আবেগী মানুষগুলো যেন বারুদ হয়ে জ্বলে না ওঠে

আবেগী মানুষগুলো যেন বারুদ হয়ে জ্বলে না ওঠে

বাণী ইয়াসমিন হাসি

ইতিমধ্যেই দেশের সাংসদ, সাংসদের পরিবারের সদস্য, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের সদস্যবৃন্দ, অধিদফতরের মহাপরিচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ আক্রান্ত হয়েছেন কোভিড-১৯ এ।

আজকের এই লেখাটা লেখার জন্য আমি গত দুইদিন ধরে মানুষের মন এবং মনোজগৎ নিয়ে বেশ ঘাটাঘাটি করেছি যদিও কোনো কুলকিনারা পাইনি। আমার মূল আগ্রহের বিষয় ছিল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের আক্রান্তের নিউজগুলোর কমেন্ট সেকশন। অধিকাংশ মন্তব্যকারীই উল্লাস বা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন! ব্যাপারটা আমাকে বেশ ভাবিয়ে তোলে।

 

জন্মের পর থেকে যে চিরাচরিত বাঙালি সংস্কৃতি দেখে আসছি তার সাথে তো এটা যায় না! আমাদের গ্রামে কোনও বাড়িতে কেউ মারা গেলে ওই বাড়িতে ৭ দিন পর্যন্ত চুলা জ্বলে না। আশেপাশের বাড়ি থেকে প্রতি বেলায় খাবার যায়। আমার খুব মনে আছে ঈদের মতই প্রতি পূজায়ও আমাদের নতুন জামা মিলতো। পারস্পরিক সৌহার্দ্যবোধ সম্প্রীতি কোথায় গেল সব।

মানুষ কেন এমন অসহিষ্ণু হয়ে উঠল? কেন অন্যের চরম বিপদে এমন নির্লজ্জের মত আচরণ করছে?
এবার একটু পেছনে ফেরা যাক -আমরা অধিকাংশই নিজের বিষয় নিজে চিন্তা করতে জানি না। নিজের ভালোমন্দ নিরূপণ করতে অক্ষম, অন্যের পরামর্শ এবং শোনা কথায় আমাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড চলে। আর নিজের ব্যর্থতার জন্য সব সময়ই দায়ী করার মত কাউকে না কাউকে পেয়ে যাই। কিন্তু নিজের দুর্বলতার উৎসটার দিকে একবারও নজর দিই না। আসলে আমাদের মনের উপর একটা গাঢ় মায়াজাল তার বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। সজ্ঞানে আমরা তার বাইরে যেতে পারি না। তাই যেকোনও কাজেই আমরা এক পা এগিয়ে আবার তিন পা পিছিয়ে যাই। এক ধরনের মানসিক ভীতিই আমাদের চালিত করে। যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলে আসছে।

ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যমকর্মী এবং জরুরি সেবাদনে নিয়েজিত কর্মীরা একের পর এক আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন কোভিড -১৯ এ। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই নিয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ২৬৯ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ১৬২ জনের শরীরে। নতুন রোগীসহ বর্তমানে মোট শনাক্তের সংখ্যা ১৭ হাজার ৮২২ জন। করোনাভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত অনলাইন বুলেটিনে বুধবার (১৩ মে) দুপুরে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

গত ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হলেও তা মূলত প্রকাশ্যে আসে জানুয়ারিতে। ফেব্রুয়ারিতে চীনে যখন এটি ভয়াবহ রূপ নেয় তখন ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। সবাই প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিদেশ ফেরতদের ক্ষেত্রে স্ক্রিনিংসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তবে এতকিছুর পরও ৮ মার্চ দেশে প্রথম এই ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। এরপর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম ভাইরাসটির সংক্রমণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এরপর ক্রমেই বাড়তে থাকে এর প্রাদুর্ভাব। এপ্রিলে এসে ভাইরাসটি যেন মারাত্মক রূপ ধারণ করে। যার ফলশ্রুতিতে এই মে তে এসে মৃতের সংখ্যা আড়াইশ’ পেরিয়ে তিনশ’ ছুঁইছুঁই।

নিত্যদিন ঘটে চলা অনিয়মগুলো মানুষের মনে দারুণ প্রভাব ফেলে এবং মাঝেমধ্যেই তা থেকে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অনেক কিছু মানুষ মেনে নিলেও, মনে নেয় না। খাঁচায় বন্দি পাখির আকাশে ওড়ার জন্য যেমন ছটফটানি থাকে কিংবা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শিকারির ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ চেষ্টা থাকে তেমনি বিক্ষুব্ধ মন বিকৃত হতেও সময় নেয় না।

