তারা বহাল তবিয়তে, সাংবাদিক কাজলের হাতে কেন হাতকড়া !

তারা বহাল তবিয়তে, সাংবাদিক কাজলের হাতে কেন হাতকড়া !

বাণী ইয়াসমিন হাসি

গতকাল ছিল বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। প্রতিবছর এই দিনে বিশ্বজুড়ে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস পালিত হয়। এবারের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের স্লোগান, ‘ভয় বা পক্ষপাতিত্ব বিহীন সাংবাদিকতা। ’

১৯৯১ সালে ইউনেস্কোর ২৬তম সাধারণ অধিবেশনের সুপারিশ মোতাবেক ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় ৩ মে তারিখটিকে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এরপর থেকে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমকর্মীরা এ দিবসটি পালন করে আসছেন।

সাংবাদিকদের জীবনে বছরে একটি দিন আসে, যখন সংবাদমাধ্যমের মুক্তি বা স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্চারিত হয়; দেশে দেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার কী অবস্থা, সেদিকে ফিরে তাকানো হয়। এ বছর বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে এসেছে এই দিবস। ফলে সংকটময় পরিস্থিতিতে সাংবাদিকতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার গুরুত্ব বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছে।

দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর উদ্ধার হওয়া সাংবাদিক কাজলকে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলায় জামিন দিলেও ৫৪ ধারার নতুন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

গতকাল বেলা ৩টার দিকে সাংবাদিক কাজলকে পিঠমোড়া করে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে যশোর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মঞ্জুরুল ইসলামের আদালতে আনা হয়। এরপর বিকেল চারটার পর শুনানি শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে ঢাকার শেরেবাংলা নগর, কামরাঙ্গীরচর ও হাজারীবাগ থানায় আইসিটি এ্যাক্টে মামলা থাকায় কোতোয়ালি থানা পুলিশ আটকাদেশ পেতে নতুন করে ৫৪ ধারায় মামলা দিয়ে গ্রেপ্তারের আবেদন জানান। পরে বিচারক এ মামলায় তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

গত ১০ মার্চ ঢাকার হাতিরপুলের নিজ অফিসের নিচে থেকে নিখোঁজ হন দৈনিক পক্ষকাল পত্রিকার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজল। ১১ মার্চ কাজলের স্ত্রী জুলিয়া ফেরদৌসি নয়ন ঢাকার চকবাজার থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। প্রায় দুই মাস পর শনিবার গভীর রাতে বেনাপোলের রঘুনাথপুর বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা ভারত থেকে ‘কথিত অবৈধভাবে প্রবেশের সময়’ তাকে আটক করে। এরপর গতকাল সকালে বিজিবি তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশ আইনে মামলা দিয়ে বেনাপোল পোর্ট থানায় সোপর্দ করে।

এর আগে গত শুক্রবার নরসিংদীতে পুলিশের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলায় স্থানীয় তিন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুক্রবার সকালে নরসিংদী শহর, মাধবদী ও মনোহরদীতে পুলিশের তিনটি পৃথক অভিযানে নিজ নিজ বাড়ি থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গত বৃহস্পতিবার (৩০ এপ্রিল) রাতে পলাশের ঘোড়াশাল ফাঁড়ির ইনচার্জ জহিরুল আলম বাদী হয়ে পলাশ থানায় ওই তিন সাংবাদিককে আসামি করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে ওই পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা না বলেই তার বরাত দিয়ে বক্তব্য প্রকাশ করা ও তা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করার অভিযোগে মামলাটি করা হয়।

গ্রেপ্তার তিন সাংবাদিক হলেন- স্থানীয় দৈনিক গ্রামীণ দর্পণের বার্তা সম্পাদক রমজান আলী প্রামাণিক একই পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার শান্ত বণিক ও অনলাইন পোর্টাল নরসিংদী প্রতিদিনের প্রকাশক ও সম্পাদক খন্দকার শাহিন।

দুর্ভিক্ষ, মহামারি ও অন্যান্য জাতীয় দুর্যোগের সময় অবাধ তথ্যপ্রবাহের গুরুত্ব আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু আমাদের দেশে ভিন্ন প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। দেশে তথ্য অধিকার আইন নামে একটি আইন বলবৎ আছে, যার অনেকগুলো ধারা এই মুহূর্তে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের দ্বারা লঙ্ঘিত হচ্ছে। করোনা-সংক্রান্ত সব তথ্য সঠিকভাবে জনসমক্ষে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে প্রকাশ করার বিধান অনুসরণ এবং সংবাদ ও মতপ্রকাশের মুক্ত পরিবেশের পথ সুগম করা এই মুহূর্তে একান্ত জরুরি। এই সংকট মোকাবিলায় সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মহলের তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করার জরুরি বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিচার করার কোনো বিকল্প নেই।

ফ্রান্সভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের ২০২০ সালের সমীক্ষা সূচকে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১। আগের বছরের তুলনায় আমরা আরো এক ধাপ পিছিয়েছি। দুঃখজনক বিষয় হলো, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আমরাই সবচেয়ে পিছিয়ে আছি। এমনকি পাকিস্তান আফগানিস্তানের মতো অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সন্ত্রাসবাদ, জাতিগোষ্ঠীগত বৈরিতা ও যুদ্ধবিগ্রহের দেশও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে আমাদের চেয়ে এগিয়ে !

আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে ...
আমরা যে গাছটিকে কৃষ্ণচূড়া গাছ ভেবেছিলাম
যার উদ্দেশ্যে ধ্রূপদী বিন্যাসে কয়েক অনুচ্ছেদ প্রশস্তি লিখেছিলাম
গতকাল বলাই বাবু বললেন, 'ঐটি বাঁদরলাঠি গাছ'।
অ্যালসেশিয়ান ভেবে যে সারমেয় শাবকটিকে
আমরা তিন মাস বক্‌লস পরিয়ে মাংস খাওয়ালাম
ক্রমশ তার খেঁকিভাব প্রকট হয়ে উঠছে।
আমরা টের পাইনি
আমাদের ঝরণা কলম কবে ডটপেন হয়ে গেছে
আমাদের বড়বাবু কবে হেড অ্যসিস্ট্যান্ট হয়ে গেছেন
আমাদের বাবা কবে বাপি হয়ে গেছেন।
আমরা বুঝতে পারিনি
আমাদের কবে সর্বনাশ হয়ে গেছে।
অনেক বছর আগে লেখা তারাপদ রায়ের কবিতাটা আজও কতটা প্রাসঙ্গিক।
আমাদের আসলেই সর্বনাশ হয়ে গেছে। থামানোর কি কেউ নেই ?

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। থমাস জেফারসন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মূল রচনাটিও তিনি করেছিলেন। জেফারসন ছিলেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে একজন প্রবাদপুরুষ।

তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি এই বিকল্পটি দেওয়া হয় যে তুমি কি সংবাদপত্রবিহীন সরকার চাও, না সরকারবিহীন সংবাদপত্র চাও? তখন আমি পরেরটা বেছে নেব। জেফারসন বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও সংবাদপত্রের কথা বলেছিলেন। ঠিক তার প্রায় ৫০ বছর পর ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সংবাদপত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, চারটি আক্রমণাত্মক সংবাদপত্র হাজারটা বেয়নেটের চেয়েও ক্ষতিকর। ’ অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, কোনো দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হানা দিতে পারে না। যুগ যুগ ধরে মানুষ সংবাদ, সংবাদপত্র, স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে।

মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য অন্যতম বড় বাঁধা দলবাজ সাংবাদিক এবং সাংবাদিক নেতা। আমি মনে করি সাংবাদিকের মতাদর্শ থাকতে পারে কিন্তু দল থাকতে পারে না। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে একটাই প্রত্যাশা সাংবাদিকতা হোক পুরোপুরি দলীয়কর্মী মুক্ত।

আপনি যদি মনে করেন এই হাতকড়া শুধুই একজন কাজলের হাতে সেটা ভুল। এই হাতকড়া পুরো সাংবাদিক কমিউনিটির হাতে। আপনি যদি ভেবে থাকেন এই হাতকড়া শুধুই সাংবাদিক বা সাংবাদিকতার সংকট, মনে রাখবেন এই হাতকড়া আপনারও হাতে। এই হাতকড়ায় বন্দী আজ গোটা রাষ্ট্র !

বৈশ্বিক মহামারী করোনার কারণে ৫ সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে দেশে সাধারণ ছুটি চলছে। উদ্বেগ উৎকন্ঠা নিয়েই মানুষ পরিবারের সাথে সময় কাটাচ্ছে। সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের পরিবারে উদ্বেগ উৎকন্ঠার সাথে যোগ হয়েছিলো সীমাহীন ভীতি আর অনিশ্চয়তা। বার বার আইনের আশ্রয় নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেও তারা ব্যর্থ হয়েছিল নিঁখোজ স্বজনের সন্ধান পেতে।

শুরু হয়েছে রহমতের মাস রমজান। এই করোনাকালে যেখানে সবাই পরিবার পরিজনের সাথে ইফতার করছে সেহরী খাচ্ছে সেখানে সাংবাদিক কাজলের ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে আর স্কুলগামী মেয়ের প্রতিটা ইফতার আর সেহরী কেটেছে চোখের জলে।
আচ্ছা সাংবাদিক কাজল কি দাগী আসামি? ভয়ংকর কোনো খুনী ,ব্যাংক ডাকাত বা অর্থপাচারকারী ? এদেশে নকল মাস্ক পিপিই সরবরাহ করে শত শত ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মীর জীবনকে ঝুকিঁর মুখে ফেলা দেওয়া দুস্কৃতীকারীরা আজও মুক্ত আলো হাওয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। শেয়ারবাজার লুটকারীরা সম্মানিত, দেশের সম্পদ পাচারকারীরা সংসদে এবং বড় বড় চেয়ারে। মোদ্দাকথা হলো সব অপরাধীই তো বহাল তবিয়তে আছে তাহলে সাংবাদিক কাজলের হাতে কেন হাতকড়া !

করোনা সংকট বিবেচনা করে দেশের সব জেলখানা থেকে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের খালাস করে দেওয়া হচ্ছে। অথচ সাংবাদিক কাজলকে কোনো অপরাধ প্রমাণের আগেই জেলে ভরে দেওয়া হলো ! হায় নিজদেশেই আজ সে অনুপ্রবেশকারী !

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর