টি এস এলিয়ট ১৯২২ সালে ওয়েস্ট ল্যান্ড কবিতা শুরু করেছিলেন এভাবে ‘April is the cruellest month’ এপ্রিল এক নিষ্ঠুরতম মাস। ৯৮ বছর পর এপ্রিল আমাদের পরিচিত করছে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে সে। ২২ এপ্রিল রাতে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব, সাবেক চেয়ারম্যান, পাবলিক সার্ভিস কমিশন ড. সা’দাত হোসেইন। ২৫ এপ্রিল বিকালে চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম অর্থ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা এবং টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর-ভূঞাপুরের সাবেক সাংসদ খন্দকার আসাদুজ্জামান।
২৮ এপ্রিল ভোরে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন বাংলাদেশের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রবাদ পুরুষ খ্যাতনামা প্রকৌশলী, জাতীয় অধ্যাপক, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, তথ্য-প্রযুক্তিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জেআরসি নামে খ্যাত অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। যখন লিখছি তখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস কেড়ে নিয়েছে ২ লক্ষ ২৮ হাজার ৩৯৪ জন মানুষের জীবন।এপ্রিলের শেষ দু’দিন চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে বড় বেদনার। বলিউডের আকাশে ঘনিয়েছে কাল মেঘ ।
২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকেই শারীরিক অসুস্থতার কারণে খবরের শিরোনামে ছিলেন ঋষি কাপুর । ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সস্ত্রীক ঋষি মার্কিন মুলুকের উদ্দেশে রওনা হন। কারণ, শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণ কর্কটরোগ। চিকিৎসার জন্যে নিউইয়র্ক সিটির মেমোরিয়াল স্লোয়ান কেটারিং ক্যান্সার সেন্টারে ভর্তি করা হয় তাকে। এই হাসপাতালেই চিকিৎসা নিয়েছিলেন কর্কট রোগে আক্রান্ত নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ুন আহমেদ। হুমায়ুন আহমেদ না পারলেও কর্কটরোগকে জয় করে গত বছরই স্ত্রী নিতুকে নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন ঋষি কাপুর। নিয়মাবলীর মধ্যে থেকে সুস্থও হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু মাসখানেক ঘুরতেই না ঘুরতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন বলিউডের প্রবীণ এই অভিনেতা।
ঋষি কাপুর আর নেই- বন্ধু ও সতীর্থের মৃত্যুর খবরটি প্রথম জানান অমিতাভ বচ্চন। টুইট বার্তায় তিনি লিখেন, ‘আমি আর নিতে পারছি না’। সাত সকালে অমিতাভ বচ্চনের টুইটে যেন শোক পাথর বলিউড। গেল মঙ্গলবার ইরফান খানের মৃত্যুর শোকের আবহ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেকটি নক্ষত্রপতন হল বলিউডে। পরপারে ভাল থেকো ঋষি কাপুর। ববি এখন আমাদের চোখে ভাসে।
‘আজ আমি আপনাদের মধ্যে নেই। আবার আছি-ও’- ইরফান... অভিনেতা ইরফান খানকে গোটা বিশ্ব চেনে। ২০১৮ সালে নিউরো এন্ডোক্রিন টিউমারে আক্রান্ত হইয়ে চিকিৎসা নেন। সুস্থ হয়ে ফিরে এসে তিনি ‘আংরেজি মিডিয়াম’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। কিন্তু পুনরায় মলাশয়ের ক্যান্সারের জটিলতায় ২৯শে এপ্রিল মাত্র ৫৩ বছর বয়সে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।
বিশ্বজুড়ে অনুরাগীদের স্মৃতির খাতায় তিনি রেখে গিয়েছেন অনেক সুপারহিট ছবি। ব্রিটিশ ভারতীয়, হলিউড এবং একটি তেলুগু চলচ্চিত্রে তিনি কাজ করছেন। ৩৫ বছরের কর্মজীবনে তিনি ৫০টির অধিক দেশীয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও চারটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার-সহ অসংখ্য পুরস্কার অর্জন করেছেন। চলচ্চিত্র সমালোচক, সমসাময়িক অভিনয়শিল্পী ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা তাকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী বলে গণ্য করে থাকেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রে অতুলনীয় ও অকল্পনীয় সহজাত অভিনয় ক্ষমতার জন্য ২০১১ সালে ভারত সরকার তাকে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মশ্রীতে ভূষিত করে।
তরুণ বয়সে বেশ প্রতিশ্রুতিমান ক্রিকেটার ছিলেন তিনি। এমনকি, নিজের রাজ্যের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলার সুযোগ পান ইরফান খান। অনূর্ধ্ব-২৩ সি কে নাইডু প্রতিযোগিতায় খেলার জন্য নির্বাচিতও হয়েছিলেন অলরাউন্ডার ইরফান। কিন্তু অর্থের অভাবে খেলাটাকে নিজের পেশায় পরিণত করতে পারেননি। মাত্র ২৫০ টাকার জন্য ক্রিকেটে তার কেরিয়ার শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। সেই ইরফান এভাবে চলে যাবেন কেউ ভাবেনি, দূরারোগ্য কর্কট রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিততে পারেননি ইরফান। অভিনেতা ছাড়া নিজের অন্য পরিচয় নিয়ে কোনও দিন মাথাব্যথা ছিল না ইরফানের। ‘খান’ বাদ দিয়ে পরিচয় দিতেন শুধু ‘ইরফান’ বলে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন ঘুরছে অনুরাগীদের জন্য ইরফানের শেষ বার্তা। ‘আংরেজি মিডিয়াম- এর প্রচারে তিনি থাকতে পারেননি। পরিবর্তে ছিল তার কণ্ঠ। তিনি বক্তব্য শুরু করেছেন এই বলে, ‘আজ আমি আপনাদের মধ্যে নেই। আবার আছি-ও।
বলিউডে তার অভিষেক ঘটে শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে একাডেমি পুরস্কার মনোনীত সালাম বম্বে (১৯৮৮) চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। নাট্যধর্মী হাসিল (২০০৩) ও মকবুল (২০০৪) চলচ্চিত্রে খল চরিত্রে অভিনয় করে সমাদৃত হন। হাসিল চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ খল অভিনয়শিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেন। নাট্যধর্মী লাইফ ইন আ মেট্রো (২০০৭), চলচ্চিত্রটির সফলতা তার কর্মজীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এটি তাকে এনে দেয় পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কার।
ক্রীড়া নাট্যধর্মী পান সিং তোমার (২০১১) চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও ফিল্মফেয়ার সমালোচক পুরস্কার অর্জন করেন। শ্রেষ্ঠ বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে বাফটা পুরস্কার মনোনীত দ্য লাঞ্চবক্স (২০১৩) চলচ্চিত্রে তার অভিনয় বৈশ্বিক সমালোচক ও দর্শকদের প্রশংসা অর্জন করে। এরপর তিনি অভিনয় করেন হায়দার (২০১৪), পিকু (২০১৫), তালবার (২০১৫ ও ব্ল্যাকমেইল (২০১৮) চলচ্চিত্রে। এগুলো বাণিজ্যিক সফল ও সমাদৃত চলচ্চিত্র। তার অভিনীত সর্বোচ্চ আয়কারী হিন্দি চলচ্চিত্র হল হাস্যরসাত্মক নাট্যধর্মী হিন্দি মিডিয়াম (২০১৭), এটি ভারত ও চীনে সুপারহিট তকমা লাভ করে। এর জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কার অর্জন করেন।
বলিউডের বাইরে তিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন, সেগুলো হল- ওয়ারিয়র (২০০১), দ্য নেমসেক (২০০৬), দ্য দার্জিলিং লিমিটেড, একাডেমি পুরস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র স্লামডগ মিলিয়নিয়ার (২০০৮), নিউ ইয়র্ক, আই লাভ ইউ (২০০৯), দি অ্যামেজিং স্পাইডার-ম্যান (২০১২), লাইফ অব পাই (২০১২), জুরাসিক ওয়ার্ল্ড (২০১৫) ও ইনফার্নো (২০১৬)। হ্যাঁ ইরফান, আমাদের মাঝেই থাকবেন আপনি!
নিউজ টোয়েন্টিফোর/কামরুল