আমরা হরহামেশাই দেখি সামান্য দুই টাকা কম ভাড়া দেওয়ার জন্য বাসের যাত্রীরা তুমুল বাকবিতণ্ডা, চিৎকার চেঁচামেচি, অকথ্য গালাগালি এমনকি হাতাহাতি পর্যন্ত করে। আসলে সমস্যা দুই টাকা বেশি-কম নিয়ে নয়। সমস্যা আরও গভীরে। তীব্র গরমে ও প্রচণ্ড জ্যামে অতিষ্ঠ ঠাসাঠাসি করে বাসে ওঠা মানুষ মনে করে তারা নানাভাবে বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার। এজন্য ভাবেন, দুই টাকা কম তারা দিতেই পারেন।

নিজেদের অনিরাপদ ও অসহায় ভাবতে ভাবতে মনের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ ও হতাশা জমতে থাকে। সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হল ক্ষোভ প্রশমনের জন্য চরম ও চূড়ান্ত অপরাধকেও আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়! বিচার বিবেচনার ধার না ধেরে অন্যায় জেনেও অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে মানুষ।

মানুষের অপরাধপ্রবণ ও অবচেতন মনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তিনটি বিষয় কাজ করে- এক. সামাজিক নিয়ম বা প্রথা, দুই. ধর্মীয় বিধি বা অনুশাসন, তিন. রাষ্ট্র আরোপিত আইন। এই তিনটি উপাদান পরষ্পর সম্পর্কযুক্ত। যখন কোনও একটা ঠিকমতো কাজ করে না তখন অন্যগুলোতেও ফাটল ধরে।

যখন আস্থার সংকট দেখা দেয়; অনিশ্চয়তা, গুজব তখন আমাদের গ্রাস করে ফেলে। নিরাপত্তাহীনতার চাদরে কুঁকড়ে মুচড়ে পড়া মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ক্রমেই। সাময়িক সমাধান নয় প্রয়োজন দীর্ঘদিনের ক্ষোভ প্রশমন। সেইসঙ্গে সবাইকে আস্থা ফিরিয়ে দেওয়া এবং সবার সংযত ও দায়িত্বশীল আচরণ জরুরি।

এখন স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে বড় ভয়। আমাদের মনের আদিম সংস্কারগুলো এখনও কাটেনি। আমরা কিছুই গ্রহণ করি না মনের গভীরে। ভাসা ভাসাভাবে, অনেক কিছু‌ই জানার ভান করি, আসলে আমাদের জানাশোনার পরিধি খুবই সংকুচিত। আমাদের মন এখনও একেবারে অপরিণত। সবচেয়ে মজার কথা হল, এ কথাটা ভুলে থাকার জন্যই আমরা প্রাণান্তকর চেষ্টা করি। অনেক খবরই হয়তো আমরা জানি কিন্তু কোনও কিছুকে চিন্তা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, প্রজ্ঞা দিয়ে নিজের করতে জানি না। যখনই কোনও ব্যবস্থার মধ্যে অসঙ্গতি দেখা দেয়, তখন গোঁজামিল দিয়ে শেষরক্ষা করার চেষ্টা করা হয়। অনেকটা শিশুর মত, অবুঝের মত-হাতের কাছে, চোখের সামনে যা আসে তা নিয়েই এক ধরনের সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা। কোনও দূরদর্শিতা নেই। তাই যেকোনও অপ্রিয় সত্যকে ঢেকে রাখাতেই সমস্ত প্রয়াস।

মানুষের আবেগ যখন শেষ হয় তখন সে বারুদে পরিণত হয়। বারুদ সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে। মানুষের পালসকে বোঝার চেষ্টা করুন। দেয়ালের ভাষা পড়ুন। চারদিকের মানুষ চোখেমুখে কি বলছে সেটা জানার চেষ্টা করুন। এখনও যেকোনও বিপদ বা সংকটে মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এই মাটি অনেক নরম। আবার এই নরম মাটি পোড়ালেই কিন্তু শক্ত ইটও হয়। সেই ইট দিয়ে আপনি ইমারত তৈরিতে ব্যবহার করতে পারেন আবার কারো মাথা ফাটাতেও ব্যবহার করতে পারেন। আপনি কীভাবে ব্যবহার করবেন তার উপরই নির্ভর করছে এর কার্যকারিতা। তবে দিনশেষে একটাই চাওয়া আবেগী মানুষগুলো যেন বারুদ হয়ে জ্বলে না ওঠে।

লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর