‘ভালোবাসা পেতে হলে ভালোবাসতে হয়’
প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামানের স্মরণে

‘ভালোবাসা পেতে হলে ভালোবাসতে হয়’

সোহেল সানি

‘এভরি পার্টি ওয়ার্কার অব মাইন ইজ লাইক মাই ব্রাদার, ইজ লাইক মাই সন। আই ক্রিয়েটেড এ ফ্যামিলি হোয়েন আই অরগানাইজড আওয়ামী লীগ, পলিটিকাল পার্টি মিনস এ ফ্যামিলি- যার ভেতর আছে আইডিওলজিক্যাল এফিনিটি। পার্টিতে উই আর ওয়ান ফর সাম পার্টিকুলার পারপাসেস, হোয়্যারেভার উই আর। ’

কথাগুলো জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কিন্তু এ কথাগুলো যাঁর মুখে শুনেছিলাম, তিনি জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান।

কথাগুলো লিখে রেখেছিলাম। তিনি চিরন্তনের জন্য, গত হয়েছেন ১৪ মে।

স্যার আনিসুজ্জামান দেশের চলমান রাজনীতির প্রতি কিছুটা হতাশা ব্যক্ত করে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর আর্দশিক সৈনিক হওয়ার আগে একজন প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মী হতে হবে। যা খুব সহজ নয়।

শেখ মুজিব যা হয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। সেটাই পরবর্তীতে তাঁকে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক সৈনিক হওয়াও তেমনি কঠিন ব্যাপার। তা হতে হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ চর্চা বা অনুসরণ করতে হবে। যা বর্তমানে একেবারেই অনুপস্থিত।
নেতা ও  কর্মীর মধ্যকার সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিৎ সেটা বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পাঠ করেও উপলব্ধি করা যায়। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান  
বঙ্গবন্ধুর ভাষায়  বলেছিলেন ‌‌‘মবিলাইজ দি পিপল এন্ড ডু গুড টু দি হিউম্যান বিইংস অব বাংলাদেশ। দিজ আনফরচুনেট পিপল হ্যাভ সাফার্ড লং-জেনারেশন আফটার জেনারেশন। ’

বড় নির্মম মহাকালের কথা না ভেবে, সমকালের কোন স্তুতিবাদ, নিন্দাবাদের তোয়াক্কা না করে পথ চলছেন। নিঃস্বার্থ কর্মীরাই সকল সংকটে বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়েছে। আনিসুজ্জামান মহতিমনের প্রেরণায় অনুরক্ত হয়ে ওঠা অদৃষ্টবাদীর ন্যায় গভীর, গহীন-বিষাদে ডুবে থাকার মানুষ নন। তার মানবিক মূল্যবোধের উচ্চতা অসীম। অন্তপ্রাণে অসাধারণ অমূর্ত স্মৃতি, কালোত্তীর্ণ প্রতিভা, স্তম্ভিত বিস্ময় এক শিক্ষক প্রতিভা তিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ভীতিকে উপেক্ষা করে পথ চলেছেন, সাহসী উচ্চারণের মাধ্যম আওয়ামী লীগের কর্মীদের মাঝে আন্দোলনের প্রদীপ জ্বেলে দুঃসাহস যুগিয়েছেন। তিমির, নিবিড় অন্ধকার এ মহান শিক্ষককে তাড়া  করলেও তিনি মুখ বন্ধ করেননি। শেখ হাসিনার কর্মীরা এসব মহান বুদ্ধিজীবীদের ইতিহাস গবেষণা পর্যবেক্ষণ  মন্ত্রমুগ্ধের মতো গিলে তেজস্বী বীর্যবন্ত হয়ে ওঠে।

ওজস্বিনী বক্তৃতায় মুক্তির দাবির বন্দনহীন ছন্দের মতো অনর্গল উচ্ছ্বাসে একদিন সভা সমাবেশে যারা সদাজাগ্রত ছিলেন তারাই অধ্যাপক আনিসুজ্জামানদের মতো গুনীমান্যি ব্যক্তিত্বদের চিরদিন শ্রদ্ধায় ভক্তিতে স্মরণ করবে। শেখ হাসিনার সুখ-দুঃখের পরোক্ষ অনুভবে তপস্যারত ছিলেন এসব গুনীজন। ক্ষুরধার যুক্তির খাতিরে শূন্যগর্ভ অভিযোগী শব্দে অনেক নেতাই বিশ্বাস করেননি যে কর্মীরাই মূল শক্তি। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাসই শুধু করতেন না, তিনি স্বাধীনতা এনে দিয়ে বলেছেন, "আমরা যারা ক্ষমতা ব্যবহার করতে শিখেছি তারাই মুরব্বীয়ানা দেখিয়েছি। যেন আমরা হলাম মালিক, তোমরা আমাদের গোলাম। তোমরা এসো আমাদের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকো। আমাদের হুকুম নাও, হুকুম মতো কাজ করো-এই মনোভাব কোন স্বাধীন দেশে চলতে পারে না। "

অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সততার উপলব্ধির বিস্ময়কর অনুমানীয় চিন্তাধারাই তার মেধা ও প্রতিভার উচ্চকিত ভাবভঙ্গিতে প্রকাশ পায়।   তারুণ্যসুলভ অসীম আশাবাদী এক উদ্যমী কর্মবীর তিনি। নিষ্ঠা, সততা ও দেশপ্রেমববোধের বহু দৃষ্টান্তের উন্মোচন করেন নানা সেমিনারে বক্তৃতায়।   আস্থা, বিশ্বাস, সততা, নিষ্ঠা, শ্রম ও ত্যাগসুখ আর ব্যক্তিত্বের পরিচয়বহন করে চলেছেন আজীবন। ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টিকরণই এসব গুনীজনের কর্মের পরিধি ধীরলয়ে বিস্তৃতিলাভ করেছে। সরল, সহজ, সাবলীল ব্যবহার,তার আচার-আচরণে ফুটে ওঠে। শিক্ষার্থীদের কাছে আনিসুজ্জামান মাতৃত্বের বন্ধনের ন্যায় আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা এক আদর্শস্থল। প্রয়াসের নানা ক্ষেত্র আবিষ্কারের পরিকল্পক ছিলেন তিনি। ছিলেন কর্মশৈলীতায় সর্বদা চিন্তামগ্ন। আনিসুজ্জামান রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করে গণমানুষের মনের দুয়ারে কড়া নাড়েননি ঠিকই, কিন্তু যারা কড়া নেড়েছেন, তাদের গড়ে তোলার কারিগর ছিলেন তিনি। প্রাণবন্ত উজ্জ্বল-উচ্ছল বিদগ্ধপ্রাণ আনিসুজ্জামান করোনায় মারা যাবেন তা ভাবিনি। নিখাদ বিশ্বাস ও সংবেদনশীল পথ-পরিক্রমায় বেড়ে ওঠা সম্ভাবনাময় তরুণদের জন্য তাঁর জীবনের গল্পটাও হতে পারে এক আদর্শ।   মানবকল্যাণের সূত্র। ধীরশান্ত স্থিরচিত্তের মানুষ তিনি। অশুভের অন্ধকারের বিরুদ্ধে শুভের সংগ্রামে রাজপথে বিদ্রোহী কাণ্ডারী নন, আদর্শবাদী ছাত্র গড়ার কারিগর তিনি। প্রশমিত প্রেমবোধের বিপরীতে অগ্নিমূর্তির প্রকাশ ঘটিয়েছে প্রবন্ধে লেখনীতে, সেমিনারে বক্তৃতায়। উপেক্ষার চোখ নয়, ভালবাসা পেতে হলে ভালোবাসতে হয়।

আনিসুজ্জামান বেশভূষায়ও খাঁটি বাঙালি। চোখ জুড়ায় সুরুচিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ও মহিমানিলয় মিলনমেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে তাঁর অপূর্ব উপস্থিতিতে। সরল, সহজ অন্তঃকরণ এবং সচ্ছল দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী যাঁরা তাঁদের জানতে বহুদিনের প্রয়োজন পড়ে না। নিরহংকারীদের পরিশীলিত,পরিচ্ছন্ন, নির্মল ও প্রশান্ত মনের অধিকারী হতে হয়। আনিসুজ্জামান স্যার তেমনটিই ছিলেন। শিক্ষক আনিসুজ্জামান ও ছাত্রী শেখ হাসিনার অন্তরের সঙ্গে অন্তরের আত্মিক সম্পর্কের সুদৃঢ় গাঁথুনি গড়ে উঠেছিলো। জাতির পিতার সঙ্গেও ছিলো তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যে সংবিধানে বাংলারূপ দিতে গিয়ে আনিসুজ্জামান ও সৈয়দ আলী আহসান যে ভাষাচয়ন, ভাষাশৈলির মূর্ছনা ছড়িয়েছেন তা অসাধারণ অনিন্দ্য সুন্দর।

অহিংসার পথ ধরেই হেঁটে চলা দেশবরেণ্য অভিভাবক আনিসুজ্জামান  মানুষের মন জয় করতে পারতেন এক পলকে। সত্যিই পরিপূর্ণ মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া যায় দ্বিধাহীন চিন্তার স্বাধীনতায়। মূল্যবোধের দীনতায় গুণীজনদের প্রতিভার স্ফূরণ ঘটে না। আর পদাধিকার বলে আত্নঘোষিত ব্যক্তিদের দিয়ে সামাজিক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা দেখা যায়, কিন্তু সৃজনশীলতাকে এগিয়ে রাখা যায় না।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সেটাই দেখিয়েছেন জীবনাচরণে। তাই তিনি মৃত্যুবরণ করেও মৃত্যুঞ্জয়ী।

লেখক- সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/তৌহিদ)

সম্পর্কিত খবর