হাঁটা থামিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে বর্ণমালা

হাঁটা থামিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে বর্ণমালা

শওগাত আলী সাগর

১. ‘দেখো, দেখো মনে হচ্ছে না-সামনে একটা উঁচু পাহাড় আছে ওখানে!’-হাঁটা থামিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে বর্ণমালা।  

দিনের বেলা ঠিক এই জায়গাটা থেকে সামনে তাকালে মনে হয় দিগন্ত বিস্তৃত এক জলরাশির দিকে আমরা ধেয়ে যাচ্ছি। ক্রমশঃ নিচের দিকে বয়ে চলা রাস্তাটা সোজা নিয়ে জলের বুকে মিশিয়ে দেবে। অথচ এখন এই নিস্তব্ধ রাতে জলের বুকে উপচে পড়া চাঁদের আলোয় পুরো পরিবেশটাই যেনো পাল্টে গেছে।

লেক অন্টারিওর অস্তিত্বটাই যেনো টের পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সামনে এক পাহাড়, যেখানে দূর থেকে ছিটকে পড়া আলো আর আঁধারের খেলা চলছে। কেমন যেনো একটা শব্দও টের পাওয়া যায়!

চাঁদের আলো কি তা হলে রাতের নির্জনতায় কোনো বিভ্রম তৈরি করে!
২.আমরা বেরিয়েছি জোছনা বিহারে। আমাদের লক্ষ্য-ভরা পূর্ণিমায় লেক অন্টারিওর বুকে চাঁদের আলোর লুকোচুরি খেলা আর ব্লাফার্স পার্কের রাতের নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হওয়া।

আগের দিনই সিটির বাই ল অফিসারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম-ব্লাফার্স পার্কে, বিচের ধারে হাঁটা যাবে কী না। অফিসার জানিয়েছিলেন-পায়ে হাঁটতে পারবে, গাড়ি আনলেই জরিমানা। সন্ধ্যা পেরিয়ে ক্লিফক্রেস্টে রাত ঝাঁপিয়ে পড়লে আমরা চারজন ব্রিমলি রোড ধরে দক্ষিণে হাঁটতে শুরু করি। আমরা মানে আমি, সেরীন, বর্ণমালা আর কথামালা।  

৩. নিরবতারও কি নিজস্ব কোনো ভাষা আছে! রাতের চাদরে ঢেকে যাবার পর প্রকৃতি কি নিজেদের মধ্যে আলাপনে মেতে ওঠে! পাহাড়ি ঢালু রাস্তার মতো ব্লাফার্সপার্কের রাস্তা ধরে নামতে নামতে নানা রকমের  ধ্বনি ভেসে আসে। ‘ক্রাইম সিনে’র মতো করে পার্কিং এবং প্রবেশের পথগুলোয় হলুদ ফিতা বেঁধে রাখা হয়েছে। বিশাল এলাকাজুড়ে পার্কিং লটগুলো আর এখানে সেখানে বেঞ্চগুলো যেনো বিরহকাতর কোনো  প্রতিমূর্তি। লেকের বুক চিড়ে ভেসে আসা ফুঁপানি আর তীরে এসে আছড়ে পড়ার শব্দকে অনুসরণ করে এগুতে থাকি আমরা। জনমানবহীন ব্লাফার্সপার্কের ল্যাস্প পোস্টগুলোয় ম্রিয়মান আলো নয় ব্লাফার্সপার্ককে ভালোবেসে উজার করে দেয়া জোছনার আলোয় আমরা পথ চলিতে থাকি।

৪. কোথাও কি ঝড় উঠলো! খানিকটা আঁতকে উঠেও টের পাই-কিছু একটা সাঁই করে মাথার উপর একটা চক্কর দিয়ে লেক অন্টারিওর গভীরে চলে গেছে। পর পর কয়েকটা চক্কর দিলো যেনো। লেকের  মধ্যে বিকট চিৎকারে ডাকতে শুরু করলো দুটো কানাডীয়ান গিজ-রাজ হাঁস। অনেকটা পানির উপর দিয়ে তুমুল চিৎকার করে দৌড়ে এসে একজোড়া রাজহাঁস নিজেদের মধ্যে জগড়ায় মত্ত হয়ে উঠলো। মাথার উপর আরেক দফা কিছু একটা সাইঁ করে উড়ে গেলো যেনো। প্রকৃতির নিজস্ব সময় এটা, আমরা সেখানে অনাহুত আগন্তুক-এমন কোনো বার্তা দিলো কি তারা! দিক না, তাতে কি!

জনমানবহীন রাতের নির্জনতায়  ব্লাফার্সপার্কের ভেতর দিয়ে লেক অন্টারিওর তীর ঘেষে আমরা হাঁটতে থাকি। মাথার উপর উজার করা জোছনা, লেক অন্টারিওর বুকের ভেতর থেকে আসা উথাপাতাল ধ্বনি আর তীরে এসে আছড়ে পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে আমরা এগিয়ে যাই। বিস্তীর্ণ  ব্লাফার্সপার্কে  তখন যেনো সঙ্গীতের আসর বসেছে। প্রাকৃতিক এক সুরের মূর্চ্ছণায় আমরা বিভোর হয়ে থাকি।

নিউজ টোয়েন্টিফোর/কামরুল