বুকের মাঝে বিসর্জনের ব্যথা...

বুকের মাঝে বিসর্জনের ব্যথা...

বাণী ইয়াসমিন হাসি

অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কিছুই ঠিকমত গুছিয়ে লিখতে পারছি না ...

সমরেশ বাবু উনার এক লেখায় বলেছেন ; ‘মৃত্যু কি সহজ, কি নিঃশব্দে আসে অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়’।

জাতিগতভাবে আমরা একটা মহা শূণ্যতার দিকে ধাবিত হচ্ছি। একে একে সব মহীরূহরা চলে যাচ্ছেন কিন্তু উনাদের কোন বিকল্প তৈরি হচ্ছে না। বিকল্প তো দূরের কথা ধারেকাছে যাওয়ার মতও কেউ তৈরি নেই।

এই গ্যাপটা সামনের দিনে আমাদের বেশ ভোগাবে।
আমাদের একজন আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন। তিনি চলে গেলেন। জানি এই শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক, গবেষক জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান গতকাল চলে গেলেন না ফেরার দেশে, যাকে ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদবিরোধী নানা আন্দোলনে সব সময় সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে বাংলাদেশ। রাষ্ট্রের দুই সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদক পাওয়া আনিসুজ্জামান ২০১৭ সালে তার আশিতম জন্মবার্ষিকীতে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, তিনি শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে তিনি পেয়েছেন ‘প্রাপ্যের অধিক’। তিনি সারাজীবন ছাত্র থাকতে চেয়েছিলেন। জীবনে চলার পথে অপ্রত্যাশিত আঘাত হয়ত পেয়েছেন, কিন্তু ভালোবাসা পেয়েছেন তার চেয়ে ‘অনেক বেশি’।

মেধা ও মননে সময়ের এক আধুনিক মানুষ জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। তার হাতে প্রাণ পেয়েছে এ দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির আন্দোলন। সমৃদ্ধ হয়েছে ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা। জ্ঞানের চর্চায় আলোকিত করেছেন শিক্ষার ক্ষেত্র। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের বিকাশে রেখেছেন বিশেষ ভূমিকা। শুধু তাই নয়, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেই ভূমিকার মূল্যায়ন করে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন- ‘জানি দৃষ্টি তার সদা মানবের প্রগতির দিকে/প্রসারিত। কী প্রবীণ, কী নবীন সকলের বরেণ্য নিয়ত’। এই কবিতার পংক্তিমালার মতই বর্ণিল কর্মজীবনের আশ্রয়ে জাতির চেতনার বাতিঘরে পরিণত হয়েছিলেন ড. আনিসুজ্জামান। নিভে গেল সেই চেতনার বাতিঘরটি। প্রগতির পানে প্রসারিত দৃষ্টিটি আর কখনও চাইবে না চোখ মেলে। সঙ্কটে দেখাবেন না পথের দিশা কিংবা বাঙালিত্বের উদযাপনে থাকবেন না সামনের সারিতে। শেষ হলো মুক্তচিন্তা, সংস্কৃতির বহুত্ববাদ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী কীর্তিমান মানুষটির দীর্ঘ এক বর্ণাঢ্য জীবনের পরিভ্রমণ।

মাত্র কয়েক দিন আগে জাতীয় অধ্যাপক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জামিলুর রেজা চৌধুরীও চলে গেলেন। তিনি ২৮ এপ্রিল মঙ্গলবার ভোররাতে ইন্তেকাল করেন।  

জামিলুর রেজা চৌধুরী বাংলাদেশের প্রকৌশল জগতে সবার পরিচিত নাম। একাধারে তিনি গবেষক, শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী ছিলেন। স্বাধীনতার পর এ দেশে যত বড় বড় ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটির সঙ্গেই জামিলুর রেজা চৌধুরী কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিলেন। যুক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে। হাত দেন পদ্মা সেতু নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞে।

জামিলুর রেজা চৌধুরী একসময় যুক্তরাষ্ট্রে কাজের ডাক পেয়েছিলেন বিখ্যাত আরেক বাংলাদেশি প্রকৌশলী এফ আর খানের কাছ থেকে। কিন্তু দেশকে ভালোবেসে দেশেই রয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

দেশে-বিদেশে বিভিন্ন অবদানের জন্য সমাদৃত জামিলুর রেজা চৌধুরীর প্রায় ৭০টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অনেক পুরস্কার আর সম্মাননা। এর মধ্যে আছে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট স্বর্ণপদক, ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে পাওয়া সম্মানসূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি।

একসময় বুয়েটে অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জামিলুর রেজা চৌধুরী। দায়িত্ব পেয়েছিলেন ১৯৯৬ সালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও। উপাচার্য ছিলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির।

গত ২২ এপ্রিল জাতি তার আরেক কৃতি সন্তানকে হারায়। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসাইন মারা গেছেন এই দিনে। ড. সা’দত হুসাইন ২০০২-০৫ সালে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। পিএসসির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনা, দীর্ঘসূত্রিতা কমানো সহ বেশ কিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

পৃথিবীর বয়সের ভয়াবহতম দুর্যোগের একটির সঙ্গে লড়াই করছি আমরা। এক-দুই শতাব্দীতে এমন মহামারি দেখেনি বিশ্ব। গোটা পৃথিবীর আকাশ জুড়েই কোভিড-১৯ নামক এক কালো মেঘের আনাগোনা। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও এর বাইরে নয়। এই চরম সংকটকালীন সময়ে আরো বড় ক্ষতি একে একে জাতির সূর্যসন্তানদের বিদায় নেওয়া।

ড. আনিসুজ্জামান, ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, ড. সা’দাত হুসাইন এই সময়ের ব্যতিক্রম উদাহরণ। কারণ উনারা পেরেছিলেন ক্ষুদ্রতা, ব্যক্তি স্বার্থ, নষ্ট রাজনীতির কুয়ো থেকে বেরিয়ে উন্মুক্ত ময়দানে দাঁড়াতে।

খসে পড়া তারা হয়তো জানে না তার না থাকাটাই মহাকাশে ঠিক কতখানি শূন্যস্থান তৈরি হয়? জোৎস্না ফুরোলেই কেউ বেমালুম ভুলে যায় না তারাদের; বেদখল হয় না ঐশ্বর্য।

একটা অপার্থিব দৃশ্য দেখে এলাম বারান্দায়। জোর এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে একটু আগে। গাছপালাগুলো সব স্নান সেরে উঠেছে সদ্য। একটু আগেই আকাশ কালো করে এসেছিলো। নীল আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘ ভেলা ভাসিয়েছে। আর অস্তগামী সূর্যের আলো এসে পড়েছে কাছে–দূরের গাছপালা এবং ইমারতগুলোর মাথায়। মনে হচ্ছে, ঝলমলে সোনা দিয়ে মোড়া মুকুট পরে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। চারদিকে একটা আশ্চর্য সোনালি আলোর বিচ্ছুরণ। আগুন রংয়ের আকাশ। তার মধ্যে ঝলমল করছে একটা আস্ত রঙধনু! সেই রঙধনু ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে আকাশচেরা বিদ্যুতের রুপোলি রেখা ঠিক স্বপ্নের মতন।

মাথা তুলে উপরে তাকালাম। পরিষ্কার, স্পষ্ট, ঝকঝকে আকাশ। কোনও ধোঁয়া নেই। ধুলো নেই। মালিন্য নেই। নিকষ কালো পটভূমিকায় তারার হাট বসেছে। এও এক অদ্ভুত আয়োজন। ঠিক সেই সময়ে কাছাকাছি কোনও বাড়ি থেকে খালি গলায় ভেসে আসছে, ‘আজি যত তারা তব আকাশে’।

একে একে তারারা খসে পড়ছে। আকাশ জুড়ে তাহলে আলোর খেলা খেলবে কারা? আকাশকে কি তবে শূন্যতা গ্রাস করবে?

চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র
রজনী চলে গেলে আমারও অধিক কিছু
থেকে যাবে আমার না-থাকা জুড়ে।

জানি চরম সত্যের কাছে নত হতে হয় সবাইকে-
জীবন সুন্দর
আকাশ-বাতাস পাহাড়-সমুদ্র সবুজ
বনানী ঘেরা প্রকৃতি সুন্দর আর সবচেয়ে সুন্দর এই
বেঁচে থাকা তবুও কি আজীবন বেঁচে থাকা যায়!
বিদায়ের সেহনাই বাজে নিয়ে যাবার
পালকি এসে দাঁড়ায় দুয়ারে সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে
এই যে বেঁচে ছিলাম দীর্ঘশ্বাস নিয়ে যেতে হয় সবাইকে
অজানা গন্তব্যে
হঠাৎ ডেকে ওঠে নাম না জানা পাখি অজান্তেই
চমকে ওঠি
জীবন, ফুরালো নাকি!
এমনি করে সবাই যাবে, যেতে হবে ...

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র কবিতাটি এতটাই প্রাসঙ্গিক এখানে। ‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়’। চিতার আগুনে স্মৃতি পোড়ে না। দূরত্ব ভালোবাসাকে মলিন করে না কখনো। এই যে অনতিক্রম্য দূরত্ব ... না থেকেও অনেকখানি জুড়ে থাকা। বাঙালি যেকোন সংকটে স্মরণ করবে তাদের একজন বটবৃক্ষ আনিসুজ্জামান স্যার ছিলেন ; আরো ছিলেন একজন ভিশনারী স্বাপ্নিক জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার, তাদের একজন একজন ন্যায়নিষ্ঠ আদর্শবান সা’দাত হুসাইন স্যার ছিলেন। উনারা এসেছিলেন, আলো ছড়িয়েছিলেন। জয় করে নিয়েছিলেন সর্বসাধারণের মন। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে এমন মহীরূহদের হারিয়ে গোটা জাতির বুকেই আজ বিসর্জনের ব্যথা!


লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট

 

নিউজ টোয়েন্টিফোর/কামরুল