অবিশ্বাস্য এক ঘটনার সাক্ষী হলাম আজ

অবিশ্বাস্য এক ঘটনার সাক্ষী হলাম আজ

লাকমিনা জেসমিন সোমা

হঠাৎ একটা ফোন এলো। অপরিচিত নাম্বার। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ। খুব কাকুতি-মিনতি।

‘আমাকে বাঁচান’। জানতে চাইলাম ‘কে আপনি’। সে বিস্তারিত কিছুই বললো না। তাঁর একটাই অনুরোধ- আমার সাথে একবার দেখা করতে চায়।
আমি শেষ পযর্ন্ত রাজি হলাম। কিন্তু সন্দেহ হলো বিধায় আমার অফিসে আসতে বললাম। এটি ২০১৩ সালের ঘটনা। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রতিদিন এ কাজ করি। পরদিন দুপুরে ওই আগন্তুক হাজির। তাকে দেখে অনেকটা কেঁপে উঠলাম। নেশাখোর মহিলা, প্রথম দর্শনেই বোঝা যাচ্ছে। গায়ে ছেঁড়া-নোংরা জামা-কাপড়। হাতে একটা ব্যাগ। ব্যাগটির অবস্থা আরো করুন। আমি চেয়ার এগিয়ে দিলাম। সে বসেই ব্যাগ থেকে কিছু কাগজপত্র বের করতে লাগলো। কী এগুলো? আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল- ‘আমার বিএ পাশের সার্টিফিকেট। ’ আমি একটু অবাক হলাম। হাতে নিয়ে দেখলাম, তাই তো! এরপর সে তাঁর হারানো দিনের কিছু ছবি, পেপার কাটিং দেখালো। বর্তমান চেহারার সাথে কোনো মিল নেই। কী দারুণ স্মার্ট ছিল ভদ্র মহিলা। কিন্তু তাঁর অবস্থা এমন কেন হলো?

এই একটি কৌতুহল থেকে আমি মাঠে নামলাম। সে রাজশাহী রেল স্টেশনে ঘুমায়। ঘুমের ওষুধ এবং আঠা দিয়ে নিয়মিত নেশা করে। তার অভিযোগ, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হওয়া সত্ত্বেও তাকে মিথ্যাভাবে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। মামলা লড়তে লড়তে সব টাকা পয়সা খুইয়েছে। বাড়িতে মাথা খোঁজার মতো সামান্য ভিটে মাটিটুকুও যায় যায়। নেশা করার কারণে বাড়ি থেকে অনেক আগেই বিতাড়িত। এলাকার লোক পাগল বলেই জানে। নির্বাচনে হেরে পাগল হয়ে গেছে-এমনটাই বলে। কিন্তু, কতগুলো কারণে তাঁর অভিযোগ আমার কাছে সত্য মনে হলো। আমি তাঁর সাথে তার জেলায় গেলাম। (রাজশাহীতে না, পাশের একটা জেলা)। পুরাতন ফাইল ঘেটে নির্বাচন অফিস থেকে সেই নির্বাচনের বিস্তারিত ফলাফল তুললাম। বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে আসা ফলাফল, মূল ফলাফল। অসংখ্য জায়গায় দেখলাম ফ্লুইট দিয়ে ঢেকে তার উপরে নতুন সংখ্যা বসানো হয়েছে। যা বোঝার বুঝে গেলাম। কিন্তু কী করা! সে তো আইনি লড়াইয়ে অলরেডি হেরে গেছে। তার এলাকাবাসী, কলেজের শিক্ষক ও পরিবারে সাথে কথা বললাম। দুদিন পর ফিরলাম রাজশাহীতে। পত্রিকায় নিউজ পাঠালাম। একটি সাধারণ মানবিক স্টোরি। তার ছবিসহ ব্যাক পেইজে ছাপা হলো। সিঙ্গেল কলামে শিরোনাম- ‘রাজনীতির খড়গ’। রাজশাহী রেলওয়ে থানার ওসি ফোন করে বলল আপা আপনার নিউজটা দেখে ভদ্র মহিলাকে ডেকেছিলাম। একটি মানবাধিকার সংস্থা ওনার দায়িত্ব নিতে চায়। মাদক পুনর্বাসন সেন্টারে রেখে চিকিৎসা দিতে চায়। আমি বললাম- বেশ ভালো তো। তখন ওসি সাহেব বলল, কিন্তু ওই ভদ্র মহিলা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। এরপর আমিও তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু শেষ পযর্ন্ত বুঝলো না। কী আর করা! সাংবাদিক হিসেবে এক ঘটনা নিয়ে কতদিন থাকা যায়! মাথা থেকে বাদ দিলাম।


এক বছর পর একদিন আবার ফোন। ওপার থেকে সেই মরা কন্ঠ! ‘আপা আমি বোধয় আর বাঁচব না। নেশা করে করে আমার কিডনি লিভার সব শেষ হয়ে গেছে মনে হয় ‘। আমি বললাম, কী আর করবেন। নিজেই তো নিজেকে শেষ করে ফেললেন। থাকেন কোথায়? বলল স্টেশনে স্টেশনে থাকি। এক স্টেশনে বেশি দিন থাকা যায় না। পুলিশ তাড়িয়ে দেয়। রাতে নেশাখোররা এসে পা ধরে টানে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি ফোনটা কেটে দিই। কারণ, বহুবার বহুভাবে তাকে আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছি।

অতঃপর আরো কয়েকবছর পর আবার একদিন ফোন। ‘আপা পারলে একবার আমারে দেখে যাইয়েন। ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায় পড়ে আছি। কখন কী হয় বলা যায় না!’ আমি বললাম, নেশা তো ছাড়েননি? বললো- ‘না’। বললাম, ঠিক আছে পারলে একবার আসব। তারপর আর যাওয়া হয়নি। যেয়ে কী করব! এরপর কয়েকবার ফোন দিয়ে বন্ধ পেয়ে ভেবেছি হয়ত আর নেই।

সেদিন হঠাৎ ওনার কথা মনে হলো। ভাবলাম, বোধয় মারা-ই গেছে। এতোদিন টেকার কথা না। এই ভাবনা ভাবার এক সপ্তাহ হতে না হতেই আজ হঠাৎ মোবাইলে একটা মেসেজ পেলাম। ‘আপা কেমন আছেন’। সেই পুরানো নাম্বার! আমি কেন যেন সাথে সাথে রিপ্লাই দিলাম। লিখলাম ‘আপনি বেঁচে আছেন?’। সে লিখল ‘হ্যা আপা, আমি বেঁচে আছি। ভালো আছি। আপনি জেনে খুশি হবেন যে আমি এবার বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছি। মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান । ‘ আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। মনো হলো তাঁর ফোন থেকে অন্য কেউ রিপ্লাই দিচ্ছে। আমি বললাম একটা ছবি পাঠান তো। সে বেশকিছু ছবি ও ভিডিও পাঠালো। দেখলাম, এই করোনার মধ্যে মানুষের বাড়ি বাড়ি ত্রাণ দিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি আরো নিশ্চিত হতে তাঁর সংশ্লিষ্ট উপজেলার ওয়েবসাইটে গেলাম। সত্যিই তো! সে সত্যিই তাঁর কাঙ্ক্ষিত জীবনে ফিরে এসেছে। কিন্তু কীভাবে, আমি ফোনে জানতে চাইলাম। ওঁ বললো- ‘আপা জীবনের ওই কষ্টময় অধ্যায়টা আর মনে করতে চাই না। এখন শুধু মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। অলরেডি মানুষের মুখে মুখে শুনছি এবার আমি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান হব। ’কথায় কথায় আমি বললাম, ঢাকা এলে অবশ্যই দেখা করে যাবেন।

আমি এখনো ঘোরের মধ্যে আছি। মানুষ সত্যিই তার স্বপ্নের সমান বড়। অথবা তার চেয়েও বেশি কিছু। মানুষ চাইলে কী না পারে!

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর