মাস্ক কাণ্ড; মুখ খুললেই দণ্ড!

মাস্ক কাণ্ড; মুখ খুললেই দণ্ড!

বাণী ইয়াসমিন হাসি

আসুন শুরুতে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কয়েকটি খবরের শিরোনামে চোখ বুলিয়ে নিই।

মাস্ক নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তিনটি হাসপাতালের পরিচালককে বদলির নামে শাস্তি !

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মাস্ক সংকট হেতু নিজ উদ্যোগে স্বাস্থ্যকর্মীদের মাস্ক কিনতে বলায় প্রেষণ বাতিল করে আগের  কর্মস্থলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক নিম্নমানের মাস্ক গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোয় তাকে পাবনার হেমায়েতপুরের মানসিক হাসপাতালে তাৎক্ষণিক বদলি।

নিম্নমানের মাস্ক সরবরাহ করায় এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলায় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালককে ওএসডি।

নিম্ন মানের পিপিই নিয়ে কথা বলায় নোয়াখালীতে চিকিৎসককে তত্ত্বাবধায়কের শোকজ।

গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে কেন্দ্রীয় ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষের আইসিটি অ্যাক্ট- এ মামলার হুমকি।  

চট্রগ্রামে চিকিৎসকরা নিজ উদ্যোগে গত তিন দিনে প্রায় ১৫০০ এন-৯৫ মাস্ক সংগ্রহ করেছেন।

এবার আসি মূল প্রসঙ্গে -জেএমআই নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মুগদা জেনারেল হাসপাতালে সরবরাহ করা মাস্কের প্যাকেটে সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক থাকায় হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী ওই মাস্কের মান সম্পর্কে জানতে চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে পরিচালককে চিঠি দেন।

বিষয়টি খতিয়ে দেখার পর কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহিদ উল্লাহ ২ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের ব্রিফিংয়ে স্বীকার করেন, ওই মাস্ক সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক ছিল। প্যাকেটের গায়ে এন-৯৫ লেখা হয়েছিল ‘ভুল করে’।

হাসপাতালে কীভাবে ‘ভুল মাস্ক’ গেল সে বিষয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন সিএমএসডি পরিচালক। সেখানে বলা হয়েছে, “সিএমএসডি কোনও দেশীয় চিকিৎসা সামগ্রী প্রস্তুতকারী কোম্পানি/প্রতিষ্ঠানের নিকট এন-৯৫ মাস্ক সরবরাহের কার্যাদেশ প্রদান করেনি।   বাংলাদেশি চিকিৎসাসামগ্রী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান জেমএআই কোভিড-১৯ সংক্রমণের পূর্বে থেকে হ্যান্ড গ্লাভস, স্যানিটাইজার, সাধারণ মাস্ক ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্স/ কোয়ালিটি সার্টিফিকেট/ ছাড়পত্র অনুযায়ী সিএমএসডিকে সরবরাহ করে আসছে।

বিভিন্ন হাসপাতালে নকল মাস্ক সরবরাহের বিষয়টি নিয়ে যখন গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ প্রতিবাদ মুখর তখন সেই আলোচনার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০ এপ্রিল সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে এ বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগারকে নির্দেশনা দেন।   ওইদিন সকালে মাস্ক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে নজরদারি কঠোর করার নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কেউ যদি এ রকম কিছু করে থাকে … বা এর সাপ্লায়ার কে… আমি শুধু বললাম, মহানগর হাসপাতালে এটা গেছে। বাবুবাজারের যে হাসপাতালটা .. এটা তো করোনাভাইরাসের জন্য ডেডিকেটেড। তো এরকম কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় যদি হয়, এটা তো ঠিক না।  

“আপনারা যাদেরকে এনগেজড করেন, যাদেরকে ব্যবসাটা দেন বা যাদেরকে নেয় বা সাপ্লাই দেয়, তারা সঠিকটা দিল কি না। বক্স তো ঠিক আছে, কিন্তু বক্সের ভিতরের জিনিসগুলো ঠিক আছে কি না আমার মনে হয়, নজরদারি বাড়ানো দরকার…বা যিনি রিসিভ করবেন, তিনি যেন দেখেশুনে এটা রিসিভ করেন। খালি আমি এটুকু বলতে চাই। ” 

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পরে রাতেই তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানানো হয়।

ওইদিন রাতেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের উপসচিব মো. আবু রায়হান মিঞা স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায় আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

ইতিমধ্যেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নকল এন৯৫ মাস্ক ও নিম্নমানের সুরক্ষা সরঞ্জামাদি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে ফৌজদারি ও দুর্নীতি দমন আইনে মামলা করতে সরকারকে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে।   সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইয়াদিয়া জামান ই-মেইলের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডিজি এবং ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ডিজিকে এ নোটিশ পাঠিয়েছেন।

নোটিশে বলা হয়েছে, জেএমআই রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি নকল এন-৯৫ মাস্ক ও নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করেছে। দেশের সব গণমাধ্যমে খবরটি প্রচারিত হয়েছে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানও স্বীকার করেছে মাস্কগুলো নকল। তারা ওই মাস্ক ফেরত নিতে চেয়েছে। তাদের এমন কর্মকাণ্ড দেশের চিকিৎসকদের বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলেছে, যা দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের তফসিলভুক্ত অপরাধ।

নোটিশ পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও জড়িতদের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত ফৌজদারি আইন ও দুদক আইনে মামলা দায়ের করতে বলা হয়েছে। অন্যথায় আদালতে যাওয়া হবে বলে জানানো হয় নোটিশে।

গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে এ পর্যন্ত ৮৮১ স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে চিকিৎসক ৩৯২ জন, নার্স ১৯১ জন এবং টেকনোলজিস্টসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ২৯৮ জন। এর মধ্যে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসকদের প্রধান সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন-বিএমএ এ তথ্য জানিয়েছে।

যারা পজেটিভ রোগীর সেবা দেবেন তাদের এন ৯৫ মাস্ক ব্যবহার করা অপরিহার্য। স্বীকার করছি গোটা পৃথিবীজুড়েই এন-৯৫ মাস্কের সংকট। এটা আমেরিকা বানায়। ইউরোপ বানায় এফএফপি২, এফএফপি৩।   চীন বানায় কেএন ৯৫। সব একই মানের। এক এক দেশ এক এক নামে বানায়। এ ধরণের মাস্ক সব দিক থেকে মুখমন্ডল কে সিল করে রাখে যাতে করে যিনি এই মাস্ক ব্যবহার করবেন তিনি এর পাশ দিয়ে নয়, মাস্ক এর ভেতর দিয়ে রেস্পিরেশন নেবেন। এটা ড্রপলেট বাহিত ইনফেকশন।   ভাইরাস ঢুকবে নাক-মুখ-চোখ দিয়ে। সুরক্ষা সামগ্রীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপরিহার্য এন-৯৫ গোছের মাস্ক। এটা ছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হবেই।

কয়েকটি প্রশ্ন; উত্তর মিলবে কি?
১.জেএমআইকে দেওয়া কেন্দ্রীয় ওষুধ প্রশাসনের কার্যাদেশে ঠিক কি লেখা ছিল?
২. দেশের কোনও প্রতিষ্ঠানেই এন-৯৫ মাস্ক তৈরি হয় না।   তাহলে জেএমআই কিভাবে সাধারণ মাস্ক এন-৯৫ এর প্যাকেটে/কার্টনে দিল?
৩.কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে প্যাকেটগুলো সরবরাহ করা হল?
৪. স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে হাত দিলে সেই কর্মকর্তাদের বদলি হতে হয় কেন? 
৫.গত বছরগুলোতে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ হওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা কোথায় গেল? 
৬.এদেশের এত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এত এত হাসপাতাল এগুলোর বেহাল দশা কেন? 
জানি এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। উত্তর চাইতে যাওয়াও মানা।

দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি। সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি? জীবনের সকল দ্বার রুদ্ধ করে দিলে হয়ত ভ্রান্তিকে ঠেকানো যায়, কিন্তু সত্যকে পাওয়া যায় না।   আকরিক ধাতু যেমন মাটির সাথে মিশে থাকে, মাটি পরিষ্কার করে তাকে পেতে হয়, জীবনের পথেও তেমনি সত্য ও মিথ্যা মিলে আছে। জীবন-অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এজন্য কাঙ্ক্ষিত হিরন্ময় সত্য উদ্ঘাটনে বাস্তবের কঠিন ও দুর্গম পথে প্রয়োজন নিঃশঙ্ক দীপ্ত পদচারণা।

কোন সে চক্র যারা রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলার পরও নামকাওয়াস্তে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা ছাড়া কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হল না !

রাষ্ট্রের মধ্যে যখন আরেকটা রাষ্ট্র শক্তিশালী হয়ে ওঠে তখন তার পরিণাম হয় ভয়াবহ।
করোনাযুদ্ধের প্রথমসারির যোদ্ধা ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের  মনোবল শুরুতেই ভেঙে দেওয়া হল হাসপাতালগুলোতে নকল মাস্ক আর নিম্নমানের পিপিই সরবরাহ করে। পৃথিবীর যেকোনও দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্তের আনুপাতিক হার বেশি। এটা কি শুধুই লোভ, বাণিজ্য, গাফিলতি নাকি অন্য কোনও ষড়যন্ত্র?

পরাজয় নিশ্চিত জেনে ‘৭১ এর ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পিতভাবে পাক হানাদার বাহিনী তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আল বদরের সহযোগিতায় এদেশের সূর্যসন্তানদেরকে হত্যা করেছিল। যাতে করে দেশ স্বাধীন হলেও সহসা মাথা উঁচু করে না দাঁড়াতে পারে।

এই মাস্ক কাণ্ড তেমনই কোনও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ নয় তো?

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর