলাকার হতদরিদ্র লোকজনসহ ওই ভিক্ষুকের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি চাইলে তিনি ওই তালিকায় নিজের নাম না দিতে অনুরোধ করেন। সেইসঙ্গে খাদ্য সহায়তায় ওই ত্রাণ তহবিলে নিজের ঘর মেরামতের উদ্দেশে দুই বছর ধরে তিল তিল করে জমানো ১০ হাজার টাকা দান করার কথা জানান এবং মঙ্গলবার দুপুরে করোনা পরিস্থিতিতে ব্যস্ত ইউএনওকে খুঁজে মালিঝিকান্দা এলাকায় গিয়ে তার হাতে ওই টাকা তুলে দেন।  

নিজের জমানো ভিক্ষার টাকা খাদ্য সহায়তা তহবিলে দান করা প্রসঙ্গে ভিক্ষুক নজিম উদ্দিন বলেন, ‘আমি ভিক্ষা করে খাইয়ে-খরচ করে দুই বছরে ওই টেহা জমাইছি, আমার ঘরডা ভাইঙ্গা গেছেগা ওইডা ঠিক করার লাইগ্যা। এহন আর ঘর-দরজা দিলাম না, দশে (মানুষ) এহন কষ্ট করতাছে। তাই আমি এই টেহা ইউএনও সাহেবের হাতে দিলাম দশেরে দিয়ে দেক, খাইয়ে বাঁচুক। আর আল্লাহ আমগো সবাইরে বিপদ থেইকা রক্ষা করুক’।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে এক মাকে ফেলে গেছেন সন্তানেরা গণমাধ্যমে আমরা সেই খবর পড়েছি। আমরা বিস্মিত হয়েছি, কষ্ট পেয়েছি। তাকে ‘মায়ের’ স্বীকৃতি দিয়ে সব দায়িত্ব দিয়েছেন ঢাকার সাভারের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ।

গত শনিবার রাতে খবর পেয়ে উপজেলার হেমায়েতপুর জয়নাবাড়ি এলাকা থেকে ওই বৃদ্ধাকে উদ্ধার করে তিনি সব দায়িত্ব গ্রহণের ঘোষণা দেন।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ওই নারীর কাছে কেউ যাচ্ছিলেন না। বিষয়টি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে জানালে পরে তিনি উপজেলা প্রশাসনকে জানান।

এরপর ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেন নিবাহী ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ। স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেওয়ার পর এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মা হিসেবে সেখানে তার চিকিৎসা চলছে।

এই করোনা কালে শুধু মানুষই নয় পশুপাখিরাও চরম সংকটে পড়েছে। রাস্তায় তাদের খাবার মিলতো। সব বন্ধ থাকায় না খেয়ে মরতে বসেছে পশুপাখিরা। এদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে এগিয়ে এসেছেন একদল মহৎপ্রাণ মানুষ। অলিগলির কুকুর-বিড়ালদের খাওয়ান তারা।

দিন বা রাতের কোন একটি সময়ে তাদের দেখা যায় বালতি ভর্তি রান্না করা খাবার নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। বালতিতে কখনো কখনো মাংস ডিম দিয়ে রান্না করা খিচুড়ি। কোন দিন ভাত-মাংস একসাথে। যাদের জন্য এই আয়োজন, তারা জড়ো হওয়া মাত্র কাগজে বা রাস্তার স্ল্যাবে খাবার ঢেলে দেওয়া হয়।

করোনাভাইরাসের এই পরিস্থিতিতে দোকানপাট, রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় উচ্ছিষ্ট খাওয়ার সুযোগও বন্ধ হয়ে গেছে অলিগলির কুকুর, বিড়ালের। পথের এই সব পশুদের জন্য এই সময়ে নিয়মিত খাবার দিচ্ছেন রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার কিছু মানুষ। কেউ গ্রুপ ধরে, কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই খাবার বিতরণ করছেন।

জীব মাত্রই বেঁচে থাকার অধিকার রাখে। আপনি-আমি সবাই কিছু দায়িত্ব ভাগ করে নিলে সংকট মোকাবিলা করা কিছুটা সহজ হতে পারে।

করোনাভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার এই পরিস্থিতির মধ্যে পশুপ্রেমী কয়েকজনের উদ্যোগ মনে করিয়ে দেয় স্বামী বিবেকানন্দের ‘সখার প্রতি’ কবিতার বহুল পঠিত দুটি লাইন—বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?/ জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।

করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া বরিশালের বাকেরগঞ্জের উত্তমপুর গ্রামের মামুন হাওলাদারের জানাজা ও দাফনে যখন কেউ এ‌গি‌য়ে এ‌লো না তখন দা‌য়িত্ব নিল স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মীরা। ‌নারায়ণগঞ্জে থাকার সময় মামুনের করোনার উপসর্গ দেখা দিলে সেখানকার হাসপাতালে ভর্তি হয়। ১৯ এপ্রিল সকালে নমুনা সংগ্রহের পর ভয়ে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায় মামুন। ওই রাতেই নারায়ণগঞ্জের বাসায় তার মৃত্যু হয়। এরপর তার স্বজন ও এলাকাবাসী অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ বাকেরগঞ্জে পাঠিয়ে দেয়।

সোমবার রাতে বাকেরগঞ্জে মরদেহ পৌঁছানোর পর তার স্বজনরা জানাজা ও দাফনে অনীহা প্রকাশ করে। এরপর মামুনের জানাজা ও দাফনে এগিয়ে আসে ইউনিয়ন ছাত্রলীগ। ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি রিয়াজ হাওলাদারের নেতৃত্বে ৪ জন পিপিই পরে মামুনের গোসল থেকে শুরু করে জানাজা সম্পন্ন করে। এরপর মামুনের পারিবারিক গোরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন করে ছাত্রলীগের ওই ৪ সদস্য।

করোনায় মারা যাওয়া মানুষকে নিজেদের এলাকায় কবর দিতে বাঁধা দেওয়া, করোনা চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল বানাতে না দেওয়া। সন্তান নিজের মা’কে জঙ্গলে ফেলে যাওয়া। করোনা চিকিৎসায় থাকা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি ছাড়া করতে বাড়িওয়ালার তৎপরতা। এমনকি করোনা রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে তাকে এলাকাছাড়া করতে একজোট হচ্ছে বাড়িওয়ালা ও প্রতিবেশীরা। বড় বড় ব্রিজ ফ্লাইওভার ইমারত আমরা নির্মাণ করেছি ঠিকই সাথে সাথে মানবিকতার কবরটাও খুঁড়েছি। এই করোনা ভাইরাস আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো কতটা অমানবিক হয়ে এই সমাজে বাস করছি আমরা !

করোনা কি ‌অভিশাপ ?
করোনা আক্রান্ত হওয়া কি বড় ধরণের অপরাধ !
ছোটবেলায় দেখেছি গ্রামে কেউ বড় রকমের ‌অপরাধ করলে সালিশ বসিয়ে তাকে বা তার পরিবারকে একঘরে করে রাখা হতো। হালে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তার পরিবারকেও একঘরে করে রাখা হচ্ছে। সামাজিকভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে। তাদেরকে আলাদা করে রাখেন কিন্তু একঘরে করে নয়। সমস্ত নিষেধাজ্ঞা ‌অগ্রাহ্য করে জামাত করে নামাজ পড়ছেন। ‌ ‌অন্যের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলছেন। কিন্তু কেউ করোনায় মারা গেলে লাশ দাফনের জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনার ধর্ম কি বলে ?
আমরা উন্নয়নের নামে একটা অন্যায্য সমাজ নির্মাণ করেছি। যেখানে ন্যায্যতা নেই, সেখানে হৃদয় নেই ...

প্রকৃতি তার প্রাণ এবং সজীবতা ফিরে পেতে শুরু করেছে।   
মানুষ কি মানবিক হবে না? এই মহাদুর্যোগেও স্বার্থপরতায় মত্ত থাকবে! আইন শাসন বিচার শাস্তি এসবের চেয়েও বড় আদালত হচ্ছে মানুষের বিবেক। ক্ষমতাবানদের বিবেক কি ঘুমিয়েই থাকবে?

শেরপুরের ঝিনাইগাতির ভিক্ষুক, জঙ্গলে ফেলে যাওয়া মায়ের দায়িত্ব নেওয়া ম্যাজিস্ট্রেট, করোনায় মৃতব্যক্তির জানাজা দাফনের ব্যবস্থা করা ছাত্রলীগ কর্মী -এরাই নিষ্ঠুরতার বিপরীতে মানবিকতার গল্প। এভাবেই প্রাণের ভালবাসায় নিরাপদ থাকুক সকল প্রাণ।

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট।

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর